তক্ষকবনে একদিন

অন্ধকার উঠোন। আকাশে নক্ষত্রের আলো। উঠোনের ওপর দিয়ে একটু পর পর হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। একটা তক্ষক ডাকছে। তক্ষকের ডাক বন্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অসংখ্য ঝিঁঝিপোকা ডেকে উঠছে। ঝিঁঝিপোকা থামতেই তক্ষক ডেকে ওঠে। তক্ষকেরা চুপ করতেই ডাকে ঝিঁঝিপোকা। অদ্ভুত কনসার্ট।

প্রায় ২০ বছর আগে হুমায়ূন আহমেদের বৃহন্নলা উপন্যাসের এই অনুচ্ছেদটি আমার ভেতরে তক্ষক সম্পর্কে অপার আগ্রহ জাগিয়ে তুলেছিল। হয়তো তক্ষক নিয়ে পরে আলাদা করে আর ভাবা হয়নি, কিন্তু মন থেকে তক্ষক ডাকার এই গল্প কিছুতেই যায় না। তবে তক্ষকের চেহারাটা কিছুতেই কল্পনায় আসে না। তক্ষক উচ্চারণ করলেই মনে আসে রাক্ষস খোক্কস জাতীয় ভয়ংকর কিছুর কল্পনা।

হঠাৎ গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে ব্লগে তক্ষক নিয়ে জনৈক সুকান্তের একটা লেখা পড়লাম।... তক্ষক! তক্ষক চাই! যেকোনো দামে তক্ষক চাই! যেভাবেই হোক তক্ষক চাই! বাংলাদেশের কিছু মানুষ যেন তক্ষকের জন্য পাগল হয়ে গেছে। তাদের এটা চাই-ই! একটা পেলে তারা এটা কোটি কোটি টাকায় বিক্রি করবে! এক দিনে বড়লোক হবে। রঙিন ফানুস ওড়াচ্ছে ওরা। কোথায় বিক্রি করবে, কার কাছে বিক্রি করবে, সেই সম্পর্কে যদিও তাদের কোনো ধারণাই নেই। তার পরেও তারা ছুটছে তো ছুটছেই।

খাগড়াছড়ি, বান্দরবান, রাঙামাটি থেকে মধুপুর হয়ে সুন্দরবন পর্যন্ত তারা ছুটছে। এখন তারা তাদের গন্তব্য ঠিক করেছে মণিপুর, মেঘালয়, আসামসহ ভারতের পাহাড়ি রাজ্যগুলোকে। সেখানেও এখন তক্ষকের ধোঁয়া! আর সেই ধোঁয়ায় হাওয়া দিচ্ছে আমাদের দেশের তক্ষকের নেশায় নেশাগ্রস্ত কিছু মানুষ! এদের অধিকাংশই বয়সে তরুণ। কাজ-কাম বাদ দিয়ে নিজের পকেটের টাকা খরচ করে এরা এখন ভারতমুখী। আশা! যদি একটা পাই তাহলেই কোটিপতি!—অনেক দিন পর আবার মনের মধ্যে জেগে উঠল ২০ বছর আগের ঘুমন্ত তক্ষক। কোটিপতি হওয়ার জন্য নয়, আমাদের দেশে এমন দুর্লভ একটি প্রাণী আছে—একবার নিজের চোখে দেখতে পাব না! এই আফসোস মন থেকে যায় না। ঝিঁঝিপোকার সঙ্গে তক্ষকের কনসার্ট না শুনতে পারলেও একনজর দেখতে পেলেও নয়ন দুটি সার্থক হতো। এবার তক্ষক নিয়ে একটু খোঁজ নিতে লাগলাম।

বহুল আলোচিত তক্ষক হচ্ছে গিরগিটি প্রজাতির একটি প্রাণী। বৈজ্ঞানিক নাম Gekko gecko

পিঠের দিক ধূসর, নীলচে-ধূসর বা নীলচে বেগুনি-ধূসর। সারা শরীরে থাকে লাল ও সাদাটে ধূসর ফোঁটা। পিঠের সাদাটে ফোঁটাগুলো পাশাপাশি সাত-আটটি সরু সারিতে বিন্যস্ত। কম বয়সী তক্ষকের লেজে পর পর গাঢ়-নীল ও প্রায় সাদা রঙের বলয় রয়েছে। মাথা অপেক্ষাকৃত বড়, নাকের ডগা চোখা ও ভোঁতা। চোখ বড় বড়, মণি ফালি গড়নের। লেজ সামান্য নোয়ানো। দৈর্ঘ্য নাকের ডগা থেকে পা পর্যন্ত ১৭ সেন্টিমিটার এবং লেজও প্রায় ততটা। তক্ষকের ডাক চড়া, স্পষ্ট ও অনেক দূর থেকে শোনা যায়। ডাকের জন্যই এই নাম। কক্ কক্‌ আওয়াজ দিয়ে ডাক শুরু হয়, অতঃপর ‘তক্-ক্কা’ ডাকে কয়েকবার ও স্পষ্ট স্বরে। এরা কীটপতঙ্গ, ঘরের টিকটিকি ছোট পাখি ও ছোট সাপ খেয়ে থাকে। ছাদের পাশের ভাঙা ফাঁকফোকর বা গর্তে অথবা গাছে বাস করে। ব্যাপক নিধনই বিপন্ন হওয়ার কারণ। অনেকে ভুলক্রমে তক্ষককে বিষাক্ত সরীসৃপ হিসেবে চিহ্নিত করে। দেশি চিকিৎসায় এদের তেল ব্যবহৃত হয়। ভারত ও বাংলাদেশসহ মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, লাওস, কাম্পুচিয়া, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, চীন, ফিলিপাইনসহ বিভিন্ন দেশে প্রায় ৬০০ প্রজাতির তক্ষকের বাস।

তক্ষক সম্পর্কে সবকিছু জেনে আগ্রহটা আরও বেড়ে গেল। কিন্তু আশপাশে তক্ষকের খোঁজ কেউ বলতে পারেন না।

হঠাৎ গত জানুয়ারি মাসে রাজশাহী বন্ধুসভার সাবেক সভাপতি ও রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক ফিজার আহমেদ তাঁর গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানালেন। তাগাদা দিয়ে বললেন, এক মাস পরেই তিনি দেশের বাইরে চলে যাবেন। এলে এক্ষুনি আসতে হবে। তাঁর বাড়ি নওগাঁর ধামইরহাট উপজেলায়। ফিজারের ভাষায় সেখানকার বন বিট কর্মকর্তা লক্ষ্মণ চন্দ্র ভৌমিক একজন গাছপাগল মানুষ। তিনি গাছ লাগিয়ে উপজেলাটিকে প্রায় পর্যটনকেন্দ্রের কাছাকাছি নিয়ে গেছেন। চোখে না দেখলে বিশ্বাস হবে না। চলে আসেন। শুনেই রাজশাহী বন্ধুসভার বর্তমান সভাপতি ফারুক হোসেন সঙ্গে যাওয়ার জন্য বায়না ধরলেন।

১৭ জানুয়ারি শীতের সকালে আমরা লক্ষ্মণ ভৌমিকের ছিলিমপুর বাঁশবনে ঢুকেছি। কলম থেকে কীভাবে বাঁশ হয়েছে—দেখে বিস্মিত হচ্ছি। ২৬ একরের বাঁশবনের ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে লক্ষ্মণ ভৌমিক বললেন, দাদা, যাওয়ার সময় আলতাদিঘিটা দেখে যাবেন। সেখানেও সংরক্ষিত বন রয়েছে। কিন্তু সব শেষ করে সেই দিঘিতে যেতে হলে রাজশাহীর বাস ধরা নিয়ে সময়ের টান পড়তে পারে—এই ভেবে দোনোমনা করছিলাম। এ সময় খুব স্বাভাবিকভাবেই লক্ষ্মণ ভৌমিক বললেন, চলেন না, কপালে থাকলে তক্ষকও দেখতে পাবেন। তক্ষক! এবার আমার চক্ষু চড়কগাছ। ২০ বছর আগের সেই তক্ষক-ঝিঁঝিপোকার কনসার্ট মনের মধ্যে বেজে উঠল। কোটিপতি হওয়ার লোভে যে তক্ষকের পেছনে উপমহাদেশের একশ্রেণির মানুষ পাগলের মতো ছুটছে। সেই তক্ষক এখানে! একেবারে নাগালের মধ্যে! অবিশ্বাস নিয়ে তাঁর দিকে তাকালাম। লক্ষ্মণ ভৌমিক বললেন, দাদা, একটি নয়, ১১টি তক্ষক আছে এই বনে। শুনে মাথা খারাপ হওয়ার অবস্থা। আর কোনো কথা নয়, এবার ছুটলাম আলতাদিঘি। সেখানে ঘোরার জন্য ফিজার ভাই আগেই একটি মাইক্রোবাস ঠিক করে রেখেছিলেন। সঙ্গে স্থানীয় কয়েকজন সাংবাদিক।

সংরক্ষিত বনের ভেতর দিয়ে আঁকাবাঁকা রাস্তা। মাঝেমধ্যে বন পাহারাদারদের সুন্দর গোলঘর। রং করা। দেখলেই মনে হচ্ছে, গাড়ি থামিয়ে একটু বসে যাই। যেতে যেতে লক্ষ্মণ ভৌমিক বললেন, ভারতে পাচারকালে তাঁরা এই ১১টি তক্ষক আটক করেছিলেন। পাচারকারীদের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। আর তক্ষকগুলো এই বনে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। ওরা প্রায়ই আলতাদিঘির পারের এই গাছগুলোতে থাকে।

সেখানে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন বন পাহারাদার আতিয়ার রহমান। যেতেই আতিয়ার বললেন, কিছুক্ষণ আগেই ওদের ডাক শুনলাম। আছে আশপাশে। ভাগ্য ভালো হলে দেখতে পাবেন। আতিয়ার ইতিউতি করে খুঁজতে লাগলেন। আর আমরা তাঁর পিছে পিছে হাঁটতে লাগলাম। না, না, এগাছে নেই। ওগাছে নেই করে আতিয়ার হাঁটছেন। হঠাত্ আধমরা একটা আকাশমণিগাছের কাছে দাঁড়িয়ে গেলেন তিনি। সোজা আঙুল তুলে বললেন, ‘ওই যে। ওই যে আমি দেখতে পাচ্ছি। গাছের কোটরের মধ্যে।’ কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি না। এবার আতিয়ার হু করে একটা আওয়াজ করলেন। সঙ্গে সঙ্গে কোটরের ভেতর থেকে বেরিয়ে এল একটি তক্ষক। আতিয়ার বললেন, ডাক শুনতে হলে আপনাদের অপেক্ষা করতে হবে। আরেক প্রহরে একসঙ্গে ১১টি তক্ষক ডেকে উঠবে। সেই প্রহর পর্যন্ত আমাদের আর থাকার সময় হলো না।