ধরো, তোমার একটি টাইম মেশিন আছে...

মনে করো তোমার পকেটে একটা ছোট্ট টাইম মেশিন আছে। সেটা দিয়ে তুমি সময়ের যেকোনো অংশে পাড়ি জমাতে পারো। তুমি চাইলেই এই করোনার প্রকোপকে পেছনে ফেলে চলে যেতে পারো ভবিষ্যতে। আবার চাইলে পেছনে ফিরে যেতে পারো, যখন কিনা তুমি স্কুলের বন্ধুদের সঙ্গে টিফিনের ফাঁকে লুকোচুরি খেলতে। টাইম মেশিনে ভেসে ইতিহাসের স্মরণীয় সব ঘটনা দেখে আসতে পারতে নিজের চোখে। আবার যুদ্ধের অসহায় মানুষদের বাঁচাতে পারতে, রক্ষা করতে পারতে কালজয়ী কিছু মানুষের প্রাণ, যাঁদের হত্যা করেছে আততায়ীরা। তবে সময়ের কোন অংশে তুমি যেতে চাইবে আর গিয়ে কী করবে, সেটা কিন্তু পুরোটাই তোমার বিবেচনা। তাহলে এবারের পর্বে জেনে নেওয়া যাক, কী হবে যদি তোমার একটি টাইম মেশিন থাকে?

টাইম মেশিন বানানো সম্ভব কি না, সেটা নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে আছে নানা রকম ব্যাখ্যা। কেউ কেউ আবার এমন যন্ত্র বাস্তবে অসম্ভব বলেও দাবি করেছেন। পদার্থবিজ্ঞানীরা বিভিন্ন তত্ত্বের কথা জানিয়েছেন সময়ের এই পরিক্রমাকে পাড়ি দেওয়ার। কেউ কেউ বলেন, সময়ের গণ্ডিকে উতরে যেতে ছুটতে হবে আলোর গতিতে। আবার অনেক গবেষকের দাবি, কৃষ্ণগহ্বরে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারলেই দেখা মিলবে সময় পাড়ি দেওয়ার উপায়ের, যার কোনোটিই এখনো বাস্তবে সম্ভবপর হয়ে ওঠেনি। তবে এবার আমাদের ধরেই নিতে হবে যে তোমার নিজের টাইম মেশিনে বসে তুমি সময়কে পাড়ি দিয়ে ইচ্ছেমতো যেতে পারছ অতীত-ভবিষ্যতের সীমারেখায়।

টাইম মেশিনে ভেসে তুমি পৌঁছে যেতে পারো মানবসভ্যতার ইতিহাসের সব যুগান্তকারী সময়ে। হয়তো তুমি ঘুরে আসতে পারো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের রণক্ষেত্র থেকে। আবার অযাচিতভাবেই তুমি হয়তো থামিয়ে দিতে পারতে জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকির পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণ। তোমাকে কেউ বিশ্বাস করত কি না, সেটা অন্য ব্যাপার। হয়তো তুমি বাঁচাতে পারতে অনেক প্রাণ।

তবে এতটা দায়িত্ববান না হলে তুমি হয়তো শুধু ঘুরেফিরেই চলে আসতে পারতে। যুদ্ধ শেষে সৈন্যদের উৎসবের মধ্যে থেকে উপভোগ করতে পারতে। ঘুরে আসতে পারতে প্রাচীন সব নগরী থেকে। ১৮ শতকের প্যারিস, বার্লিন কিংবা জার্মানির স্থানীয় নাগরিকদের সঙ্গে কথা বলতে পারতে। যদিও ভাষাগত সমস্যায় আটকে যাওয়ার সুযোগ আছে সেখানে। সময়কে পাড়ি দিয়ে তুমি অংশ নিতে পারতে বিটলসের কনসার্টে। উপভোগ করতে পারতে ডিজনি কার্টুনের প্রথম সব আয়োজন।

সময় পাড়ি দিয়ে এত আনন্দ নিয়ে তুমি এবার হয়তো পথ ধরতে তোমার নিজের সময়ে ফিরে আসার। কিন্তু এখানেই তৈরি হতে শুরু করত সব বাধাবিপত্তি। তুমি ফিরে এসে দেখতে যে তোমার চারপাশের শহরের কাঠামো বদলে যাচ্ছে। হয়তো ধ্বংস হয়ে গেছে অনেক কিছু। চারদিকে রেডিয়েশন আর বোমা বিস্ফোরণ। তোমার চারপাশের এই পরিস্থিতিকে বলা হচ্ছে অ্যাপোক্যালিপস। এটাকে ব্যাখ্যা করা যায় আমেরিকান গণিতবিদ এডওয়ার্ড লরেঞ্জের ‘বিশৃঙ্খলা তত্ত্ব’–এর সাহায্যে। বিশৃঙ্খলা তত্ত্ব বলছে, কোনো ছোট সামান্য পরিবর্তন সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে সমান মাত্রায় বড় প্রভাব ফেলতে পারে। এটার উদাহরণে বলা যায়, জুরাসিক সময়ের কোনো প্রজাপতির ডানা নাড়ানো বাতাসের প্রভাব আমাদের এখনকার সময়ের বিশাল টর্নেডো তৈরি করতে পারে। তার মানে কিন্তু এটা নয় যে প্রজাপতির ডানার বাতাসে টর্নেডো হয়; বরং এখানে বোঝানো হয়েছে যে অতীতের কোনো পরিবর্তনের প্রভাব ভবিষ্যতেও ঘটতে পারে। সেটা খুব সামান্য হতে পারে কিংবা বড় পরিমাণে। কিন্তু অতীতের পরিবর্তনের প্রভাব ভবিষ্যতের স্পেস ও সময়ে প্রভাব ফেলবেই।

সময়কে পাড়ি দিয়ে তুমি অংশ নিতে পারতে বিটলসের কনসার্টে। উপভোগ করতে পারতে ডিজনি কার্টুনের প্রথম সব আয়োজন।

এটার একটা বাস্তবধর্মী উদাহরণ হতে পারে যুক্তরাষ্ট্রের রেলগাড়ি–সেবার। সেখানে রেলগাড়িগুলো প্রস্থে ৪ ফুট ৮ ইঞ্চির কাছাকাছি। কেন এই বিশেষ মাপ ধরে রেলগাড়ি বানানো হলো? কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের একেবারে শুরুর দিকে যাঁরা রেলগাড়ি বানাতেন, তাঁরা ছিলেন ওয়াগন নির্মাতা। ওয়াগন হলো ঘোড়াচালিত বিশেষ গাড়ি। ইংল্যান্ডে এটির বিশেষ প্রচলন ছিল। ঘোড়া যেন স্বস্তি নিয়ে ওয়াগনের মাঝে দাঁড়িয়ে গাড়ি টানতে পারে, তাই এই মাপে বানানো হতো ওয়াগন। এমনকি তখন রাস্তাও বানানো হতো দুটো ওয়াগন যেন পাশাপাশি স্বাভাবিকভাবে চলতে পারে, সেটা মাথায় রেখে। সেই ঘোড়ার গাড়ির আকার ধরেই তৈরি হয় যুক্তরাষ্ট্রের পুরো রেলব্যবস্থা। মাইলের পর মাইল বানানো রেললাইন বসানো হয় এ আকারে। তাই চাইলেই চট করে কেউ রেলগাড়ির আকারে পরিবর্তন আনতে পারবে না। বোঝাই যাচ্ছে যে অতীতে করা কোনো কাজ কিংবা নেওয়া কোনো সিদ্ধান্ত সময় ঘুরে ভবিষ্যতেও প্রভাব রাখতে পারে।

তাই অতীত ভ্রমণে গেলেও সেখানকার কার্যক্রমে সরাসরি অংশগ্রহণ না করাই শ্রেয়। চারপাশে থেকে বরং উপভোগ করতে পারো সময়টাকে। আর অতীত ভ্রমণ শেষে তুমি বর্তমানে ফিরতে চাইলেও একেবারে যে সময়ে যাত্রা শুরু করেছিলে, সেখানে ফিরতে পারবে না। কারণ, বর্তমানের সময়কাঁটা ঘুরতে থাকবে তোমাকে ছাড়াই।

তাই তোমার একটি টাইম মেশিন থাকলেও সময়কে পাড়ি দেওয়ার কাজে থাকতে হবে সচেতন। হতেই পারে এই লেখাটি পড়া শেষ করতেই তোমার সামনে হাজির হয়ে গেল অতীত থেকে আসা কোনো টাইম ট্রাভেলার।

সূত্র: ইনিশ ডটকম