ডিটেকটিভ প্রদোষ সি মিটার

সন্ধ্যা শশী বন্ধু।

এই নামের কাউকে চেনো নাকি? হ্যাঁ রে ভাই, এটা আসলেই একজন মানুষের নাম।

আচ্ছা দাঁড়াও, আরেকটু ‘ক্লু’ দিই। ভদ্রলোকের ভিজিটিং কার্ডে নাম লেখা হয় প্রদোষ সি মিটার। আর পাসপোর্টে লেখা হয় প্রদোষচন্দ্র মিত্র।

হ্যাঁ। ঠিক, ঠিক। জটায়ুর ফেলু বাবু, সিধু জ্যাঠার ফেলু এবং তোপসের ফেলুদা। তোমাদের, আমাদের ফেলুদা।

ফেলুদা কে?

এককথায় ফেলুদা একজন গোয়েন্দা—একেবারে স্বঘোষিত প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর। দুনিয়ার আর সব গোয়েন্দার মতো ফেলুদারও দারুণ একজন সহকারী আছে—তপেশরঞ্জন মিত্র, আমাদের তোপসে। ফেলুদার কাহিনিকে দারুণ জমজমাট করে তুলতে আর আছেন লালমোহন গাঙ্গুলি ওরফে জটায়ু।

ফেলুদার বর্ণনা তোপসে নিজেই দিয়েছে, ‘আমার বয়স চৌদ্দ আর ওর [ফেলুদার] সাতাশ। ওকে কেউ কেউ বলে আধপাগলা, কেউ কেউ বলে খামখেয়ালি, আবার কেউ কেউ বলে কুঁড়ে। আমি কিন্তু জানি ওই বয়সে ফেলুদার মতো বুদ্ধি খুব কম লোকের হয় আর ওর মনের মতো কাজ পেলে ওর মতো খাটতে খুব কম লোকে পারে। তা ছাড়া ও ভালো ক্রিকেট জানে, প্রায় এক শ রকম ইনডোর গেম বা ঘরে বসে খেলা জানে, তাসের ম্যাজিক জানে, একটু একটু হিপনটিজম জানে, ডান হাত আর বাঁ হাত দুহাতেই লিখতে জানে।...ফেলুদার যেটা সবচেয়ে আশ্চর্য ক্ষমতা, সেটি হলো ও বিলেতি বই পড়ে আর নিজের বুদ্ধিতে দারুণ ডিটেকটিভের কাজ শিখে নিয়েছে। ও হলো, যাকে বলে—শখের ডিটেকটিভ।’

ফেলুদার সম্পর্কে এসব তো জানা কথা। এ কথাও তোমাদের সবার জানা যে ফেলুদা কীভাবে  রবার্টসনের রুবী খুঁজে বের করে, কীভাবে ফেলুদা সমাধান করে ফেলে একটু জিরোর রহস্য, কীভাবে ফেলুদা সোনার কেল্লা খুঁজে পায়! 

কিন্তু ফেলুদার কথা বললে, বিশ্বাস করো, এসব গোয়েন্দাগিরির কথা আমার আগে মনে পড়ে না। ফেলুদা মানে হলো নিত্যনতুন বেড়ানোর জায়গা, রুদ্ধশ্বাস অ্যাডভেঞ্চার।

আর এই জায়গাতেই ফেলুদা অনন্য। ফেলুদা ঠিক শার্লক    হোমসের মতো চমক তৈরি করে না। মানে ও রকম ‘লজিক্যাল ডিডাকশন’ করে তোমাকে চমকে দিতে পারবে না। এমনকি বাংলায় যে বোমকেশ আছেন, তাঁর মতো করেও অনুমানবিজ্ঞানের চর্চা করে না ফেলুদা কিংবা কাকাবাবুর মতো সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে ফেলুদার অমন দাপটও নেই।

তার পরও ফেলুদা সেরা। কারণ ওই বেড়িয়ে বেড়ানোর নেশা। এবং বেড়াতে বের হয়ে ওই সব অসাধারণ সুন্দর জায়গায় রহস্যের সঙ্গে জড়িয়ে পড়া।

একেবারে শুরু থেকেই দ্যাখো। ফেলুদার শুরুটাই হয়েছিল দার্জিলিংয়ে। ১৯৬৫ সালের ডিসেম্বর মাসে দক্ষিণ কলকাতার ২১ নম্বর রজনী সেন রোড থেকে ফেলুদা সেবার ‘কাজিন’ তোপসেকে নিয়ে দার্জিলিংয়ে বেড়াতে গিয়েছিল। সেখানেই জমে উঠল প্রথম ফেলুদাকাহিনি—ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি। তখনো ফেলুদা মোটেও ‘প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর’ হয়ে ওঠেনি; হোমস, পোয়েরো পড়ে পড়ে ‘ডিটেকটিভ’ হওয়ার শখ হয়েছে মাত্র। তখন ফেলুদার বয়সও অনেক কম।

সেই বয়সেই ‘পিচ্চি’ তোপসেকে নিয়ে দিব্যি সমাধান করে ফেলল এক উড়োচিঠির রহস্য।

রহস্য তো সমাধান হলো। পাশাপাশি পাহাড়ের ওপরে, ঠান্ডা দার্জিলিং শহরটা কিংবা শহরের প্রাণ ম্যাল যেভাবে ঘুরে দেখা হলো, সেটা কি ভোলার মতো?

ওই যে শুরু, এর পর থেকে ফেলুদার ঘোরা আর গোয়েন্দাগিরির অভিযান কিন্তু একতালে চলেছে। পরের কাহিনিতেই ফেলুদা লক্ষ্‌নৌ চলে গেছে তোপসেদের পরিবারের সঙ্গে। সেখানেও এক জমজমাট রহস্য। আর এমন এক নামকরা ভ্রমণ অভিযানেই ফেলুদা আর তোপসের সঙ্গে পরিচয় হয়ে গেল কলকাতার এক জনপ্রিয় রহস্য রোমাঞ্চ লেখকের, জটায়ু।

হ্যাঁ, সোনার কেল্লা।

পূর্ব জন্মের কথা মনে করতে পারে, এমন একটা পিচ্চি ছেলের কাহিনির সূত্র ধরে ফেলুদা আর তোপসে যাচ্ছিল যোধপুর। আর সেখানেই ট্রেনের কামরাতে দেখা হয়ে গেল ‘দেখতে অত্যন্ত নিরীহ, রীতিমতো রোগা আর হাইটে তোপসের চেয়েও দু ইঞ্চি কম’ সেই জটায়ুর সঙ্গে! সেই যে দেখা হলো, সঙ্গে সঙ্গে ফেলুদার কাহিনিগুলোর রসই বদলে গেল। এর আগ পর্যন্ত ফেলুদার কাহিনিগুলো যেমন শুধু ভ্রমণ আর রহস্যে টইটম্বুর ছিল, এখন সেটা দারুণ মজারও হয়ে উঠল ওই জটায়ুর কল্যাণে।

গল্পের পাতায় জটায়ুর উপস্থিতি মানেই গড়িয়ে না পড়লেও মুচকি হাসি তোমাকে দিতেই হবে। না হেসে উপায় কী? তিনি এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা বলতে পারেন না, বলেন ব্রিটানিয়া। শুধু এই ব্রিটানিকা-ব্রিটানিয়া নয়, একটার পর একটা ইংরেজি শব্দকে এ রকম উল্টাপাল্টা করে ফেলেন তিনি। বিপদের সময় ‘ছ্যাঃ ছ্যাঃ’ করে মাথা খারাপ করে ফেলেন। প্রচণ্ড ভয়ে তার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যেতে থাকে। যেকোনো প্রাকৃতিক সুন্দর দৃশ্য দেখলেই এনথিয়াম স্কুলের বাংলার শিক্ষক বৈকুণ্ঠনাথ মল্লিকের লেখা বিকট সব কবিতা আবৃত্তি করতে শুরু করে দেন।

জটায়ুর আসলে ‘গুণ’-এর শেষ নেই। ভুলভাল করেই এই জনপ্রিয় লোকটার জীবন গেল। বলতে গেলে যেমন ভুল করেন, লেখায়ও ঢের ভুল। দিব্যি লিখে ফেলেন যে উটের জল জমা থাকে পাকস্থলীতে। কিংবা সিন্ধুঘোটককে জলহস্তী ভেবে নায়কের সঙ্গে তার ‘ফাইট’ করিয়ে দেন। আর কী সেই নায়ক প্রখর রুদ্র! একেবারে রজনীকান্ত ফেল!

কিন্তু এসব ভুলভাল করা জটায়ু না থাকলেও একেবারে যাচ্ছেতাই হয়ে যেত ফেলুদার কাহিনি। এই জটায়ুই একেক কাহিনিতে একেক অস্ত্র নিয়ে হাজির হন; দৃশ্যত যার কোনো ব্যবহার নেই, শেষ পর্যন্ত কাজে লেগে যায়। মাঝেমধ্যে অবশ্য জটায়ু আফসোস করে তোপসেকে বলেন, ‘বুঝলে ভায়া, ফেলুবাবুর  পুরোটাই মগজাস্ত্র। আমরা কিচ্ছু না।’

এটা অবশ্য একেবারে বাজে কথা। জটায়ু তো বটেই, ফেলুদার কাহিনিতে তোপসেও খুব গুরুত্বপূর্ণ লোক।

তোপসের পরিচয় নিয়ে অবশ্য একটু ভেজাল আছে। শুরুতে, মানে একেবারে ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি বইয়ে তোপসে নিজেই বলেছে, ‘ফেলুদা আমার মাসতুতো দাদা’। কিন্তু কালক্রমে সেটাকে খুড়তুতো ভাই বানিয়ে ফেলেছেন তোপসে বা সত্যজিত্। অবশ্য তোপসের জবানিতে এর ব্যাখ্যাও আছে। সে নাকি কাহিনি ‘অবিকল’ না লেখার জন্য শুরুতে মিথ্যে পরিচয় লিখেছিল। অতএব সেই খুড়তুতো, মানে চাচাতো ভাইটাই আমরা মেনে নিই। এমনিতে তোপসে আমাদের মতোই, আর দশটা ছোট ভাইয়ের মতো। বড় ভাইয়ের সঙ্গে অ্যাডভেঞ্চারে গিয়ে মজা পায়, তার কাছ থেকে টুকটাক ঝাড়ি খায়, প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে জ্ঞান পায়—এসব অভিজ্ঞতা আমাদের সবারই কমবেশি আছে। কিন্তু তোপসের আসল কৃতিত্বটা হলো ডক্টর ওয়াটসনের মতো হয়ে ওঠা। মানে, নিজে প্রায় নির্বিকার থেকে ফেলুদার প্রতিটা গল্প আমাদের লিখে লিখে জানানো।

তবে তোপসে একেবারে চুপটি করে বসে বসে ফেলুদার  কাণ্ডকারখানা দেখে, সেটা ভাবলে ভুল করবে। ফেলুদারই দেখানো পদ্ধতিতে সে দারুণ সব নোট রাখে, নিজের মতো করে পর্যবেক্ষণ করে ফেলুদার একটু কাজ এগিয়ে দেয়। ফেলুদার ফাইফরমাশমতো প্রয়োজনে জিনিসপত্রের লিস্ট বানিয়ে দেয়। কৈলাশে কেলেঙ্কারি বা জয়বাবা ফেলুনাথ-এর মতো দু-একটা কাহিনিতে জটায়ুকে নিয়ে আলাদা করে কিছু অভিযানও করে ফেলে, কিছুটা বোঝা কমিয়ে দেয় ফেলুদার ঘাড় থেকে।

তবে ফেলুদা নিয়ে আলাপ করতে বসে শুধু ফেলুদা, জটায়ু আর তোপসেতে আটকে থাকলে খুব অন্যায় হবে। আরও দুজন মানুষের কথা একটু বলতেই হয়—সিধু জ্যাঠা আর মগনলাল মেঘরাজ।

সিধু জ্যাঠা হলেন ফেলুদার ‘মাইক্রফট হোমস’। জানেন না, মনে নেই; এ রকম কথা মনে হয় সিধু জ্যাঠার অভিধানেই নেই। এমনিতেই বাড়িভর্তি সিধু জ্যাঠার হাজারো পত্রিকার খবরের কাটিং। সেগুলো বাঁধাই করে করে সাজিয়ে রেখেছেন। ফলে কোনো তথ্যের দরকার হলেই ফেলুদা ছোটে সিধু জ্যাঠার বাড়িতে। এখন এই তথ্য দেওয়াতেই তাঁর কাজ শেষ হলে সিধু জ্যাঠা তো লাইব্রেরিয়ান হয়ে যেতেন; মাইক্রফট হওয়া তাঁর হতো না।

কিন্তু অন্তত শুরুর দিকের কাহিনিতে আমরা দেখি ফেলুদার চেয়েও প্রখর ‘ডিডাকশন’ ক্ষমতা আছে এই সিধু জ্যাঠার। স্রেফ আগ্রহ নেই, গোয়েন্দাগিরিতে আলসেমি লাগে; সিধু জ্যাঠা সে জন্য নিজে গোয়েন্দা হননি। নইলে সব গুণই তাঁর ছিল।

এরপর রইলেন বাকি মগনলাল মেঘরাম; থুড়ি মেঘরাজ। ওই জটায়ু মাঝে মাঝে গুলিয়ে ফেলেন তো।

মগনলাল মেঘরাজকে বলতে পারো ফেলুদার প্রফেসর মরিয়ার্টি। সেই কাশি থেকে শুরু করে কাঠমান্ডু—মেঘরাজ হচ্ছে ফেলুদার পুরো ক্যারিয়ারে সবচেয়ে বড় ‘ভিলেন’। এর মাঝে ছোট ছোট উপস্থিতি বা পরোক্ষ ছোয়া তার বিভিন্ন কাহিনিতে পাওয়া যায়, তবে মগনলাল দুটো বইয়ে পুরোপুরি হাজির—জয় বাবা ফেলুনাথ ও যতো কাণ্ড কাঠমাণ্ডুতে।

দুই জায়গাতেই দুর্ধর্ষ এই ভিলেন ফেলুদার হাতে কাবু হয়েছে। তবে শেষ পর্যন্ত বোঝা গেছে ফেলুদাকে ঘোল খাওয়ানোর ক্ষমতা এই একটা মানুষেরই আছে।

তবে যতই মেঘরাজ হোক আর মেঘরাম; ফেলুদার সঙ্গে কি আর পেরে ওঠে? মগজাস্ত্র বলে কথা।

এই ফেলুদার মগজস্ত্রারের কথা আসলে বলে বোঝানো আমার কম্ম নয়। বরং এ নিয়ে বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করতে গেলে বিপদ। যারা ফেলুদার সব গল্প পড়েছ, তারা বলবে—আমি কিচ্ছু জানি না। আর যারা পড়োনি, তারা আমার লেখা পড়ে ফেলুদার কিচ্ছুটি বুঝতে পারবে না।

ওর চেয়ে ভালো একেবারে চোখ বন্ধ করে, না চোখ খুলে বাকি সব বন্ধ করে এক টানে ফেলুদাগুলো পড়ে ফেলো তো। এমন বেশি কিছু নয়, ৩৫টি গল্প ও উপন্যাস আছে ফেলুদাকে নিয়ে লেখা। এর বাইরে তিনটি অসম্পূর্ণ কাহিনি আছে। সবগুলো গল্প ও উপন্যাস প্রথমে প্রকাশ হয়েছে সন্দেশ ও দেশ পত্রিকায়; বিশেষ করে পুজো সংখ্যায়। পরে সবগুলো বই আকারে প্রকাশ হয়েছে। আর এখন সমগ্র আকারেও কিনতে পাওয়া যায়।

ও আচ্ছা। শেষ বেলায় ওই ফেলুদার ‘জটিল’ নামটার অর্থ বলে দিই। সন্ধ্যা শব্দের প্রতিশব্দ প্রদোষ, শশী হলো চন্দ্রের প্রতিশব্দ আর বন্ধু মানে তো মিত্র। ব্যস, প্রদোষ চন্দ্র মিত্র।

তাহলে বলো তো ‘রক্তবরণ মুগ্ধকরণ নদীপাশে যা বিঁধিলে মরণ’ কার নাম? আমি নিশ্চিত তোমরা এটা জানো না বা নিজেরা ভেবে বের করতে পারবে না, পারলে ফেলুদার উপন্যাসগুলো খুঁজে দেখতে পারো। যারা নিজেরা ভেবে বের করতে পারবে, তারা গোয়েন্দাগিরি শুরু করে দিতে পারো—প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর।