১২ অক্টোবর ২০১৩, সকাল আটটা। বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় ‘ফাইলিন’ নিয়ে উপকূলজুড়ে আতঙ্ক। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে সাগর উত্তাল। আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে জারি করা হয় ২ নম্বর সতর্কসংকেত। নিরাপদ দূরত্বে থাকার জন্য সাগরে মাছ ধরার জেলে ও উপকূলের মানুষজনকে সতর্ক করা হচ্ছে। কিন্তু এই সতর্কবাণী উপেক্ষা করে সাগরের জলরাশি ভেঙে ঘুরে বেড়াচ্ছে একদল উচ্ছল ছেলেমেয়ে। এরা হচ্ছে সার্ফার গোলাপ শাহ (১৪), নাহিদা আকতার (১৭), আমেনা খাতুন (১৪), সামিরা আকতার (১৬), জিয়াউল হক (৮), আবদুল মান্নান (৮) এবং আরও অনেকে। বালুচরে দাঁড়িয়ে পর্যটকেরা শিশু-কিশোরদের এই জলক্রীড়া দেখে সত্যিই মুগ্ধ।
কক্সবাজার শহরের সমুদ্রপারের গ্রাম দক্ষিণ বাহারছড়া। এই গ্রামে জন্ম দুরন্ত মেয়ে গোলাপ শাহর, যে কিনা একটু আগে সার্ফবোর্ড নিয়ে উত্তাল সমুদ্র ঘুরে বেড়াচ্ছিল। ফাঁকে ভ্রমণে আসা বিদেশি নারী পর্যটকদের সার্ফিং শেখানোর কাজটাও সেরে ফেলছে নিমেষে।
শহরের পৌর প্রিপারেটরি উচ্চবিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্রী গোলাপ শাহ বলে, ‘শখের বশে এই জগতে আসা। বিদেশি পর্যটকদের সার্ফিং করতে দেখে নিজেরও সার্ফার হওয়ার ইচ্ছা জাগে। ছয় বছর আগে জাফর আলম স্যারের “সার্ফিং বাংলাদেশ” ক্লাবের সদস্য হলাম। তারপর সার্ফবোর্ড নিয়ে সমুদ্রে ঝাঁপ দিলাম। এক মাসের মাথায় পাক্কা সার্ফার হয়ে গেলাম। এখন সার্ফবোর্ড নিয়ে পুরো সমুদ্র ঘুরে বেড়ানো কোনো ব্যাপারই না।’
গোলাপ শাহর সঙ্গে সার্ফিং করছে নাহিদা, আমেনা, সামিরা, জিয়াউল, মান্নানসহ অন্তত ১০ জন শিশু-কিশোর।
শহরের ঘোনারপাড়ার জিয়াউল স্থানীয় ঘোনারপাড়া বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র। সে বলে, ‘বাবা-মা রাজি না হলে এ সুযোগ পেতাম না। সার্ফিং করে আয় করার পরিবেশ এখনো হয়নি। তবে সার্ফিং করে একদিন বিশ্বরেকর্ড করার ইচ্ছা আছে।’
শহরের নুনিয়াছটা ফিশারিঘাট এলাকার মেয়ে নাহিদা সার্ফিং করছে ১১ বছর ধরে। নাহিদা বলে, ‘টেলিভিশনে বিদেশি মেয়েদের সার্ফিং দেখে উত্সাহিত হই। তারপর সার্ফিং শিখতে ভর্তি ওই সার্ফিং ক্লাবে। এখন সকাল-বিকেল সার্ফিং না করলে ভালো লাগে না।’
নাহিদার ইচ্ছা, বিশ্ব জলরাশি জয় করে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ছিনিয়ে আনা। বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের সুনাম ছড়িয়ে দেওয়া।
নাহিদার আরেকটি গুণের কথা সবার জানা। সেটা হচ্ছে, সার্ফবোর্ডে কুকুর তুলে সমুদ্র ঘুরে বেড়ানো। এতে পর্যটকেরা বেশি আনন্দ পান।
এ প্রসঙ্গে সবার ওস্তাদ বাংলাদেশের প্রথম সার্ফার জাফর আলমের বক্তব্য হচ্ছে, ‘আমি আমেরিকার হাওয়াই দ্বীপ, ইন্দোনেশিয়ার বালি, ভারতের গোয়াসহ বিভিন্ন দেশের সমুদ্রসৈকতে গিয়ে সার্ফিং করেছি। দেখেছি বিশ্বের বাঘা বাঘা সার্ফারের কীর্তিকাণ্ড। কিন্তু সার্ফবোর্ডে কুকুর তুলে সার্ফিং করার দৃশ্য কোথাও দেখিনি। এ ক্ষেত্রে কক্সবাজার ব্যতিক্রম।’
জাফর আলমের সার্ফিং ক্লাবের বর্তমান সদস্যসংখ্যা ৩২। এর মধ্যে শিশু-কিশোরের সংখ্যা ২৫ জন, যার চারজন মেয়ে।
সকাল আটটা-বেলা একটা এবং বিকেল চারটা-সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত সৈকতের কলাতলী পয়েন্টে সার্ফিং করা হয়।
গত ১১ অক্টোবর সকালে কলাতলী পয়েন্টে গিয়ে দেখা গেছে, ছেলেমেয়েদের পাশাপাশি নয়জন বিদেশিও সার্ফিং শিখছেন। তাঁরা এসেছেন জাপান, অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স ও ইংল্যান্ড থেকে। জাফর তাঁদের সার্ফিং শেখাচ্ছেন।
এ ব্যাপারে জাফর বলেন, ২০০৫ সাল থেকে এ পর্যন্ত তিনি চার হাজারের বেশি বিদেশিকে এই সৈকতে সার্ফিং শিখিয়েছেন। এর মধ্যে নারীর সংখ্যা তিন হাজার। ২০০২ সালে তিনি নিজের ঘরেই প্রতিষ্ঠা করেন সার্ফিং প্রশিক্ষণ ক্লাব। বাংলাদেশে এ রকম ক্লাব আর নেই। স্থানীয় লোকজনকে বিনা পয়সায় সার্ফিং শেখানো হলেও বিদেশিদের বেলায় দৈনিক ৫০০ টাকা দিতে হয়। ওই টাকায় কিনতে হয় সার্ফবোর্ড। সাত দিনের মধ্যে সার্ফিং শেখানো সম্ভব।
অস্ট্রেলিয়ার তরুণ ব্রেড হগ (২৬) ও ইংল্যান্ডের তরুণী লিন্ডা (৩১) বলেন, এত দূরে এসে সার্ফিং শেখার অর্থ হলো, কক্সবাজারের এই সৈকতে স্রোত কম, পানিও থাকে গরম। তা ছাড়া প্রবাল পাথর আর হাঙরের উত্পাত নেই। ঢেউ খুব বড় নয়। সার্ফিং শেখার জন্য এ রকম নিরাপদ সৈকত পৃথিবীর কোথাও নেই।
সার্ফার জাফর বলেন, প্রতিবছর কক্সবাজার সৈকতে অনুষ্ঠিত সার্ফিং প্রতিযোগিতায় অংশ নিচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ভারত, জাপান ও ইন্দোনেশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অন্তত ৩০ জন সার্ফার। বিদেশিদের দেখে স্থানীয় ছেলেমেয়েরা সার্ফিং শিখতে আসে। কিন্তু অর্থসংকটের কারণে বাংলাদেশের কোনো সার্ফার বিদেশে গিয়ে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারে না। ফলে এ ক্ষেত্রে প্রতিভার বিকাশ হচ্ছে না। তাই ক্লাবের সদস্যসংখ্যাও কমে যাচ্ছে। সার্ফিং বাদ দিয়ে অনেকে বিকল্প আয়ের পথ বেছে নিচ্ছে। মেয়েদের বিয়ের পর সার্ফিং বন্ধ হচ্ছে। সার্ফিংয়ের মাধ্যমে আয়রোজগার অথবা জীবন-জীবিকার বিকল্প ব্যবস্থা নিশ্চিত করা গেলে বাংলাদেশ হতে পারে আন্তর্জাতিক সার্ফিং উত্সবের অনন্য স্থান।