জাতিংগার রহস্যময় পাখিরা

১৯০৫ সালের এক রাতে প্রচণ্ড ঝড় শুরু হলো ভারতের জাতিংগা গ্রামে। সেই ঝড়ে প্রায় লন্ডভন্ড হওয়ার দশা আসামের এই দুর্গম গ্রামটির। যে যার মতো প্রার্থনা করতে লাগল আতঙ্কিত গ্রামবাসী। একসময় থামল ঝড়। ঝড় শেষে দেখা গেল, এক ভদ্রলোকের ভেড়া হারিয়ে গেছে। পাহাড়ি অঞ্চল জাতিংগা। একে তো রাত, তার ওপর বুনো প্রাণীদের ভয়। তাই গ্রামের মানুষ দল বেঁধে ভেড়া খুঁজতে রওনা হলো পাহাড়ের খাজে। হঠাৎ ঘটল ভুতুড়ে এক ঘটনা। মুহূর্তের মধ্যে চারদিক থেকে ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে হাজার হাজার পাখি ছুটে এল গ্রামবাসীর দিকে। ভয় পেয়ে গেল লোকজন। ভাবল অশুভ আত্মা ভর করেছে পাখিগুলোর ওপর। তাদের আক্রমণ করতেই আসছে পাখিরা। কিছু পাখি ঝাঁপিয়ে পড়ল মশালের আগুনে। ভয় পেয়ে কিছু পাখিকে আঘাত করল গ্রামবাসী। দৌড়ে ঘরে ফিরে গেল আতঙ্কিত গ্রামবাসী। পরদিন পুরো গ্রামে রটে গেল, আগুনে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছে পাখিরা। এরা অভিশপ্ত। তাই দেবতাদের ইশারায় আগুনে পুড়ে মারা গেছে।

সেই থেকে শুরু। অভিশপ্ত পাখিরা আক্রমণ করতে আসে—এই বিশ্বাস ছড়িয়ে পড়ল পুরো গ্রামে। বর্ষা মৌসুমের শেষে কুয়াশাচ্ছন্ন রাতে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখির মৃত্যু চলতেই থাকল। অনেকের কাছে ‘ভ্যালি অব ডেথ’ বা মৃত্যু উপত্যকা নামেও পরিচিত পেতে শুরু করল গ্রামটি।

১৯৬০ সালে প্রকৃতিবিদ ই পি গি বিশ্ববাসীর নজরে আনেন রহস্যময় এই ব্যাপারটি। পাখিবিজ্ঞানী সলিম আলীকে সঙ্গে নিয়ে রহস্য উদ্‌ঘাটনে নেমে পড়েন তিনি। দেখা গেল প্রতিবছর আগস্ট-সেপ্টেম্বরেই ঘটে রহস্যময় ঘটনাটা। কিন্তু পাখিরা আসলে আত্মহত্যা করে না। তারা অশুভও নয়। আসলে সমস্যাটা জাতিংগার উচ্চ দ্রাঘিমাংশ। উঁচু দ্রাঘিমাংশ আর প্রচণ্ড বাতাসের কারণে দিশেহারা হয়ে যায় বিভিন্ন জাতের পাখিরা। তখন বাধ্য হয়ে নিচের দিকে ছুটে আসতে থাকে তারা। আর গ্রামবাসী আতঙ্কে সেটাই ভাবে অশুভ আত্মার আক্রমণ। পাখিগুলোকে বাঁশের লাঠির আঘাতে নিচে নামাতে বা হত্যা করতে চাইত তারা। কেউ আবার ভাবত পাখিরা আত্মহত্যা করছে।

আরেকজন পাখিবিজ্ঞানী আনোয়ার উদ্দিন চৌধুরী ২০০০ সালে এ বিষয়ে গবেষণা গ্রন্থ প্রকাশ করেন দ্য বার্ড’স অফ আসাম নামে। এ বইয়ে তিনিও বলেন, বর্ষার শেষে রাতে জাতিংগা গ্রামের চুম্বকীয় স্তরে বেশ পরিবর্তন ঘটতে দেখা যায়। এ সময় আকাশের পাখিদের পৃথিবী তার কেন্দ্রের দিকে প্রচণ্ড বেগে আকর্ষণ করতে থাকে। আর এই পাখিগুলো মূলত একেবারেই কম বয়সী। ফলে তারা প্রতিকূল পরিবেশে মানিয়ে নিতে পারে না। কুয়াশায় দিশেহারা হয়ে সেখানকার পাহাড়ে আছড়ে পড়ে গুরুতর আহত হয়। আঘাতের কারণে কিছুক্ষণ পর তারা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। তবে এই চুম্বকীয় স্তরের পরিবর্তন কেন ঘটে, তা আবিষ্কার করতে পারেননি তিনি। এই নিয়ে বিজ্ঞানীরা এখনো গবেষণা করছেন।

এবার নড়েচড়ে বসে ভারতের বন্য প্রাণীবিষয়ক অধিদপ্তর। সঙ্গে যোগ দেয় বন্য প্রাণী সংরক্ষণবিষয়ক অন্যান্য সংগঠনও। পুরো বিষয়টি নিয়ে গ্রামবাসীকে সচেতন করতে নানা ধরনের কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে তারা। পাখিরা যে অশুভ নয়, বাতাস আর কুয়াশায় পথ হারিয়ে তারা ল্যাম্পপোস্ট বা বাড়ির আলোতে বাড়ি খায়, সে ব্যাপারটি গ্রামবাসীকে বোঝাতে পেরেছে তারা। ধারাবাহিক এই ক্যাম্পেইনের পর গত কয়েক বছরে পাখিদের মৃত্যু প্রায় ৪০% কমে গেছে।

সূত্র: অ্যাটলাস অবসকিউরা