জাপানে ওয়াটার রকেটযাত্রা

একটা কার্ড পেলাম। লাল-সবুজ কার্ডটি যেন বাংলাদেশের পতাকা। উল্টিয়ে দেখি ইংরেজিতে ‘বাংলাদেশ, বাংলাদেশ’ লেখা। সঙ্গে শুভেচ্ছা। কার্ডটি দিয়েছিল ভিয়েতনাম দলের বন্ধুরা। আমরা তো মুগ্ধ।

আমরা ১৯টি দেশের ১২ থেকে ১৬ বছর বয়সী ছেলেমেয়েরা মিলেছিলাম জাপানের চিবাতে। আয়োজনটা ছিল ‘ওয়াটার রকেট ইভেন্ট’। এশিয়া-প্যাসিফিক রিজিওনাল স্পেস এজেন্সি ফোরামের সহযোগিতায় এর আয়োজন করেছিল জাপান অ্যারোস্পেস এক্সপ্লোরেশন এজেন্সি।

বাংলাদেশ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটি থেকে নির্বাচিত হয়ে আমরা চারজন যাই প্রতিযোগী হিসেবে। সহযোগিতায় ছিল বাংলাদেশ বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণ সমিতি। আমাদের দলে আমরা চার প্রতিযোগী—স্যার জন উইলসন স্কুলের ফারদিম মুনির, ইমতিয়াজ আহমেদ, রাজশাহী ক্যাডেট কলেজের সাদ বিন হাসান সিয়াম আর অরণি বিদ্যালয়ের আমি। আমাদের দলনেতা ও কোচ ছিলেন রেজা সরকার। বাংলাদেশ দলে শিক্ষক হিসেবে আমাদের সঙ্গে গিয়েছিলেন ওয়াহিদুজ্জামান আর পর্যবেক্ষক ছিলেন মোহাম্মদ ফয়সাল মোস্তফা হাশেম।

আমাদের প্রতিযোগিতা ছিল ২৯ ও ৩০ নভেম্বর। ঢাকা থেকে ২৭ নভেম্বর রাতে রওনা দিয়ে পরের দিন রাতে জাপানের নারিতায় গিয়ে পৌঁছাই। সেখান থেকে আমরা একটি বাসে করে হোটেলে যাই। ২৯ নভেম্বর সকাল আটটায় সব দেশের ছেলেমেয়ে মিলে বাসে করে যাই নিহন বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখানেই হবে আমাদের প্রতিযোগিতা। এখানে আমরা সবাই নিজ নিজ দেশের ওপরে কিছু প্রেজেন্টেশন দেখালাম। সেখানেই পৌনে ১২টায় হলো দুপুরের খাওয়া।

বেলা তিনটায় আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো টোকিওর মিরাইকান বিজ্ঞান জাদুঘরে। ঢুকেই দেখতে পেলাম এক বিশাল পৃথিবী। দেখে মনে হলো সত্যিকারের পুরো পৃথিবীটাই যেন সামনে। হঠাৎ দেখলাম জাদুঘরের মাঝখানে কী যেন দেখার প্রস্তুতি নিচ্ছে সবাই একত্র হয়ে। গিয়ে দেখি রোবট। নাম অ্যাসিমো, যা তৈরি করেছে হোন্ডা কোম্পানি। রোবটটি মানুষের মতোই লাফায়, দৌড়ায়, গান করে ও হাঁটে।

বিভিন্ন দেশের প্রতিযোগীর সঙ্গে আমরা

৩০ নভেম্বর আমাদের মূল প্রতিযোগিতা। ওয়াটার রকেট বানাতে হবে আর তা উড়িয়ে ৮০ মিটার দূরে নির্দিষ্ট একটা বৃত্তের মধ্যে ফেলতে হবে। সকাল সাতটায় আমরা (বাংলাদেশ দল) বাসে করে নিহন বিশ্ববিদ্যালয়ে যাই। আগে জানতাম জাপানের অপর নাম নিপ্পন। ওখানে গিয়ে শুনি ওরা নিহন উচ্চারণ করে। নিহন বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েই শুনি কিছুক্ষণ পর ওয়াটার রকেট প্রতিযোগিতা শুরু হবে। তাই আমরা সবাই তাঁদের কথামতো দুটি ঘরে ভাগ হয়ে গেলাম। ঘরে ঢুকে যে যার টেবিলে চলে গেলাম। এখানে ছয়টি প্লাস্টিকের বোতল, দুটি টেপ (পিভিসি), দুই টুকরো প্লাস্টিসিন ও একটি নজল রাখা আছে।

আমরা এসব জিনিস দিয়ে রকেট বানানো শুরু করলাম। প্রত্যেকে বানিয়েছিলাম দুটি করে রকেট। আমি আমারটা বানিয়ে প্রথম রকেটটা টেস্ট লঞ্চ করলাম। এরপর চলে গেলাম সেই ঘরে। এরপর সবাই সবার রকেট নিয়ে দুপুরের খাবার খেতে গেলাম। খাবার নিয়ে আরেকটা ঘরে যেতে হলো। গিয়ে দেখি হায়াবুসা-২ নামের এক কৃত্রিম উপগ্রহ নিয়ে অনেক আলোচনা চলছে। কয়েক দিনের মধ্যেই নাকি জাপান এটা মহাশূন্যে পাঠাবে।

দুপুরের খাওয়ার পর ১৯ দেশের সবাই মিলে তোলা হলো গ্রুপ ছবি। আমরা প্রতিযোগিতার কালো টি-শার্ট পরেছিলাম। এরপর লঞ্চিং ফিল্ড মানে ওয়াটার রকেট ওড়ানোর মাঠে চলে গেলাম। সেখানে গিয়ে সবাই সবার রকেট ওড়ানোর জন্য অপেক্ষা করছে।

জাপানের বেশ কিছু ঐতিহ্যবাহী খাবারও চেখে দেখেছি আমরা

এখানে বলে দিই ওয়াটার রকেট হলো প্লাস্টিকের বোতল দিয়ে বানানো একধরনের রকেট। কোমল পানীয়ের দেড়-দুই লিটারের দুটি বোতল দিয়ে রকেট তৈরি করা হয়। এতে প্লাস্টিকের শিট কেটে পাখনা লাগানো হয়। সামনের অংশে প্লে ডো বা প্লাস্টিসিন দিয়ে একটু ওজনও দিতে হয়। বোতলটির তিন ভাগের এক ভাগ পানি ভরে, নিচের দিকে নজল লাগিয়ে এটা লঞ্চিং প্যাড বা লঞ্চারে বসাতে হয়। নজলের সঙ্গে পাম্পার লাগিয়ে পাম্প দিতে হয়। এতে একটা চাপ তৈরি হয়। এরপর লঞ্চারের আংটা ছেড়ে দিলে রকেটটা উড়ে যায়।

অপেক্ষা করতে করতে চলে এল আমার রকেট ওড়ানোর পালা। লঞ্চিং প্যাডে আমার রকেট ঢুকিয়ে পাম্প করছি। পাম্প করার পর ওটা লঞ্চ করলাম। রকেটের নিচ দিয়ে প্রচণ্ড বেগে পানি পড়ছে, আর রকেট উড়ে যাচ্ছে। ইশ্, অল্পের জন্য বুলস আইয়ের কাছাকাছি পড়ল না। এরপর অপেক্ষা করছি দ্বিতীয়বার লঞ্চ করার জন্য। এবারও নির্দিষ্ট জায়গায় রকেট ফেলতেপারলাম না। আমাদের দলের সবারই একই অবস্থা। বাতাস ছিল ঝোড়ো আর এলোমেলো। আমরা নিরাশ হলেও দলনেতা বললেন, ‘তোমরা ভালোই করেছ। অনেকেরটা তো ওড়েওনি।’ চলে গেলাম ফ্রেন্ডশিপ ডিনারে। সেখানে গিয়ে জানতে পারলাম প্রথম হয়েছে মালয়েশিয়া, দ্বিতীয় আর তৃতীয় হয়েছে জাপানের প্রতিযোগী।

এরপর আমরা আরও দুই দিন থেকেছিলাম জাপানে। গিয়েছিলাম রাজধানী টোকিওতে ম্যাগনেটিক ট্রেনে করে। ঘুরে ঘুরে দেখেছি টোকিও শহর। বাংলাদেশ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক এফ আর সরকারও তখন টোকিওতে। তিনি এপিআরএসএএফের সভায় যোগ দিতে এসেছেন। সেই সভার পাশাপাশি চলছে প্রদর্শনী। প্রদর্শনী দেখে আমরা গেলাম ‘প্রবাসী’ হালাল ফুড নামের একটা দোকানে। কয়েকজন বাংলাদেশি মিলে এটি চালান। খেয়েদেয়ে চলে গেলাম হোটেলে। ব্যাগ গোছাতে হবে। পরদিন সকালে যে আমাদের দলটাকে উড়াল দিতে হবে বাংলাদেশের উদ্দেশে।

(কিশোর আলোর জানুয়ারি ২০১৫ সংখ্যায় প্রকাশিত)