ননসেন্স ও সুকুমার

যে কথার কোনো মানে নেই, সে আবার কেমন কথা? লোকে বলে, সব কথা ও কাজেরই একটা মানে থাকা চাই। পুরো পৃথিবী ও সভ্যতা নাকি দাঁড়িয়ে আছে কার্যকারণ সূত্রের ওপর। কারণ ছাড়া অনর্থক কোনো কিছুই ঘটে না।

মানুষ ভাষা আবিষ্কার করলই তো অর্থপূর্ণ ভাব আদান–প্রদানের জন্য। মানুষ কেন এই পৃথিবীতে, তার অস্তিত্বের কারণ, তথা মানে কী—সেটার উত্তর কেউ খোঁজে বিজ্ঞানে, কেউ দর্শনে, কেউবা আবার ধর্মশাস্ত্রে। কোপারনিকাস, গ্যালিলিও, নিউটন, আইনস্টাইন, সক্রেটিস, প্লেটো, অ্যারিস্টটল তো জনমভর এ করেই গেলেন!

এর মধ্যে ‘মানে নেই’ কথাটা এল কী করে? কিন্তু প্রায় দেড় শ বছর আগেই এসেছিল কথাটা। তখন ইউরোপের সাহিত্যে ঘোষণা করা হয়েছিল, সব কথার ‘সেন্স’ থাকতে হবে, এরই বরং কোনো মানে নেই। ননসেন্স বা অসম্ভবের সাহিত্য শুরু হলো তখন থেকে।

অবশ্য তার আগে ননসেন্স যে একেবারেই ছিল না, তা নয়। বিশেষ করে, লোকসাহিত্য, রূপকথা আর পৌরাণিক কথায়। লোককথায় গল্পের গরু আকাশে উড়তে পারে, বিশাল হাতিকে টেনে নিতে পারে একদল পরিশ্রমী পিঁপড়া। রূপকথায় জিয়নকাঠি-মরণকাঠি ছুঁইয়ে রাজকন্যাকে জীবিত-মৃত করা যায়, কিংবা ভোমরার প্রাণ বধে মারা যায় ইয়া বড় রাক্ষস আর তার ভাই খোক্ষসকে। রামায়ণে আছে, হনুমান গন্ধমাদন নামের এক বিশাল পর্বত বয়ে উড়েছিল কয়েক শ মাইল। এ সবই মজাদার, তবে উদ্ভট, অসম্ভব, ননসেন্স।

আধুনিক সাহিত্যে ননসেন্সের কোনো স্থান ছিল না। আধুনিক সাহিত্য মানে বড়দের সাহিত্য। মূলত রহস্য, রোমাঞ্চ আর রোমান্স—বড়দের সাহিত্যভাবনায় এই তিন অনেক বড় জায়গাজুড়ে আছে। তবে এ–ও ঠিক, ছোটদের জন্যও বড়রা লিখেছেন। তবে ঈশপকেই তাঁরা গুরু ধরেছিলেন। তাঁদের লেখায় কল্পনার বিস্তার আছে, কিন্তু সেগুলো ভরপুর নীতিকথা আর হিতোপদেশের।

ব্রিটিশ সাহিত্যিক এডওয়ার্ড লিয়র উনিশ শতকের চল্লিশের দশকে লিখলেন বুক অব ননসেন্স বইটি। এই প্রথম শিশুরা সাহিত্যে পেল এক নিয়মছাড়া দেশের খোঁজ। এমন মোহিনী শিশুসাহিত্য শিশুদের মুক্ত পৃথিবীর ধারণা দেয়। কল্পনায় এমন একটি দেশেই তো আমরা যেতে চাই। আমরা তার নামও দিয়ে দিয়েছি—ইউটোপিয়া।

ননসেন্সকে দুনিয়াভর জনপ্রিয় করার পেছনে সবচেয়ে বড় হাত সম্ভবত লুই ক্যারলের। ১৮৬৫ সালে তিনি অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড নামের যে অদ্ভুত ও উদ্ভট উপন্যাসটি লিখেছিলেন, তা আজও ছেলে-বুড়ো সবার কাছে জনপ্রিয়। নানা কমিকস, কার্টুন আর সিনেমার কল্যাণে সেটার জনপ্রিয়তা আরও বেড়েছে।

ইংরেজিতে যেমন ক্যারল, বাংলায় তেমন সুকুমার রায়। তিনি বাংলা ননসেন্স সাহিত্যের রাজকুমার। তবে শুধু ননসেন্স নয়, সুকুমার তাঁর সাহিত্যে ছোটদের জন্য এমন এক বিচিত্র জগৎ গড়ে গেছেন, তার আনন্দ থেকে যে বঙ্গশিশু বঞ্চিত হয়েছে, দুর্ভাগাই বলতে ভবে তাকে।

পরশু রাতে পষ্ট চোখে দেখনু বিনা চশমাতে,
পান্তভূতের জ্যান্ত ছানা করছে খেলা জোছনাতে।
কচ্ছে খেলা মায়ের কোলে হাত-পা নেড়ে উল্লাসে,
আহ্লাদেতে ধুপধুপিয়ে কচ্ছে কেমন হল্লা সে।

(‘ভুতুড়ে খেলা’, আবোল তাবোল)

সুকুমারের উদ্ভট ছড়ায় ভূতপ্রেতও হয়ে ওঠে অনেক কাছের কেউ। তবে আমরা শুনে এসেছি, তারা ভয়ানক। পেতনি, শাকচুন্নি আর উল্টোবুড়িকে কে না ভয় পায়? তাদের ভয় দেখিয়েই বাবা-মা কত বাচ্চাদের মুখে খাবার তুলে দিয়েছেন (এখনো হয়তো দেন)। অথচ সুকুমারের ছড়ায় এদের দেখে হেসে লুটোপুটি হওয়া ছাড়া উপায় কী?

চাঁদনি রাতের পেতনীপিসি সজনেতলায় খোঁজ্‌ না রে—
থ্যাঁৎলা মাথা হ্যাংলা সেথা হাড় কচাকচ্‌ ভোজ মারে।
চাল্‌তা গাছে আল্‌তা পরা নাক ঝোলানো শাঁকচুনি
মাক্‌ড়ি নেড়ে হাঁকড়ে বলে, আমায় তো কেউ ডাঁকছনি!
মুণ্ডু ঝোলা উলটোবুড়ি ঝুলছে দেখ চুল খুলে,
বলছে দুলে, মিন্‌সেগুলোর মাংস খাব তুলতুলে।

(‘হ য ব র ল’, হ য ব র ল)

শুধু পদ্যে নয়, গদ্যেও সমানতালে ননসেন্সের চর্চা করে গেছেন সুকুমার। ‘হ য ব র ল’ তাঁর ননসেন্স সাহিত্যের অন্যতম সেরা কীর্তি। এই গল্পে হিজিবিজবিজ নামের এক অদ্ভুত প্রাণীর কথা আছে, সে দেখতে মানুষ না বাঁদর, প্যাঁচা না ভূত, ঠিক বোঝা যায় না। এবং তার কাজ হচ্ছে কেবল হাসা। সারা দিন সে কেবল হেসেই চলে। সে হাসি যেমন–তেমন নয়, হাত-পা ছুড়ে নাড়ি-ভুঁড়ি সব ফেটে যাওয়ার দশা হয় প্রায়।

প্রফেসর হিজিবিজবিজ

একদিন এক খোকা জিজ্ঞেস করে হিজিবিজবিজকে, এত হাসি পায় কেন তার? সে খোকাকে বলে, ‘মনে করো, পৃথিবীটা যদি চ্যাপ্টা হতো, সব জল গড়িয়ে ডাঙায় এসে পড়ত, আর ডাঙার মাটি সব ঘুলিয়ে প্যাচপ্যাচে কাদা হয়ে যেত, আর লোকগুলো সব তার মধ্যে ধপাধপ আছাড় খেয়ে পড়ত, তা হলে হো হো হো হো’—এই বলে হিজিবিজবিজ হাসতে হাসতে আবার মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।খোকা বলে, ‘কেন তুমি এই সব অসম্ভব কথা ভেবে খামকা হেসে হেসে কষ্ট পাচ্ছ?’ সে বলল, ‘না, না, সব কি আর অসম্ভব? মনে করো, একজন লোক টিকটিকি পোষে, রোজ তাদের নাইয়ে–খাইয়ে শুকোতে দেয়, একদিন একটা রামছাগল এসে সব টিকটিকি খেয়ে ফেলেছে—হো হো হো হো।’

এই গল্পেই একটা রুমাল হঠাৎ বিড়াল হয়ে যায়। উল্টোপাল্টা অঙ্ক জানা এক দাঁড়কাক, তার সরদার গণিতবিদ টেকো উধো বুড়ো, তার ভাই বুধো বুড়ো আর সংগীতজ্ঞ ন্যাড়া মাথার দেখা মেলে। আরও আছে ব্যাকরণ শিং বিএ খাদ্যবিশারদ। তাদের দুনিয়ায় কী করে যেন ঢুকে পড়ে ওই খোকা, যেমন অ্যালিস ঢুকে পড়েছিল ওয়ান্ডারল্যান্ডে।

অ্যালিসের ওয়ান্ডারল্যান্ডে আমরা বিড়ালের হাসি দেখতে পাই, আর সুকুমারের ছড়ায় শুনতে পাই ‘হুলোর গান’। গভীর রাতে ফাঁকা রাস্তায় কেউ একজন হুলোকে গাইতে বলে।

বিদ্‌ঘুটে রাত্তিরে ঘুট্‌ঘুটে ফাঁকা,
গাছপালা মিশ্‌মিশে মখ্‌মলে ঢাকা।
জট্‌বাঁধা ঝুল কালো বটগাছতলে,
ধক্‌ধক্‌ জোনাকির চক্‌মকি জ্বলে,
চুপ্‌চাপ্‌ চারিদিকে ঝোপঝাড়গুলো—
আয় ভাই গান গাই আয় ভাই হুলো।
গীত গাই কানে কানে চীৎকার ক’রে,
কোন্‌ গানে মন ভাঙে শোন্‌ বলি তোরে-
পূবদিকে মাঝ রাতে ছোপ্‌ দিয়ে রাঙা
রাতকানা চাঁদ ওঠে আধখানা ভাঙা।
চট্‌ ক’রে মনে পড়ে মট্‌কার কাছে
মালপোয়া আধাখানা কাল থেকে আছে।

(‘হুলোর গান’, আবোল তাবোল)

হুলোর গানে আমাদের হাসি পায়। তবে সুকুমারের ছড়া পড়ে হাসতেই হবে, এমন কথাও নেই। তাদের জন্যও সুকুমার ছড়া লিখেছেন—

রামগরুড়ের ছানা হাসতে তাদের মানা,
হাসির কথা শুনলে বলে,
‘হাস্‌ব না-না না-না’।
সদাই মরে ত্রাসে— ঐ বুঝি কেউ হাসে!
এক চোখে তাই মিট্‌মিটিয়ে
তাকায় আশে পাশে।

(‘রামগরুড়ের ছানা’, আবোল তাবোল)

এসব গল্প ও ছড়াকে সুকুমারের ননসেন্স বলা হয় এ জন্য যে এতে ব্যাকরণের কোনো ধার ধরা হতো না। ছেলেমেয়ে মানুষ করানোর চেয়ে সুকুমার পছন্দ করতেন তাদের আনন্দ দিতে। একটি ছড়ায় তো সুকুমার এক জন্তুর ধড়ে আরেক জন্তুর মাথা বসিয়ে দিয়েছিলেন।

হাঁস ছিল, সজারু, (ব্যাকরণ মানি না)
হয়ে গেল ‘হাঁসজারু’ কেমনে তা জানি না।
বক কহে কচ্ছপে—‘বাহবা কি ফুর্তি!
অতি খাসা আমাদের বকচ্ছপ মূর্তি।’

(‘খিচুড়ি’, আবোল তাবোল)

এমনি করে গিরগিটি আর টিয়া মিলে হলো গিরগিটিয়া, বিছা আর ছাগল মিলে বিছাগল, জিরাফ আর ফড়িং মিলে জিরাফড়িং, মোরগ আর গরু মিলে মোরগরু, হাতি আর তিমি মিলে হাতিমি, সিংহ আর হরিণ মিলে সিংহরিণ হলো—সে এক ডালে–চালে খিচুড়িকাণ্ড।

আর ত্যানা না পেঁচিয়ে এখানেই থামলাম। সুকুমার রায়ের ননসেন্স সাহিত্যের আরও মজা পেতে চাও? তবে এবার পাগলা দাশু, অবাক জলপান, ঝালাপালা, জুড়ির গান, লক্ষ্মণের শক্তিশেল নিয়ে স্রেফ বসে পড়ো!