সে এক সাংঘাতিক ব্যাপার! দস্যুর দল রণডঙ্কা বাজিয়ে লুট করতে আসছে রাজধানী। চুপচুপ করে লুকিয়ে লুকিয়ে নয়, একেবারে প্রকাশ্যে ঢাকঢোল পিটিয়ে। ভাবা যায়? হ্যাঁ, অবিশ্বাস্যই বটে, তবে মিথ্যে নয় একরত্তিও। এমন ঘটনা সত্যি সত্যিই ঘটেছিল এবং তা আমাদের এই ঢাকাতেই! ঘটেছিল মোগল আমলে, ১৬২৫ খ্রিষ্টাব্দে। ঢাকা তখন বাংলার রাজধানী। আর বাংলার সুবাদার, অর্থাৎ প্রাদেশিক শাসক ছিলেন খান-ই-দুরান।
সেকালে পর্তুগিজ ও মগ জলদস্যুরা প্রায়ই বাংলার দক্ষিণাঞ্চলের নদীতীরবর্তী এলাকায় হামলা চালিয়ে লুটপাট করত, বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিত, আর লোকজনকে ধরে নিয়ে গিয়ে দাস বানিয়ে বিক্রি করে দিত ফরাসি, ওলন্দাজ ও ইংরেজদের কাছে। বাংলা থেকে ধরে নিয়ে দাস বানিয়ে বিক্রি করে দেওয়া মানুষকে দূর ইউরোপে পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হতো। ফরাসি বিপ্লবে এমন একজন বাঙালি দাসের বীরত্বের কথাও ইতিহাসের পাতায় লেখা আছে সোনার অক্ষরে। যা-ই হোক, সে সময় মিয়ানমারের আরকান এলাকায় বাস করত মগ ও পর্তুগিজ জলদস্যুরা। তারা একবার লুট, অগ্নিসংযোগ ও মানুষ হত্যা করতে করতে এগিয়ে আসতে লাগল রাজধানী ঢাকার দিকে। তারা হই-হাঙ্গামা করতে করতে বুক ফুলিয়ে আসছিল। তাই ঢাকা নগরে বসবাসকারী সুবাদার সেনাপতি, উজির-নাজির, সৈন্যসামন্ত সবার জানা ছিল ব্যাপারটা। কিন্তু সুবাদার ছিলেন খুবই ভিতু লোক। সাহস বলতে কিছুই ছিল না তাঁর। তাই লুটেরা বাহিনীকে পর্যুদস্ত করে বন্দী করা, বা নিদেনপক্ষে তাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টাও করলেন না ভীতসন্ত্রস্ত সুবাদার। দস্যুদের হাতে রাজধানী ছেড়ে দিয়ে সৈন্যসামন্ত নিয়ে তিনি পালিয়ে নিজের জান বাঁচালেন। শুধু তা-ই নয়, কাছাকাছিও কোথাও থাকলেন না। লটবহর নিয়ে পালিয়ে গেলেন সেই রাজমহলে।
এখন যেটা বাংলার বাইরে এবং ভারতের অন্তর্গত পাহাড়ি এলাকায়। ওই ঘটনা ঘটার ১৫ বছরের মধ্যেই ১৬৪০ খ্রিষ্টাব্দে মানরিক নামের এক বিদেশি ঢাকায় এসেছিলেন। তিনি ঢাকার ওই মগ-পর্তুগিজ আক্রমণের বেশ লম্বা বর্ণনাই দিয়েছেন। সেই বর্ণনা অনুযায়ী, ৭০টি গোলিওটাস ও ৫০০ গেলিয়াস নৌবহর নিয়ে মগদের বিরাট বাহিনী ঢাকা আক্রমণ করেছিল। সেই দলে পর্তুগিজরাও ছিল। তাই ওই হামলা শুধু মগদের নয়, পর্তুগিজদেরও ছিল। ঢাকা পর্যন্ত তারা প্রায় বিনা বাধায় এসেছিল। মগ-পর্তুগিজদের হামলা ও গোলার আওয়াজে কিছু রণতরি পর্যন্ত ফেলে রেখে পদাতিক বাহিনীর সঙ্গে মিলে মোগল নৌসেনারাও পালিয়ে গেল। কেউ কেউ অবশ্য মগদের প্রতিরোধ করার কথা ভেবেছিল। তবে শেষ পর্যন্ত তাদের কেউই টিকে থাকেনি। মানরিকের বর্ণনা অনুযায়ী মাত্র এক ঘণ্টার মধ্যে মুঘল সেনাদলের সবাই পালিয়ে যায়। মগ-পর্তুগিজরা কোনো রকমের বাধা ছাড়াই তাদের জাহাজ থেকে নামল ঢাকার মাটিতে। তারপর? তারপর আর কী? যা হওয়ার তা-ই হলো। মহাবীর সুবাদারের প্রাসাদ, ধনী লোকদের বাড়িঘর সবখানে তারা ইচ্ছেমতো লুটতরাজ করল। এভাবে রাজধানী দখল করে অনেক ধনরত্ন তারা পেল তারা। কিন্তু পালানোর সময় মুঘল বাহিনী একটু বুদ্ধি খরচ করেছিল। তারা সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল রাজকীয় কোষাগারের ধনরত্ন। তাই লুটেরাদের হাত থেকে রক্ষা পেল সেগুলো। ঢাকা শহরে সেই দফায় দস্যুরা ছিল তিন দিন। এই তিন দিনে ঢাকাকে তারা ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে ছাড়ল। সুবাদারের প্রাসাদ মিশিয়ে দেওয়া হলো ধুলোর সঙ্গে। বাড়িঘর লুট করার পর সেগুলো আগুনে পুড়িয়ে তারা করল ছাই। শহরে থেকে যাওয়া বাসিন্দাদের ওপর চালানো হলো নির্মম নির্যাতন। এককথায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করল তারা। অবশেষে দস্যুর দল জাহাজ বোঝাই করে লুটের মাল নিয়ে ঢাকা ছেড়ে চলে গেল।
এই কাপুরুষতার কথা জানতে পেরে দিল্লির সম্রাট জাহাঙ্গীর ভীষণ রেগে গেলেন। তিনি এই সুবাদারকে পদচ্যুত করে ১৬২৬ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি মাসে মুকাররম খানকে নতুন সুবাদার হিসেবে নিয়োগ দিলেন।
ঢাকা: রেকর্ড অব চেঞ্জিং ফরচুনস (আহমদ হাসান দানি, বঙ্গানুবাদ: আবু জাফর, ২০০৫, পৃ: ২৪,২৫), বাংলা একাডেমি ঐতিহাসিক অভিধান (মোহাম্মদ মতিউর রহমান, ২০০৪, পৃ: ১৮৩), বাংলাদেশ জেলা গেজেটীয়ার বৃহত্তর ঢাকা (১৯৯৩, পৃ: ৭৪) ও ঢাকা অভিধান (খন্দকার মাহমুদুল হাসান, ২০০৪, পৃ: ১৪৫) প্রভৃতি গ্রন্থে ঘটনাগুলোর বর্ণনা আছে।