ধাঁধা থেকে জন্ম যার

অনেক আগে এক দেশে ছিলেন এক জ্ঞানী ব্যক্তি। তাঁর নাম চিসা। একদিন তিনি নতুন একটি খেলা আবিষ্কার করলেন; নাম দিলেন চতুরঙ্গ।

সে দেশের রাজা শেহরামকে খেলাটি দেখালেন চিসা। রাজা রীতিমত মুগ্ধ। এমন বুদ্ধির খেলাই তো খুঁজছিলেন তিনি। তাই খুশিতে গদগদ হয়ে তিনি পুরস্কার হিসেবে চিসাকে যা ইচ্ছে চাইতে বললেন।

জবাবে বুদ্ধিমান চিসা বললেন, ‘আমি খুব সাধারণ মানুষ। আভিজাত্য, অট্টালিকা কিংবা সোনাদানা-টাকাপয়সায় আমার লোভ নেই। শুধু সারা জীবন পেট পুরে খেতে চাই। তাই রাজামশাই, এই খেলনার ছকে যতটুকু শস্য আঁটে সেটুকু দিলেই আমি খুশি।’

শুনে রাজা কিছুটা ক্ষুব্ধ হলেন। বললেন, ‘মাত্র এটুকু! তুমি কি আমাকে অপমান করতে চাইছ?’

‘না, রাজামশাই। আমার কথা শেষ হয়নি। আগে বলুন, আপনার দেওয়া প্রতিশ্রুতি আপনি পূরণ করবেন।’

গর্জে উঠে রাজা বললেন, ‘হ্যাঁ, অবশ্যই।’

‘তাহলে, চতুরঙ্গের প্রথম বর্গক্ষেত্রে মাত্র একটি শস্য দেবেন। তার পরের বর্গক্ষেত্রে প্রথমটির চেয়ে দ্বিগুণ। তৃতীয় বর্গক্ষেত্রে দ্বিতীয়টির দ্বিগুণ...এভাবে পুরো ৬৪টি বর্গক্ষেত্র পূরণ করবেন দয়া করে। এটুকু দিলেই চলবে।’

লোকটিকে বোকার হদ্দ ভেবে রাজা হো হো করে এক চোট হেসে নিলেন। ভাবলেন, এ আর এমন কী।

কিন্তু তাঁর হাসি বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। কারণ, লোকটিকে দেয়া কথা তিনি শেষপর্যন্ত রাখতে পারলেন না। পারবেন কীভাবে, তাঁর কাছে তো ওই পরিমাণ শস্য ছিল না!

যারা এটুকু পড়েছ, তারা নিশ্চয়ই ওই রাজার মতোই ভুরু কুঁচকে ভাবছ, এ আর এমন কী! কিন্তু পুরো ব্যাপারটা শুনলে তোমার চোখ কপালেও উঠে যেতে পারে। সে কথায় আসছি। প্রায় কিংবদন্তির মতো এ ধরনের বেশ কয়েকটি কাহিনি প্রচলিত আছে। তার মধ্যে একটি সংস্করণ বর্ণিত হয়েছে পারস্যের কবি ফেরদৌসীর বিখ্যাত শাহনামায়। তাই সোহরাব-রুস্তমের মতো এ গল্প সত্যি নাকি কিংবদন্তি তা নিয়ে গবেষকেরাও সন্দিহান। তবে গল্পটির উৎস যে ভারতে, সে ব্যাপারে নিশ্চিত অনেকে। কারণ, তথ্য-প্রমাণ বলে, চতুরঙ্গ বা দাবার জন্ম ভারত উপমহাদেশে। অনেকের ধারণা, খ্রিষ্টীয় ৬ষ্ঠ শতকের দিকে অর্থাৎ প্রায় দেড় হাজার বছর আগে গুপ্ত শাসনামালে ভারতে দাবা চালু হয়। তখন এর নাম ছিল চতুরঙ্গ (সংস্কৃত চতু মানে চার আর অঙ্গ মানে অংশ)। তখন দাবায় হাতি, ঘোড়া, রথ ও পদাতিক সৈন্য—এ চারটি অংশ ছিল। তাই এমন নাম।

বিশ্বের প্রথম দাবা চ্যাম্পিয়ন উইহেলম স্টেইনিজ

চতুরঙ্গ থেকে আধুনিক দাবা হয়ে উঠতে অনেক সময় আর দেশ পাড়ি দিতে হয়েছে। শুরু থেকেই এটা বুদ্ধিমানের খেলা হিসেবেই বেশি পরিচিত। ৬৪ ঘরের এ খেলায় যথেষ্ট বুদ্ধি আর কৌশলের প্রয়োজন। তাই বুদ্ধির পরীক্ষা দিতে সে যুগেও বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছিল চতুরঙ্গ। সে যুগে ভারতের সঙ্গে আরব ও পারস্যের (বর্তমানে ইরান) বাণিজ্যিক যোগাযোগ ছিল। তাই বণিকদের হাত ধরে চতুরঙ্গ পারস্যে চলে যেতে সময় লাগেনি। সেখানে এর নতুন নাম হয় শতরঞ্জ। প্রায় একই সময় ভারত থেকে খেলাটা চীনযাত্রা করে। চীনারা এর নামকরণ করে জিয়ানকুই।

১২ শতকে পারস্যের বাদশাহ সালাউদ্দিনের শাসনামলে ইউরোপের ক্রুসেডাররা জেরুজালেম রক্ষার নামে দলে দলে ভিড় জমায় আরব ও পারস্যে। দীর্ঘদিন সেখানে থাকতে থাকতে তারা সেখানকার অনেক কিছুই আমদানি করতে থাকে ইউরোপে। এভাবে শতরঞ্জও ইউরোপে পাড়ি জমায়। আবার স্পেনে মুসলিম মুর শাসনামলে শতরঞ্জ ইউরোপসহ রাশিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে বলে ধারণা অনেকের। এখানেও সে নতুন নাম পায় ‘চেস’, যা পুরোনো ফরাসি ভাষা 'বপযবপ' (অর্থ চেক) থেকে উদ্ভূত। আসলে এই চেস শব্দটি এসেছে ফার্সি শাহ (রাজা বা বাদশা) শব্দ থেকে। শুধু নামেই নয়, খেলাটার আরও অনেক কিছুই পরিবর্তিত হয়। এখানেই খ্রিষ্টীয় ক্যাথলিক ধর্মের প্রভাবে দাবায় বিশপ (ভারত ও বাংলাদেশে হাতি বা গজ নামেও পরিচিত) যুক্ত হয়। আরও পরে যোগ হয় রানি।

পরে ইউরোপিয়ানদের মাধ্যমে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে আর জনপ্রিয় হয়ে ওঠে দাবা। ১৯২৪ সালে দ্য ফেডারেশন ইন্টারন্যাশনাল ডেস চেস (এফআইডিই) গঠিত হয়। তারা দাবা খেলার আন্তর্জাতিক নিয়মকানুন নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণ করে। এ সংস্থা আন্তর্জাতিক দাবা প্রতিযোগিতার আয়োজক। দক্ষতার ওপর ভিত্তি করে এফআইডিই খেলোয়াড়দের ইন্টারন্যাশনাল মাস্টার ও গ্র্যান্ডমাস্টার হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। যেসব খেলোয়াড় প্রতিযোগিতায় সবার সেরা হয় তারাই গ্র্যান্ডমাস্টার। হয়তো অনেকেই জানো, বাংলাদেশ থেকে বেশ কয়েকজন এই খেলায় আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছেন। নিয়াজ মোর্শেদ বাংলাদেশের প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার। গত শতাব্দীতে দাবা খেলায় কম্পিউটারের ব্যবহার একে আরও জনপ্রিয় ও আলোচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত করেছে। ১৯৯৬ সালে আন্তর্জাতিক গ্র্যান্ডমাস্টার গ্যারি কাসপারভ দাবা খেলেন ডিপ ব্লু নামের এক কম্পিউটারের সঙ্গে। সেবারই প্রথমবার মানুষের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড়ায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তথা যন্ত্র। সেবার ডিপ ব্লুর সঙ্গে দাবা খেলায় কাসপারভ জিতে যান। ঠিক পরের বছর তিনি হেরে যান ডিপ ব্লুর কাছে। যন্ত্রের কাছে হারের এ ঘটনা বিশ্বে আলোচনার জন্ম দিয়েছিল।

দাবা খেলা বিষয়ে ১২৮৩ সালে ইউরোপে প্রকাশিত একটি বইয়ের পৃষ্ঠা

এখন রাজা শেহরাম আর চিসার কাছে ফেরা যাক। হিসাব করে দেখা যাক, চিসার শর্ত অনুযায়ী, ৬৪টি বর্গক্ষেত্রে ঠিক কী পরিমাণ শস্যকণা থাকতে পারে। হিসাবমতে, ৬৪তম বর্গক্ষেত্রে গম বা শস্যের পরিমাণ হবে ২৬৩টি (অর্থাৎ ২-এর ওপর পাওয়ার বা ঘাত ৬৩)। কারণ, প্রথম ঘরটিতে ছিল একটি শস্য। দ্বিতীয়টিতে ২টি, তৃতীয়টিতে ৪টি বা ২২ (২-এর ঘাত ২) চতুর্থটিতে ৮টি বা ২৩...এভাবে ৬৪তম বর্গক্ষেত্রে ২৬৩ (২-এর ঘাত ৬৩)।

তাহলে, পুরো দাবার বোর্ডে শস্যকণার পরিমাণ হবে ২৬৪-১টি। অর্থাৎ ২-কে ৬৪ বার গুণ করে, তা থেকে ১ বিয়োগ করতে হবে। কারণ প্রথম ঘরে শস্যকণার পরিমাণ ১টি। দ্বিতীয় ঘরে ২টি। তাহলে প্রথম ও দ্বিতীয় ঘরে মোট শস্যকণা হবে ১ + ২ = ৩ বা ২২ - ১টি, এভাবে প্রথম থেকে তৃতীয় ঘরে ১ + ২ + ৪ = ৭টি বা ২৩ - ১টি, প্রথম চার ঘরে ১ + ২ + ৪ + ৮ = ১৫টি বা ২৪- ১টি, এভাবে প্রথম থেকে ৬৪তম ঘরে ২৬৪ - ১টি।

হিসেবে পাওয়া যায়, ২৬৪ - ১ = ১৮,৪৪৬,৭৪৪,০৭৩,৭০৯,৫৫১, ৬১৫। অর্থাৎ চিসাকে মোট ১৮,৪৪৬,৭৪৪,০৭৩,৭০৯,৫৫১, ৬১৫টি শস্যকণা দিতে হবে।

মজার ব্যাপার হচ্ছে, এ পরিমাণ শস্যকণা রাজা শেহরামের কাছে কেন, পুরো পৃথিবীতেই নেই। সে সময় রাজকর্মচারীরা কয়েক দিন হিসাব করে রাজা শেহরামকে বলেছিলেন, চিসাকে ওই পরিমাণ শস্য দিতে হলে, পুরো দুনিয়ার সব জমিকে খেত বানাতে হবে। তাই শেষ পর্যন্ত চিসাকে দেওয়া কথা রাখতে পারেননি রাজা। এ কাহিনির আরেক সংস্করণে (শাহনামায় নয়) দেখা যায়, এ অক্ষমতার জ্বালা মেটাতে নাকি চিসাকে শেষ পর্যন্ত হত্যা করেছিলেন রাজা।

অবশ্য তিনি দিতে পারলেও সেটি গুনে বুঝে নেওয়াও চিসার জন্য অনেক বড় ঝক্কির কাজ হতো। হিসাবমতে, চিসা যদি সারা দিনরাত শুধু শস্যদানা গুনে যেতেন আর সেকেন্ডে যদি একটি দানা গুনতে পারতেন, তাহলে প্রথম দিনে তিনি মাত্র ৮৬ হাজার ৪০০টি দানা গুনতে পারতেন। এভাবে নাওয়া-খাওয়া ভুলে সারা দিন শুধু শস্যদানা গুনে গেলে তাঁর লাগত প্রায় ৫৮ হাজার কোটি বছরের বেশি (৫৮৪,৯৪২,৪১৭,৩৫৫ বছর)। আর এ পরিমাণ শস্যকণা রাখতে চাইলে, ৪০ কিলোমিটার লম্বা, ৪০ কিলোমিটার চওড়া আর ৩০০ মিটার উঁচু গোলাঘর বানাতে হবে। হিসেব বলে, এ শস্য ধান হলে তার পরিমাণ হবে ৪৬১,১৬৮,৬০২,০০০ মেট্রিক টন। এ ধানের স্তূপ হিমালয়ের সর্বোচ্চ চূড়া মাউন্ট এভারেস্ট থেকেও উঁচু হবে। এটি ২০১০ সালে সারা বিশ্বে উৎপাদিত ধানের চেয়েও এক হাজার গুণ বেশি। কারণ, সেবার বিশ্বে ধান উৎপাদন হয়েছে ৪৬৪,০০০,০০০ মেট্রিক টন। কাজেই মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।

সূত্র: চেসডটকম ও উইকিপিডিয়া