ভূতের খবর জানে না কেউ কে বলেছে ভাই? এই শোনো না কত ভূতের খবর বলে যাই! আগেই বলে নিই, ভূত বলে আসলে কিছু নেই। ভূত থাকে মনে। তারপরও গা ছমছম করা কোনো সন্ধ্যায় বেলতলা দিয়ে হেঁটে গেলেই হয়তো দেখতে পারতে, গাছের ডালে খড়ম পায়ে উবু হয়ে বসে গুড়ুক গুড়ুক করে হুঁকোতে তামাক খাচ্ছে ব্রহ্মদত্যি। ইয়া বড় বড় দাঁত, গলায় মোটা পইতা, মাথার লম্বা টিকিতে গাঁদা ফুল ঝোলানো। ভয় না পেয়ে উপায় থাকে! ন্যাড়া মাথা হলে বেলতলায় না গিয়ে শ্যাওড়াতলায় গেলেও হয়, ওখানেও মাঝেমধ্যে ভুঁড়িওয়ালা ব্রহ্মদত্যিরা আস্তানা গড়ে থাকে।
ব্রহ্মদত্যির তুলনায় বেশ স্লিম আর রোগাপটকা গেছো ভূত সড়াৎ করে সুপারিগাছের মাথায় উঠে মেজাজে পা দোলায় আর গাছের নিচে দিয়ে রাতে কেউ গেলেই পায়ের বুড়ো আঙুলের ফাঁকে চেপে ধরে। এত জোর এরা পায় কোথা থেকে কে জানে?
তালগাছের মতো খাড়া আর এক ঠেঙ্গা লম্বা, এক মাথা ঝাঁকড়া চুল আর কপালের ঠিক মাঝখানে একটাই গোল চোখ অন্ধকারে ধক ধক করে জ্বলে। শাকচুন্নি নামেই পরিচিত এরা। আমিও এদের খুব ভয় পাই, ভাগ্যিস দেখা হয়নি কখনো, তাহলে এ লেখাটা আমি না, অন্য কেউ লিখত।
লাল-কালো চৌকো কাটা গামছা গায়ে বিল অথবা জলাতে লম্বা লম্বা পা ফেলে পুঁটি মাছ ধরে সেগুলোকে কাদায় পুঁতে রাখে। তারপর মাছগুলো পচে গেলে খায়। পুঁটি মাছ এদের খুব প্রিয়, ফ্রিজের নাম শুনলেই এদের খেপে যাওয়ার কথা। এদের সামনে মাছের ব্যাগসহ পড়ে গেলে, মাছ না দিলে রক্ষা নেই। নিশ্চয়ই এতক্ষণে বুঝে গেছ, মেছো ভূতের কথাই বলছি। তবে যে ভূতটার নিজে কিছু করা লাগবে না, দেখলেই তোমার খবর হয়ে যাবে, তার নাম স্কন্ধকাটা ভূত। এদের মাথা নেই, চোখ দুটো বুকের মধ্যে, সন্ধ্যার পর যখন-তখন বাঁশবনের ধারের রাস্তা দিয়ে দৌড়ায় বাচ্চাদের ধরার জন্য। মাথা নেই বলে যে বুদ্ধি নেই, তা নয়। সুযোগ পেলে ঠিক ধরে নেবে। মনে হয় হাঁটুতে বুদ্ধি থাকে এদের।
আর পেতনি সন্ধ্যাবেলা বাড়ির আনাচকানাচে ঘুরে থেকে থেকে খোনা গলায় পান্তাভাত খেতে চায়। তার পান্তাভাতই চাই, রোস্ট পোলাও তো নাই, পিৎজা, বার্গারেও কাজ হবে না। আরেকটা ভয়ংকর ব্যাপার হচ্ছে, তুমি যদি ছেলে হয়ে থাকো, আর এরা কোনো কারণে তোমাকে পছন্দ করে ফেললে বিপদই আছে। এরা তখন আর কাজির জন্যও অপেক্ষা করবে না, সোজা ঘাড় ধরে উঠিয়ে নিয়ে ঠিক বিয়ে করে ফেলবে তোমাকে!
এসব ভয়ংকর ভূত ছাড়াও এ দেশে আছে বোতল ভূত। এই ভূতটিকে আমাদের চিনিয়েছেন কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ। সহজ-সরল পোষা ভূত। অনুরোধ করলেও এরা কারও ক্ষতি করবে বলে মনে হয় না। পুষে দেখতে পারো। তবে শখের বসেই পোষা, কোনো কাজে আসবে না।
জলা ভূত পরিচিত ভূতের মধ্যে অন্যতম, নাম শুনেই বুঝতে পারছ, এরা জলের ভূত। স্থলে তেমন দেখা যায় না। ভালো সাঁতার পারার কথা, অনায়াসে বাংলাদেশের হয়ে অলিম্পিকে সোনা জিততে পারত। কিন্তু দুঃখের বিষয়, ভূতের জন্য অলিম্পিকে কোনো ইভেন্টই নেই।
ভাগ্যিস খুনি মানুষ দেখা গেলেও মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে ইদানীং আর কোনো খুনি ভূত দেখা যায় না। তবে খুনি ভূত আছে; আছে একচোখা ভূত। এদের চোখে লাগানোর মতো চশমা বানানো হয় না বলেই মনে হয় অভিমান করে এরা দেশ থেকে একেবারেই কমে গেছে। বিলুপ্তপ্রায় এমন সব ভূতকে রক্ষার জন্য সরকারেরও তেমন কোনো উদ্যোগ চোখে না পড়ায় ভূত বিশেষজ্ঞরা হতাশ।
এ দেশের সব ভূতই আঁধার ভালোবাসে, তবে আঁধি ভূত মনে হয় আঁধারকে অন্যদের চেয়েও একটুখাটি বেশি ভালোবাসে। স্বাধীনতার পর অনেকগুলো আদমশুমারি হলেও একটাও ভূতশুমারি হয়নি। যদি হতো তাহলে দেশে কী পরিমাণ ভূত আছে, তা বেরিয়ে আসত। এদের সুরক্ষায় সরকারি-বেসরকারি নানা উদ্যোগ নেওয়া যেত।
টিভিতে যে ছোট্ট সুন্দর ভূত ক্যাসপারকে দেখ, সে বাচ্চাদের সঙ্গে খেলতে আর মজা করতে ভালোবাসে। আজকাল টিভিতে আর গল্প কমিকেই তোমরা এসব ভূতকে দেখ। বাস্তবে দেশি ভূত তো সহজে তোমরা দেখতে পাওই না, কটা টিভি বা বইয়েই-বা দেশি ভূত থাকে! শহরে মাঝেমধ্যে পুরোনো বাড়িতে ভূতের খবর পাওয়া যায় বটে, কিন্তু একটু থিতু হওয়ার আগেই ডেভেলপারদের ভয়ে বেচারিদের পালিয়ে যেতে হয়।
তার ওপর বেড়ে গেছে নকল ভূতের উপদ্রব—তারা ফোন করে বিকাশে চাঁদাবাজি করে। এ থেকে বাঁচতে ভূতদের দাবি হলো ভূতের গায়ে আসল ভূতের হলোগ্রামযুক্ত লোগো দেখলে তবেই কেবল ভয় পাবেন, না হলে ভয় পাওয়ার কোনো দরকার নেই। কে শোনে কার কথা! সত্যিই ভূতদের দিনকাল আজকাল খুবই খারাপ যাচ্ছে—ওদের আর থাকার বিশেষ জায়গা নেই, নেই ঘোরাফেরা করার উপায়ও। অনেকে তাদের জন্য দেশের বিভিন্ন জায়গায় অভয়ারণ্য করে দেওয়ার পক্ষে মত দিয়ে বেড়াচ্ছেন।