ডেনালি পর্বতে বাংলাদেশের পতাকা

আমি যে লক্ষ্যটা স্থির করি, সেটা অর্জন না করা পর্যন্ত স্বস্তিতে থাকতে পারি না। মনের ভেতর আঁকুপাঁকু করতে থাকে। তাই উত্তর আমেরিকা মহাদেশ বা আমেরিকা বলে আমরা যাকে চিনি, সেটার সবচেয়ে উঁচু পর্বত ডেনালির চূড়ায় যখন বাংলাদেশের পতাকা ওড়ানোর লক্ষ্যস্থির করলাম, সেটা আমাকে অস্থির করে তুলল। তাই নানান জোগাড়যন্ত্র শেষে একদিন চেপে বসলাম আমেরিকাগামী বিমানে। সময়টা ছিল এ বছরের জুন মাস। এটাই ২০ হাজার ২৩৭ ফুট উঁচু ডেনালি পর্বতে অভিযানের মৌসুম।

এ অভিযানে আমাদের দলে ছিল কানাডার ক্রিস্টোফার ম্যানিং, যুক্তরাষ্ট্রের রায়ান ফ্রাঙ্কোয়েস, নেপালের সুস্মিতা মাস্কে, ভারতের সত্যরূপ সিদ্ধার্থ ও বাংলাদেশ থেকে আমি। পরিকল্পনা করা হলো, ডেনালি পর্বত অভিযান হবে গাইডবিহীন। অর্থাৎ অভিযানের পাঁচ সদস্যের কেউই কোনো গাইড বা শেরপা নেব না। এভারেস্ট পর্বত বা অন্যান্য সামিট অভিযানগুলোয় যেমন সহযোগী গাইড থাকে, এই ডেনালি পর্বতেও অনেকেই এক বা একাধিক সহযোগী গাইড নিয়ে অভিযান শেষ করেন। তবে ঠান্ডা, তুষারঝড়, উইন্ডচিলের মতো অন্য ব্যাপারগুলো পর্বতারোহণে যে কেমন প্রভাব ফেলতে পারে, তা হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া শুরু করলাম কোনো গাইড ছাড়াই এই অভিযান শুরুর পর থেকেই।

পাঁচজনের বড় দলটা দুটি ছোট দলে ভাগ হয়ে গেলাম ডেনালি পর্বত অভিযানে। প্রথম তিনজন থাকলেন সুস্মিতা মাস্কের দলে। আর আমরা পরের দুজন থাকলাম ডেনালি পর্বতে বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী অভিযানের অংশ হিসেবে। বাংলাদেশ থেকে অভিযানে রওনা দেওয়ার আগে ভারতীয় হাইকমিশনের সহায়তায় ইন্দিরা গান্ধী সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এই বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী অভিযানের ঘোষণা দেওয়া হলো। বাংলাদেশে ভারতের ডেপুটি হাইকমিশনার সন্দ্বীপ চক্রবর্তী এবং ভারতীয় হাইকমিশনের কাউন্সিলর সুজিত ঘোষ অভিযাত্রীদের হাতে অভিযানের স্মারক পতাকা তুলে দিলেন। বরাবরের মতো এবারের অভিযানেও পর্বতারোহণের সরঞ্জাম দিয়ে সহায়তা করল ইয়ংওয়ান বাংলাদেশ।

এ অভিযানে প্রথম গন্তব্য ছিল যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কা। বিমান থেকেই দেখছিলাম আকাশে কয়েক স্তরে মেঘের ভেলার ওপর মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা আলাস্কা পর্বতমালা। একদিকে সূর্য ঢলে পড়েছে। পশ্চিম দিগন্তে সূর্যাস্তের লালিমা। তবে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো উত্তর গোলার্ধের কাছাকাছি এই ভূখণ্ডে সূর্য একেবারে ডুবছে না—অন্তত বছরের এই সময়ে। সূর্য ডোবার কারণে যে একেবারে নিকষ অন্ধকারে ডুবে যাওয়ার কথা, তা হচ্ছে না। চারদিকে সূর্য ওঠার আগে বা সূর্য অস্ত যাওয়ার পর যেমন একটা আবছা অন্ধকার থাকে, সেই আলো-আঁধারি লেগেই আছে।

আলাস্কার অ্যাংকোরেজ থেকে ডেনালি অভিযানের বৈধতাপত্র সংগ্রহের পর চললাম সেখানকার একেবারে ছোট্ট একটা এয়ারপোর্টে। আয়তনে মহাখালী বাসস্ট্যান্ডের চেয়েও হয়তো ছোটই হবে। সেখানে শেলডান এয়ার সার্ভিসেস-এর অফিসে ঢুঁ মারলাম। সেখানে লেখা: ‘নেভার, নেভার, নেভার গিভ আপ’ (কখনোই হাল ছেড়ে দিয়ো না)। কথাগুলো মনের মধ্যে গেঁথে নিলাম, ডেনালি পর্বত অভিযানে পা দেওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে।

ডেনালি পর্বতের চূড়ায় দলের অন্যদের সঙ্গে বাংলাদেশের পতাকা হাতে আমি

এখান থেকে চালকসহ পাঁচজন বসা যায়—এমন বিমানে করে কাহিলিতনা গ্লেসিয়ারে যখন হাজির হয়েছি, তখন রাত সাড়ে আটটা। কিন্তু আমাদের দেশের দুপুরের মতো আলো চারদিকে। আশ্চর্য হয়ে গিয়েছি এই পরিস্থিতি দেখে। এই গ্লেসিয়ার সব রং শুষে নেয়। দূরে রঙিন পোশাকের যেকোনো পর্বতারোহীকে দেখে মনে হয় কালো একটা বিন্দু তার গন্তব্যে এগিয়ে চলেছে।

এখানে যেমন পেঁজা তুলার মতো তুষার পড়ে, তেমনি বাতাসের সঙ্গে বয়ে চলা ক্ষুদ্র তুষার-শলাকা অনেক সময় চোখে-মুখে বিঁধে যায়। ঠান্ডার তীব্রতা, তুষারঝড়, হিমবাহে ফাটল বা ক্রেভাসে পতন, অ্যাভেলান্সের তীব্রতা ইত্যাদি সব মিলিয়ে ডেনালি পর্বতকে প্রাণহন্তারক বা বিশ্বের অন্যতম ভয়ংকর পর্বত হিসেবেও বিবেচনা করা হয়। ১৯০৬ সাল থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত প্রায় ৩২ হাজার পর্বতারোহী এই পর্বতে অভিযানে অংশ নিয়েছেন। তবে তাঁদের মধ্যে সফল হয়েছেন মাত্র ৫০ শতাংশ।

সাত মহাদেশের সাতটি সর্বোচ্চ পর্বতচূড়ায় যে অভিযান, তাকে বলা হয় সেভেন সামিট। এই সাতটি সর্বোচ্চ পর্বতচূড়ার মধ্যে উচ্চতার দিক থেকে ডেনালি পর্বতের অবস্থান ৩ নম্বরে—এভারেস্ট আর অ্যাকোঙ্কাগুয়াই শুধু এগিয়ে আছে। ডেনালি পর্বত ও তার চারদিকে আবহাওয়ার কোনো নির্দিষ্ট চরিত্র নেই। প্রতিমুহূর্তে রং বদলায়। ঝকঝকে রোদ দেখে বোঝার উপায় নেই যে ঘণ্টা খানেক পরই কোনো ধরনের তুষারঝড় অপেক্ষা করছে। এখানে সর্বোচ্চ ১৫০ মাইল বেগে তুষারঝড়ের রেকর্ড আছে।

প্রায় আট দিন ধরে গ্লেসিয়ারের ওপর দিয়ে চলে পিঠে ব্যাগ তো বটেই, কোমরে স্লেজ বেঁধে তা সাত হাজার ২০০ ফুট উঁচু বেস ক্যাম্প থেকে টেনে ১৪ হাজার ২০০ ফুট পর্যন্ত পঞ্চম ক্যাম্পে নিয়ে

গিয়েছি। তুষারঝড়, বরফের ফাটল, প্রচণ্ড ঠান্ডা উপেক্ষা করে ২৪ থেকে ৩৬ ঘণ্টা পরপর একবার করে খাবার খেয়েছি। তবে শেষে যখন বেস ক্যাম্প থেকে প্রায় ১৩ হাজার ৩৭ ফুট উচ্চতা পার হয়ে আট দিনের মাথায় ২৩ জুন ২০১৪ তারিখের স্থানীয় সময় রাত আটটা ১০ মিনিটে ডেনালি পর্বতের চূড়ায় পৌঁছেছি, সব কষ্ট ছাপিয়ে গেছে সেখানে বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা ওড়ানোর আনন্দে।

(কিশোর আলোর নভেম্বর ২০১৪ সংখ্যায় প্রকাশিত)