টেলিপোর্টেশন কি বাস্তবে সম্ভব?

অ্যাভেঞ্জার্স এন্ডগেম ছবির অন্যতম চরিত্র ডক্টর স্ট্রেঞ্জকে (বেনেডিক্ট কাম্বারব্যাচ) যারা চেনো, টেলিপোর্টেশন ব্যাপারটা বুঝতে তাদের একটু সুবিধা হবে। যদিও ডক্টর স্ট্রেঞ্জ যা করেন, সেটি স্রেফ জাদু। বিজ্ঞান দিয়ে কি টেলিপোর্টেশন সম্ভব?

কোনো মানুষ বা কোনো বস্তুকে তাৎক্ষণিকভাবে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় স্থানান্তর করার ক্ষমতাসম্পন্ন প্রযুক্তিই হলো টেলিপোর্টেশন। তাত্ত্বিকভাবে, দুটি পদ্ধতিতে কোনো বস্তুকে টেলিপোর্ট করা সম্ভব। একটি হলো দৈহিকভাবে একটি জায়গায় ধীরে ধীরে ভেঙে ফেলে আরেক জায়গায় (ধরা যাক, বাসা থেকে তোমার স্কুলে) কাউকে নতুন করে তৈরি করা। আরেকটি হলো কাউকে প্রেরণযোগ্য ডেটায় রূপান্তর করে হয়তো টেলিফোনের তার বা ফাইবার অপটিকস কেব্‌ল দিয়ে আরেক জায়গায় পাঠিয়ে দেওয়া। তারপর ওই ডেটা থেকে তাকে আবার বস্তুতে রূপান্তর করা। বাস্তবে একে অসম্ভব মনে হলেও বিজ্ঞান কল্পকাহিনিতে ভবিষ্যতের প্রযুক্তি হিসেবে অনেক আগে থেকেই শক্ত অবস্থানে রয়েছে টেলিপোর্টেশন।

সিনেমায় ডক্টর স্ট্রেঞ্জই যে প্রথম টেলিপোর্টেশন দেখিয়েছেন, তা কিন্তু নয়। টেলিপোর্টেশনের ধারণা আরও পুরোনো। বিজ্ঞান কল্পকাহিনিতে সর্বপ্রথম টেলিপোর্টেশনের কথা উল্লেখ করা হয়েছিল লেখক এডওয়ার্ড পেজ মিশেলের দ্য ম্যান উইদাউট আ বডি শিরোনামের এক গল্পে। এটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৭৭ সালে। গল্পটিতে এক বিড়ালের দেহের সব পরমাণু আলাদা করতে সক্ষম হয়েছিলেন এক বিজ্ঞানী। এরপর পরমাণুগুলো এক টেলিগ্রাফের তার দিয়ে অন্য জায়গায় পাঠিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। বিজ্ঞানী নিজেকে এভাবে টেলিপোর্ট করার চেষ্টা করেছিলেন। দুর্ভাগ্যের ব্যাপার হলো, ঠিক সে সময় ব্যাটারি নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল। তাতে তার মাথাটাই কেবল টেলিপোর্ট হয়েছিল।

শার্লক হোমসের স্রষ্টা স্যার আর্থার কোনান ডয়েল টেলিপোর্টেশন নিয়ে বেশ আগ্রহী ছিলেন। অনেক বছর উপন্যাস ও ছোটগল্প লেখার পর তিনি শার্লক হোমস সিরিজ নিয়ে বিরক্ত হয়ে ওঠেন। সে কারণে হোমসকে মেরেও ফেলেছিলেন। কিন্তু পাঠকের তীব্র প্রতিবাদের মুখে হোমসকে আবারও বাঁচিয়ে ফিরিয়ে আনতে বাধ্য হন ডয়েল। বিরক্ত হয়ে হোমসের প্রতিদ্বন্দ্বী ‘প্রফেসর চ্যালেঞ্জার’ নামে নতুন এক সিরিজ লিখেছিলেন ডয়েল। ১৯২৭ সালে প্রকাশিত দ্য ডিসইন্টিগ্রেশন মেশিন উপন্যাসে প্রফেসর চ্যালেঞ্জার এক বিজ্ঞানীর পাল্লায় পড়েছিলেন। তিনি এমন এক যন্ত্র বানিয়েছিলেন, যা দিয়ে মানুষকে টুকরো টুকরো করে ফেলা যেত। তারপর তাকে আবার জোড়া লাগানো যেত অন্য কোথাও।

হলিউডে টেলিপোর্টেশন আবিষ্কারের ঘটনা খুব বেশি আগের নয়। টেলিপোর্টেশন ব্যবস্থা ভেস্তে গেলে কী ভয়ংকর হতে পারে, তা দেখানো হয়েছে ১৯৫৮ সালে নির্মিত দ্য ফ্লাই চলচ্চিত্রে। এক বিজ্ঞানী নিজেকে টেলিপোর্ট করতে সফল হন। দুর্ঘটনাক্রমে টেলিপোর্টেশন চেম্বারে ঢুকে পড়া এক মাছির সঙ্গে তার পরমাণুগুলো মিশে গিয়েছিল। তাতে ওই বিজ্ঞানী অর্ধেক মানুষ আর অর্ধেক মাছির মিশ্রণে পরিণত হয়েছিলেন কিম্ভূতকিমাকার মিউটেটেড দানবে। চলচ্চিত্রটি ১৯৮৬ সালে রিমেক হয়েছিল। এ গল্পের ছায়া অবলম্বনে দেশীয় পটভূমিতে ‘মাকড়শা’ শিরোনামে গল্প লিখেছিলেন মাসুদ রানার স্রষ্টা কাজী আনোয়ার হোসেন। চমৎকার এ গল্প পরে তাঁর তিনটি উপন্যাসিকা বইয়ে সংকলিত হয়।

লুই দ্য ব্রগলি ও এরউইন শ্রোডিঙ্গার

স্টার ট্রেক সিরিজের কারণে টেলিপোর্টেশন সাধারণের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। স্টার ট্রেক–এর স্রষ্টা জিন রোডেনবেরি সিরিজটিতে টেলিপোর্টেশন আমদানি করেন। কারণ দূরের গ্রহে রকেট শিপ ওঠানামার জন্য যে ব্যয়বহুল স্পেশাল ইফেক্টের প্রয়োজন, তার জন্য পর্যাপ্ত বাজেট ছিল না নির্মাতা প্যারামাউন্ট স্টুডিওর। তাই টেলিপোর্টেশনের মাধ্যমে কম খরচে এন্টারপ্রাইজের ক্রুদের গন্তব্য পৌঁছানোর বুদ্ধি এঁটেছিলেন তাঁরা। সেটাই যে এত জনপ্রিয় হবে, কে জানত! কথা হলো, গল্পে তো গরুকেও গাছে তোলা যায়, চাইলে আকাশে উড়িয়ে দিলেও কে ঠেকায়? কিন্তু এ বিষয়ে সত্যিকার বিজ্ঞান কী বলে?

অনেক দিন ধরেই টেলিপোর্টেশন নিয়ে আপত্তি জানিয়ে আসছেন বিজ্ঞানীরা। কারণ চিরায়ত নিউটনের তত্ত্ব অনুসারে টেলিপোর্টেশন একেবারেই অসম্ভব। পদার্থ বিলিয়ার্ড বলের মতো শক্ত ও অতি ক্ষুদ্র—এ ধারণা নিউটনের সূত্রগুলোর ভিত্তি। আবার এ সূত্রমতে, কোনো বস্তুকে ধাক্কা না দেওয়া পর্যন্ত সেটি গতিশীল হয় না; আবার কোনো বস্তু হঠাৎ হারিয়ে যেতে এবং অন্য কোথাও হঠাৎ উদয় হতে পারে না। নিউটনের এসব সূত্র প্রায় ২৫০ বছর রাজত্ব করেছিল। এরপর ম্যাক্স প্ল্যাঙ্কের হাতে ১৯০০ সালে জন্ম হয়েছিল কোয়ান্টাম তত্ত্ব। নিউটনের তত্ত্বে সম্ভব না হলেও কোয়ান্টাম তত্ত্বে কণার টেলিপোর্টেশন সম্ভব। ১৯০৫ সালে আইনস্টাইন প্রমাণ করেছিলেন যে আলোর কণার মতো ধর্মও আছে। অর্থাৎ এদেরকে শক্তির প্যাকেট বা গুচ্ছ হিসেবেও ব্যাখ্যা করা যায়। শক্তির এ গুচ্ছকেই বলে ফোটন। তবে গত শতাব্দীর বিশের দশকে শ্রোডিঙ্গার বুঝতে পারলেন, এর বিপরীতটাও সত্য। অর্থাৎ ইলেকট্রনের মতো কণাগুলোর তরঙ্গ ধর্মও আছে। এ ধারণা প্রথম উল্লেখ করেছিলেন ফরাসি পদার্থবিদ লুই ডি ব্রগলি। এ কারণেই পরে নোবেল পুরস্কার পান তিনি। একদিন এ বিষয়ে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন শ্রোডিঙ্গার। সে সময় তাঁর সহকর্মী পদার্থবিদ পিটার ডিবাই প্রশ্ন করেছিলেন, ইলেকট্রনগুলোকে তরঙ্গ হিসেবে ব্যাখ্যা করা গেলে তাদের ওয়েভ ইকুয়েশন বা তরঙ্গ সমীকরণ কী?

নিউটন ক্যালকুলাস আবিষ্কারের পর থেকেই ডিফারেনশিয়াল ইকুয়েশনের মাধ্যমে তরঙ্গকে ব্যাখ্যা করতে পারেন পদার্থবিদরা। ডিবাইয়ের প্রশ্নটিকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে শ্রোডিঙ্গার ইলেকট্রনের তরঙ্গের জন্য ডিফারেশিয়াল ইকুয়েশন লেখার সিদ্ধান্ত নিলেন। সে মাসে শ্রোডিঙ্গার ছুটি কাটাতে চলে গেলেন। ফিরে এলেন সেই সমীকরণ সঙ্গে নিয়ে। তাঁর কাজটি ছিল পদার্থবিজ্ঞান সমাজের ওপর প্রচণ্ড ধাক্কার মত। এতে পদার্থবিদেরা পরমাণুর ভেতর উঁকি দিতে সক্ষম হলেন। তাঁরা ইলেকট্রনের শক্তিস্তর সৃষ্টিকারী তরঙ্গ সম্পর্কে বিস্তারিত পরীক্ষা করে দেখতে পারলেন। পাশাপাশি সঠিকভাবে ভবিষ্যদ্বাণীও করা গিয়েছিল শক্তিস্তর সম্পর্কে। সেগুলো তথ্য–উপাত্তের সঙ্গে খাপে খাপে মিলেও গেল।

কিন্তু এর ফলেই এক বিরক্তিকর প্রশ্নের উদয় হলো, পদার্থবিজ্ঞান এখনো যার আস্তানা। ইলেকট্রনকে যদি তরঙ্গ হিসেবে ব্যাখ্যা করা যায়, তাহলে তরঙ্গায়িত আন্দোলন কী? উত্তর দিয়েছিলেন পদার্থবিদ ম্যাক্স বর্ন। তিনি বললেন, এসব তরঙ্গ আসলে সম্ভাবনার তরঙ্গ। এসব তরঙ্গ শুধু যেকোনো সময়ে যেকোনো জায়গায় একটি নির্দিষ্ট ইলেকট্রন খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনার কথা জানায়। অন্য কথায়, ইলেকট্রন কণাকে খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা পাওয়া যায় শ্রোডিঙ্গারের তরঙ্গের মাধ্যমে। তরঙ্গ যত বড় হবে, ওই বিন্দুতে কণাটি খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনাও ততই বাড়বে। এর মাধ্যমেই পদার্থবিদ্যার হৃৎপিণ্ডে হঠাৎ দৈব ঘটনা ও সম্ভাবনা ঢুকে গেল। অথচ আগে পদার্থবিজ্ঞান গ্রহ থেকে শুরু করে ধুমকেতু বা কামানের গোলার মতো বস্তুর গতিপথের নিখুঁত ভবিষ্যদ্বাণী করত। কিন্তু কোয়ান্টাম বলবিদ্যা নিখুঁত করে কিছু বলে না, বরং শুধু সম্ভাবনার কথা বলে।

এগুলোই অনিশ্চয়তার নীতিতে সূত্রবদ্ধ করেন হাইজেনবার্গ। এ নীতি অনুযায়ী, একই সময়ে কোনো ইলেকট্রনের নির্ভুল ভরবেগ ও অবস্থান জানা সম্ভব নয়। হাইজেনবার্গের তত্ত্বটি বৈপ্লবিক ও বিতর্কিত হলেও সেটা বেশ কাজের। এ নীতি ব্যবহার করে শুধু এই ঝাড়ুতেই রসায়নের সূত্রগুলোসহ বিপুলসংখ্যক রহস্য দূর করতে পেরেছিলেন পদার্থবিদরা। কিন্তু হাইজেনবার্গের এই নীতির কারণেই বিজ্ঞানীরা টেলিপোর্টের সম্ভাবনা অনেক দিন ধরেই উড়িয়ে দিয়েছিলেন। কারণ কাউকে টেলিপোর্ট করতে চাইলে তার দেহের প্রতিটি পরমাণুর নিখুঁত অবস্থান আপনাকে জানতেই হবে। অথচ হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তার নীতিতে তা অসম্ভব।

ঐকতানে দোলায়মান দুটি সংসক্ত ইলেকট্রন দিয়ে শুরু করা যাক। এরপর তাদের পরস্পরের বিপরীত দিকে চলে যেতে দেয়া যাক। প্রতিটি ইলেকট্রনই অনেকটা ঘূর্ণমান লাটিমের মত। প্রতিটি ইলেকট্রনের এই স্পিন বা ঘূর্ণনকে আপ কিংবা ডাউন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ধরা যাক, এই সিস্টেমের সর্বমোট স্পিন শূন্য।

আবার এ নীতি অনুযায়ী, সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানে আমাদের যা মনে হয়, কোয়ান্টাম পর্যায়ে ব্যাপারটা অন্য রকম ও অদ্ভুতুড়ে। যেমন ইলেকট্রন যেকোনো জায়গায় অদৃশ্য ও উদয় হতে পারে। আবার একই সময়ে ইলেকট্রন অনেক জায়গায় থাকতে পারে। কোয়ান্টাম তত্ত্বের গডফাদার আইনস্টাইন মৌলিক পদার্থবিজ্ঞানের মধ্যে এসব দৈবঘটনা ঢুকে পড়তে দেখে আতঙ্কিত হয়েছিলেন। সে সময় আইনস্টাইন সেই বিখ্যাত বাণী দিয়েছিলেন, ‘ঈশ্বর পাশা খেলেন না।’ এরপর পদার্থবিজ্ঞানে দৈব ঘটনা বা সম্ভাবনা দূর করতে উঠেপড়ে লাগলেন আইনস্টাইন। ১৯৩৫ সালে আইনস্টাইন এবং তাঁর সহকর্মী বোরিস পডোলস্কি ও নাথান রোজেন যৌথভাবে বিখ্যাত এক গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। এটি ইপিআর এক্সপেরিমেন্ট (তিন লেখকের নামের আদ্যক্ষর) নামে পরিচিত। কোয়ান্টাম টেলিপোর্টেশনের মূল চাবিকাঠি লুকিয়ে আছে এই গবেষণা প্রবন্ধে।

(এ অবস্থাকে বলে কোহেরেন্স বা সংসক্তি), তাহলে তাদের বড় দূরত্বে আলাদা করে রাখা হলেও তারা তরঙ্গের মতো সমলয়ে থাকতে পারে। ইলেকট্রন দুটিকে কয়েক আলোকবর্ষ দূরে আলাদা করে রাখা হলেও তাদের মধ্যে একটি অদৃশ্য শ্রোডিঙ্গার তরঙ্গ পরস্পরকে সংযুক্ত করবে বলে ধারণা করা হয়। অনেকটা মায়ের সঙ্গে সন্তানের নাভিরজ্জুর মত। একটি ইলেকট্রনে কিছু ঘটলে ওই তথ্যের কিছু অংশ সঙ্গে সঙ্গেই অন্যটিতে স্থানান্তরিত হবে। একে বলা হয় কোয়ান্টাম এনট্যাঙ্গেলমেন্ট বা কোয়ান্টাম বিজড়ন। এ ধারণামতে, সংসক্তিতে কম্পিত কণাদের পরস্পরের সঙ্গে একধরনের গভীর সংযোগ রয়েছে।

ঐকতানে দোলায়মান দুটি সংসক্ত ইলেকট্রন দিয়ে শুরু করা যাক। এরপর তাদের পরস্পরের বিপরীত দিকে চলে যেতে দেয়া যাক। প্রতিটি ইলেকট্রনই অনেকটা ঘূর্ণমান লাটিমের মত। প্রতিটি ইলেকট্রনের এই স্পিন বা ঘূর্ণনকে আপ কিংবা ডাউন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ধরা যাক, এই সিস্টেমের সর্বমোট স্পিন শূন্য। তাহলে একটি ইলেকট্রনের স্পিন আপ হলে স্বাভাবিকভাবেই অন্যটির স্পিন হবে ডাউন। কোয়ান্টাম তত্ত্ব অনুসারে, কোনো পরিমাপ বা পর্যবেক্ষণের আগে এই ইলেকট্রন স্পিন আপ বা ডাউন কোনোটাই থাকে না। বরং একটি নিম্নতম অবস্থায় থাকে, যেখানে এটি একই সঙ্গে আপ ও ডাউন উভয় স্পিনেই থাকে। মজার ব্যাপার হল, এতে কোনো পর্যবেক্ষণ  বা পরিমাপ করা হলে এর ওয়েভ ফাংশন কলাপস করবে। তাতে একটি কণা একটি নির্দিষ্ট অবস্থায় চলে আসবে।

এবার একটি ইলেকট্রনের স্পিন মাপা যাক। ধরা যাক, এর স্পিন আপ। তাহলে সঙ্গে সঙ্গেই জানা যাবে যে অন্য ইলেকট্রনের স্পিন ডাউন। অন্য ইলেকট্রনটি অনেক অনেক আলোকবর্ষ দূরে আলাদা করা থাকলেও প্রথম ইলেকট্রনের স্পিন মেপে মুহূর্তেই দ্বিতীয় ইলেকট্রনটির স্পিন সম্পর্কে জানা যাবে। আসলে আলোর চেয়েও দ্রুতগতিতে এ তথ্য জানা যাবে। কারণ ইলেকট্রন দুটি এনট্যাঙ্গেলড। অর্থাৎ তাদের ওয়েভ ফাংশন ঐকতানে কম্পিত হয়, যেন তাদের ওয়েভ ফাংশন অদৃশ্য কোনো সুতা বা নাভিরজ্জু দিয়ে সংযুক্ত। একটিতে যা কিছুই ঘটুক না কেন, স্বয়ংক্রিয়ভাবে অন্যটিতে তার প্রভাব দেখা দেবে। আইনস্টাইন একে উপহাস করে বলেছেন, ‘স্পুকি অ্যাকশন অ্যাট ডিসটেন্স’ বা দূর থেকে ভুতুড়ে কাণ্ড। এর মাধ্যমে তিনি প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন যে কোয়ান্টাম তত্ত্ব ত্রুটিপূর্ণ। কারণ, কোনো কিছুই আলোর চেয়ে দ্রুতগতিতে চলতে পারে না। মজার ব্যাপার হলো, আইনস্টাইন ইপিআর এক্সপেরিমেন্ট ডিজাইন করেছিলেন কোয়ান্টাম তত্ত্বের মৃত্যুঘণ্টা বাজাতে। কিন্তু গত শতাব্দীর আশির দশকে ফ্রান্সের অ্যালান অ্যাসপেক্ট এবং তার সহকর্মীরা ১৩ মিটার ব্যবধানে দুটি ডিটেক্টর স্থাপন করে এই পরীক্ষা চালিয়ে দেখেছিলেন। এতে পাওয়া ফলাফল নিখুঁতভাবে কোয়ান্টাম তত্ত্বের ভবিষ্যদ্বাণীর সঙ্গে মিলে গিয়েছে।

মহাবিশ্বের অন্য কোনো প্রান্তে একটি ইলেকট্রনের স্পিন ডাউন অবস্থায় আছে, এই তথ্য জানা অর্থহীন। আজকের আবহাওয়ার কোনো তথ্য বা তোমার পরীক্ষা রেজাল্টও এই পদ্ধতিতে পাঠানো যাবে না। ধরা যাক, তোমার এক বন্ধু সবসময় দৈবচয়ন ভিত্তিতে এক পায়ে লাল মোজা আর অন্য পায়ে সবুজ মোজা পড়ে। তুমি তার এক পা পরীক্ষা করে দেখলে সেই পায়ে লাল মোজা। তাহলে আলোর চেয়েও বেশি গতিতেই জানতে পারবে, তার অন্য পায়ের মোজার রং সবুজ। কাজেই দেখা যাচ্ছে, তথ্য আসলেই আলোর চেয়ে বেশি বেগে চললেও তা অর্থহীন। ননর‌্যান্ডম বা দৈবচয়নবিহীন কোনো তথ্য এই পদ্ধতিতে পাঠানো যাবে না। অনেক বছর ধরেই সমালোচকদের মুখে ছাই দিয়ে ইপিআর এক্সপেরিমেন্টকে কোয়ান্টাম তত্ত্বের মোক্ষম বিজয় হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। কিন্তু এ বিজয় আসলে অন্তঃসারশূন্য। কারণ এর কোনো ব্যবহারিক মূল্য নেই।

অবশ্য ১৯৯৩ সালের একটি ঘটনা এ ধারণায় পরিবর্তন এনেছিল। সেবার চার্লস বেনেটের নেতৃত্বে আইবিএমের বিজ্ঞানীরা প্রমাণ দেখালেন যে ইপিআর এক্সপেরিমেন্ট ব্যবহার করে কোনো বস্তুকেও সশরীরে বা আস্ত টেলিপোর্ট করা সম্ভব। আপাতত বড় বস্তুর ক্ষেত্রে না হলেও অন্তত পারমাণবিক পর্যায়ে এটা সত্যি। দেখা গেল, একটা কণার মধ্যে যতগুলো তথ্য থাকে, তার সবই টেলিপোর্ট করা সম্ভব। এরপর থেকে পদার্থবিজ্ঞানীরা ফোটন ও সিজিয়াম পরমাণুও টেলিপোর্ট করতে পেরেছেন। এ থেকে এখন ধারণা করা হচ্ছে, কয়েক দশকের মধ্যে বিজ্ঞানীরা হয়ত প্রথমবারের মতো কোনো ডিএনএ এবং ভাইরাসও টেলিপোর্ট করে দেখাতে পারবেন।

এই সফলতার পর, টেলিপোর্টেশন ব্যবস্থা উন্নত করতে বিভিন্ন দল এখন তীব্র প্রতিযোগিতায় নেমেছে। এক দল আরেকটিকে হারিয়ে চেষ্টা করছে সামনে এগিয়ে যাওয়ার। এভাবেই প্রথম ঐতিহাসিক কোয়ান্টাম টেলিপোর্টেশনের প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল ১৯৯৭ সালে। সেবার ইন্সব্রুক বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিবেগুনি রশ্মির ফোটন টেলিপোর্ট করা হয়েছিল। পরের বছর ক্যালটেকের বিজ্ঞানীরা ফোটন টেলিপোর্ট নিয়ে আরও নিখুঁত পরীক্ষা চালান। ২০০৪ সালে ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদেরা দানিয়ুব নদীর তলদেশ দিয়ে ৬০০ মিটার দূরত্বে আলোর কণা টেলিপোর্ট করতে সক্ষম হন। এতে তাঁরা ফাইবার অপটিক কেবল ব্যবহার করেছিলেন। এর মাধ্যমে তাঁরা রেকর্ড সৃষ্টি করলেও সায়েন্স ফিকশনের টেলিপোর্টের ধারেকাছেও নেই এগুলো। ২০০৪ সালে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে। সেবার কোয়ান্টাম টেলিপোর্টেশন চালানো হয় ফোটনের বদলে আস্ত একটা পরমাণু দিয়ে। এর মাধ্যমে বাস্তবসম্মত টেলিপোর্টেশনের দিকে আরও এক ধাপ এগোনো গেল। ওয়াশিংটন ডিসির ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেকনোলজির পদার্থবিদেরা সফলভাবে তিনটি বেরিলিয়াম পরমাণু এনট্যাঙ্গেলড করেছেন এবং একটি পরমাণুর ধর্ম আরেকটিতে স্থানান্তর করতেও পেরেছেন। আরেকটি বিস্ময়কর অগ্রগতি হয় ২০০৬ সালে। এবার প্রথবারের মতো এক মাইক্রোস্কোপিক বস্তুকে টেলিপোর্ট করা হয়। কোপেনহেগেনের নীলস বোর ইনস্টিটিউট এবং জার্মানির ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউটের পদার্থবিদেরা এক আলোকরশ্মির সঙ্গে সিজিয়াম পরমাণুর গ্যাসের এনট্যাঙ্গেল করতে সক্ষম হন। এতে কয়েক ট্রিলিয়ন পরমাণু ছিল। এরপর তারা লেজার পালসের ভেতরে থাকা তথ্য এনকোড করতে এবং এ তথ্যকে প্রায় হাফ গজ দূরের সিজিয়াম পরমাণুতে টেলিপোর্ট করেন। কোয়ান্টাম এনট্যাঙ্গেলমেন্ট ২০১৭ সালে চীনের একদল বিজ্ঞানী একগুচ্ছ ফোটন টেলিপোর্ট করেছেন ৩০০ মাইল দূরের একটি স্যাটেলাইটে।

এদিকে ২০০৭ সালে নতুন আরেক টেলিপোর্টেশনের কথা বলেছেন বিজ্ঞানীরা। এতে এনট্যাঙ্গেলমেন্টের প্রয়োজন নেই। এই নতুন পদ্ধতি নিয়ে গবেষণায় পথিকৃত হলেন অস্ট্রেলিয়ার ব্রিসবেনের অস্ট্রেলিয়ান রিসার্চ কাউন্সিল সেন্টার অব এক্সেলেন্স ফর কোয়ান্টাম অ্যাটম অপটিকসের পদার্থবিদ অ্যাস্টন ব্র্যাডলি। এ পদ্ধতিতে তাঁরা এমন এক রশ্মির কথা বলেন, যেখানে প্রায় ৫ হাজার কণা একটি জায়গা থেকে অদৃশ্য হয়ে যাবে এবং অন্য কোথাও সেগুলো আবার দেখা যাবে। কোয়ান্টাম টেলিপোর্টেশন থেকে আলাদা করতে ড. ব্র্যাডলি তাঁর পদ্ধতির নাম দিয়েছেন ক্ল্যাসিক্যাল বা চিরায়ত টেলিপোর্টেশন। পদ্ধতিটি কোয়ান্টাম তত্ত্বের ওপর নির্ভরশীল হলেও এনট্যাঙ্গেলমেন্টের ওপর নির্ভর করে না। অভিনব এ টেলিপোর্টেশনের মূল চাবিকাঠি হলো পদার্থের নতুন এক অবস্থা, যাকে বলে বোস-আইনস্টাইন কনডেনসেট বা বিইসি। বাংলায় বলে বোস-আইনস্টাইন ঘনীভবন। পুরো মহাবিশ্বে এটিই হলো অন্যতম শীতলতম বস্তু। এই তাপমাত্রা শুধু গবেষণাগারেই সৃষ্টি করা সম্ভব।

নির্দিষ্ট ধরনের বস্তুকে যখন পরম শূন্য তাপমাত্রার কাছাকাছি ঠান্ডা করা হয়, তখন তাদের পরমাণুগুলো সর্বনিম্ন শক্তিস্তরে ভেঙে জবুথবু হয়ে যায়। সে কারণে তাদের সব কটি পরমাণু একই ঐকতানে কম্পিত হতে থাকে এবং পরস্পর সংসক্ত বা কোহেরেন্ট হয়। সব কটি পরমাণুর ওয়েভ ফাংশন একই রকম হওয়ার কারণে এক অর্থে একটি বিইসি বিশাল একটি সুপার অ্যাটম বা অতিপরমাণুর মতো আচরণ করে। এখানে প্রতিটি আলাদা পরমাণুই ঐকতানে কম্পিত হয়। পদার্থের এই অদ্ভুতুড়ে অবস্থার কথা আইনস্টাইন এবং আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সত্যেন্দ্রনাথ বসু ১৯২৫ সালে অনুমান করেছিলেন। কিন্তু পরের ৭০ বছর এটি গবেষণাগারে বানানো সম্ভব হয়নি। অবশেষে ১৯৯৫ সালে সেটি এমআইটি এবং কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবে বানানো সম্ভব হয়। নতুন এই টেলিপোর্টেশন পদ্ধতির কিছু সমস্যা থাকলেও এর বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। তবে এর অগ্রগতির খুবই ধীরগতির। তাই টেলিপোর্টেশন এখনো পারমাণবিক পর্যায়েই রয়ে গেছে।

এসব গবেষণার পর এখন গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, বিজ্ঞান কল্পকাহিনির মতো আমরা কবে নিজেদের টেলিপোর্ট করতে পারব? চোখের পলকে কি নিজেদের টেলিপোর্ট করে স্কুল-কলেজ বা অফিস কিংবা এখানে-ওখানে ঘুরে বেড়াতে পারব? পদার্থবিদেরা এখনো আশা করেন যে জটিল অণু টেলিপোর্ট আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই সম্ভব হবে। এরপর হয়তো ডিএনএ অণু কিংবা একটি ভাইরাসও টেলিপোর্ট করা সম্ভব হবে কয়েক দশকে। সায়েন্স ফিকশন মুভির মতই সত্যিকারের কোনো মানুষকে টেলিপোর্ট করার ব্যাপারে কোনো তাত্ত্বিক বাধা না থাকলেও এ ক্ষেত্রে কঠিন সব যান্ত্রিক সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে। একটি হিসাব দিলে বিষয়টি পরিষ্কার বোঝা যাবে। হিসাবে দেখা গেছে, সামান্য এককোষী একটি E. coli ব্যাকটেরিয়ায় পরমাণুর সংখ্যা ৯x১০১০। তোমার দেহে কোষের পরিমাণ প্রায় ৩২ ট্রিলিয়ন (৩২ এর পর ১২টি শূন্য)। হিসেবটা বুঝতে সুবিধা হবে, যদি বলি, আমাদের এখন পর্যন্ত জানা মহাবিশ্বে যে পরিমাণ নক্ষত্র আছে, তার চেয়ে তোমার দেহের কোষ ৩১ দশমিক ২ ট্রিলিয়ন বেশি। একটি কোষে যদি ব্যাকটেরিয়ার সমান পরমাণু থাকে, তাহলে তোমার দেহের মোট পরমাণুর সংখ্যা নিজেই বের করো।

যুক্তরাজ্যের লেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে এক গবেষণায় দেখা গেছে, মানুষকে টেলিপোর্ট করতে গেলে তার প্রতিটি কোষকে ভেঙে ডেটায় রূপান্তর করলে তার পরিমাণ হবে প্রায় ২.৬x১০৪২ বিট। ফাইবার অপটিক কেবলে এ বিপুল ডেটা পাঠাতে দরকার অতিশক্তিশালী ব্যান্ডউইডথ আর ১০ ট্রিলিয়ন গিগাওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎশক্তি। মজার ব্যাপার হলো, এই শক্তি দিয়ে পুরো যুক্তরাজ্যে ১০ লাখ বছর বিদ্যুৎ সরবরাহ করা যাবে। আর এভাবে আস্ত একটা মানুষকে টেলিপোর্ট করতে কয়েক কোটি বছর লেগে যেতে পারে। তার চেয়ে হেঁটে যাওয়াই কি ভালো নয়?

কাজেই মানুষ বা অন্য কোনো বস্তুকে টেলিপোর্টের জন্য অন্য পথ খুঁজে বের করতে হবে। এ ব্যাপারে হাল ছাড়তে নারাজ তাত্ত্বিক পদার্থবিদ মিচিও কাকু। তার মতে, বড় বস্তু টেলিপোর্টেশন সত্যি সত্যিই কখনো সম্ভব হলেও সে জন্য কয়েক দশক থেকে কয়েক শতাব্দী কিংবা তারও বেশি সময় অপেক্ষা করতে হতে পারে। আবার মানুষ টেলিপোর্টে লাগতে পারে কয়েক শতাব্দী বা তারও বেশি সময়। কাজেই অতটা সময় অপেক্ষা না করে স্কুল-কলেজ বা বন্ধুর বাসায় যাওয়ার জন্য আপাতত হেঁটে, রিকশায় বা বাসে চাপাটাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ।

সূত্র: ফিজিকস অব দ্য ইম্পসিবল/ মিচিও কাকু ও দ্য গার্ডিয়ান ডট কম