নিউরালিংক ও ইলন মাস্কের বানর

কেমন হবে যদি প্যারালাইজড বা পক্ষাঘাতগ্রস্ত কেউ শুধু চিন্তা করেই মুঠোফোন চালাতে পারেন? কিংবা যদি গাড়ি চালাতে পারেন? নিশ্চয়ই ভাবছ, কোথায় মুঠোফোন আর কোথায় গাড়ি! এ তো অসম্ভব। অসম্ভবকে সম্ভব করাই আসলে ইলন মাস্কের কাজ। এমনটা তিনি আগেও করে দেখিয়েছেন অনেকবার।

গত ৯ এপ্রিল ইলন মাস্কের ব্রেন চিপ স্টার্টআপ ‘নিউরালিংক’ তিন মিনিটের একটি ভিডিও ফুটেজ প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, পেজার নামের একটি বানর শুধু চিন্তা করে করে, কোনো কিছু হাত দিয়ে না ধরেই মাইন্ড পং নামের একটি ভিডিও গেম খেলছে। এর পেছনে আছে বানরটির মাথায় বসানো নিউরালিংক চিপ। প্রথমে অবশ্য বানরটিকে জয়স্টিক দিয়ে খেলার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ভিডিওতে দেখা গেছে, জয়স্টিক ছাড়াই বানরটি শুধু হাত নেড়ে নেড়ে গেম খেলছে।

এ নিয়ে ইলন মাস্ক টুইট করেছেন। লিখেছেন, ‘প্রথম নিউরালিংক পণ্যটি পক্ষাঘাতগ্রস্ত ব্যক্তিদের শুধু চিন্তা করে স্মার্টফোন ব্যবহারের সুযোগ করে দেবে। আঙুলের চেয়ে দ্রুতগতিতে মুঠোফোন চালাতে পারবেন তাঁরা।’

২০১৬ সালে নিউরালিংকের যাত্রা শুরু। সহপ্রতিষ্ঠাতা ইলন মাস্ক। নিউরালিংকের লক্ষ্য হচ্ছে স্নায়বিক সমস্যা আছে, এমন ব্যক্তিদের মাথায় ওয়্যারলেস কম্পিউটার চিপ বসিয়ে আলঝেইমার, ডিমেনশিয়া কিংবা মেরুদণ্ডে সমস্যা ইত্যাদির সমাধান। সহজ কথায়, মানুষের সঙ্গে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সংযোগ করে দিয়ে স্নায়বিক বিভিন্ন সমস্যার চূড়ান্ত সমাধান করা। সেই সঙ্গে শুধু চিন্তা করেই বিভিন্ন যন্ত্র—স্মার্টফোন থেকে স্মার্ট কার পর্যন্ত সবকিছু চালানোর ব্যবস্থা করে দেওয়া।

প্রযুক্তিটি এখনো খুব বেশি দূর এগোতে পারেনি। তবে ২০২০-এর আগস্টে একটি শূকরের মাথায় চিপ বসানোর পর এবার বানরের মাথায় চিপ বসাল নিউরালিংক। ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে এর ব্যবহার। অর্থাৎ অল্প দিনে উন্নতির পরিমাণ খুব কমও নয়। আর প্রকল্পটির পেছনের মানুষ যেহেতু ইলন মাস্ক, শেষ না দেখে যে তিনি ছাড়বেন না, তা তো বোঝাই যাচ্ছে।

‘জিনিসটা খানিকটা ছোট ছোট তার দিয়ে খুলিতে বসানো ফিটবিটের মতো।’ নিউরালিংক নিয়ে ইলন মাস্কের বক্তব্য। ফিটবিট মানে, ফিটনেস ট্র্যাকার। স্মার্টফোনে বসানো যেসব চিপ মানুষের হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন বা রক্তচাপ ইত্যাদি রেকর্ড করে রাখে, সেগুলো।

নিউরালিংক, সংক্ষেপে ‘লিংক’ আসলে ১ হাজার ২৪টি চ্যানেল বা ইলেকট্রোডযুক্ত ২৩×৮ মিলিমিটার আকৃতির একটি চিপ। ইলেকট্রোডগুলো নন-করোসিভ, মানে ক্ষয়ে যায় না, এমন পদার্থ দিয়ে তৈরি (যেমন সিলিকন কার্বাইড)। ব্যাস ৫ মাইক্রন। এই ব্যাসের পরিমাণ মানুষের একটি চুলের ২০ ভাগের ১ ভাগ।

লিংকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ ‘পড়তে’ (Read) এবং ‘লিখতে’ (Write) পারা। কম্পিউটারবিজ্ঞানের ভাষায় ‘পড়া’ বা ‘রিড’ করা মানে, সিগন্যাল শনাক্ত করতে পারা, কমান্ড বা নির্দেশ বুঝতে পারা। আর ‘লেখা’ বা ‘রাইট’ করা মানে আউটপুট দেওয়া। এগুলো জানার জন্য অবশ্য কম্পিউটারবিজ্ঞানী হতে হয় না। তোমরা যারা বাসায় কম্পিউটার চালাও, সবাই নিশ্চয়ই রিড-রাইটের সঙ্গে পরিচিত।

নিউরালিংক মূলত নিউরন থেকে আসা সিগন্যাল ‘রিড’ বা শনাক্ত করতে পারবে এবং সে হিসেবে ‘রাইট’, মানে নিউরনকে নির্দিষ্ট কোনো কাজের কথা ভাবার জন্য যে বৈদ্যুতিক ইমপালস তৈরি করতে হয়, সেটা উৎপন্ন করবে। ফলে নিউরনটি সক্রিয় হবে এবং সেই কাজ করতে পারবে।

গবেষকেরা পেজার নামের বানরটির হাত ও বাহুর মোটর করটেক্স স্নায়বিক অঞ্চলে এই ‘লিংক’, মানে নিউরালিংক বসিয়েছেন। এই অঞ্চল মূলত স্বেচ্ছায় করা নড়াচড়ার পেছনের পরিকল্পনা করে, নড়াচড়া শুরু করে এবং নড়াচড়ার পুরো কাজটা নিয়ন্ত্রণ করে। বসিয়ে দেওয়ার পর লিংক থেকে গবেষকেরা পেজারের সম্পূর্ণ স্নায়বিক কাজকর্মের একটি মানচিত্র পেয়ে গেছেন। তারপর স্নায়বিক বিভিন্ন ধরনের সিগন্যালের জন্য মোটর স্নায়ু কীভাবে সাড়া দেয়, এর ফলে নড়াচড়া কেমন হয় ইত্যাদির একটি মডেল তৈরি করেছেন। এখান থেকে তাঁরা বুঝতে পেরেছেন, কোনো চিন্তা করলে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখায়, চিন্তার সঙ্গে প্রতিক্রিয়ার সম্পর্ক কী রকম ইত্যাদি। এর ওপর নির্ভর করে তাঁরা আবার একটি ‘ডিকোডার’ বানিয়েছেন। আসল কাজ করে এই ডিকোডার।

মস্তিষ্ক কোনো চিন্তা করলে ডিকোডার সেই সিগন্যাল গ্রহণ করে এবং এর ফলে মোটর স্নায়ুটির কীভাবে সাড়া দেওয়া উচিত, তা অনুমান করার চেষ্টা করে। একটু অন্যভাবে বললে, চিন্তা থেকে আসা সিগন্যাল অনুযায়ী বিভিন্ন অঙ্গের কীভাবে সাড়া দেওয়ার কথা, কতটুকু দ্রুত এবং কোন দিকে নড়াচড়া করার কথা ইত্যাদি এটি হিসাব কষে বের করে ফেলে। এই হিসাব সে আউটপুট হিসেবে দেয় কম্পিউটারকে। ফলে কম্পিউটার বুঝতে পারে, স্ক্রিনের ওপর মাউসের কার্সরটা কোন দিকে নাড়ানো উচিত (মানে হাত দিয়ে ধরে থাকলে কোন দিকে, কীভাবে, কত দ্রুত নাড়াত)। সে অনুযায়ী এটি কার্সরটা নাড়ায়। এভাবেই পেজার শুধু চিন্তা করেই কার্সরটি নাড়াতে পেরেছিল, গেম খেলতে পেরেছিল।

এখন চিন্তার ওপর নির্ভর করে শুধু হাত নয়, পুরো দেহের নড়াচড়াই যদি অনুমান করা যায় এবং সে হিসাবে বিভিন্ন যন্ত্রকে নির্দেশ দেওয়া যায়, তাহলে কী হবে, ভাবো তো!

হাতের ইশারায়, চিন্তা করে করে গেম খেলছে পেজার

এভাবে ধাপে ধাপে গবেষণা করে মানবদেহের জন্য এই প্রযুক্তিকে উপযোগী করে তোলা হচ্ছে। চিন্তার ওপর নির্ভর করে একজন মানুষের বিভিন্ন অঙ্গ কীভাবে নড়াচড়া করে, তা যদি হিসাব কষে বের করে ফেলা যায়, তাহলে সামনে রাখা বিভিন্ন যন্ত্রকে সেভাবে কাজ করার নির্দেশ দেওয়া যাবে।

একটা উদাহরণ দিই। ধরো, একজন পক্ষাঘাতগ্রস্ত ব্যক্তি একটি গাড়ি চালাচ্ছেন। কিন্তু তিনি হাত ও পা নাড়াতে পারেন না। যখনই ব্রেক করা প্রয়োজন, তিনি ব্রেক কষার কথা ভাবেন। পা কাজ করলে, তাঁর পা ব্রেক প্যাডেলে চাপ দিত। মানুষটি যেহেতু পা নাড়াতে পারেন না, তাঁর এই চিন্তা সরাসরি পৌঁছে যাবে গাড়ির কাছে। গাড়ি নিজেই তখন ব্রেক করবে। কত জোরে প্যাডেলে চাপ দিতে হবে, সে তথ্যও গাড়িটা পেয়ে যাবে ব্যক্তিটির চিন্তা থেকে। একইভাবে মানুষটি যেভাবে চাচ্ছেন, সেভাবে হাত নাড়াতে না পারলেও গাড়ি তাঁর হয়ে স্টিয়ারিং হুইল ঘুরিয়ে দেবে। তার মানে শুধু চিন্তা করেই তিনি গাড়ি চালাতে পারবেন! একইভাবে চিন্তার মাধ্যমে চালানো যাবে মুঠোফোন বা অন্যান্য প্রয়োজনীয় যন্ত্র।

নিউরালিংক যদি এটা আসলেই করতে পারে, তাহলে মানুষ প্রযুক্তির নতুন এক যুগে প্রবেশ করবে। কল্পবিজ্ঞানের বিচিত্র জগৎ ছেড়ে চিন্তার মাধ্যমে বিভিন্ন কাজ করার ব্যাপারটি হয়ে যাবে নিখাদ বাস্তব। পেজারের ভিডিও ইঙ্গিত দিচ্ছে, এটা সম্ভব। ইলন মাস্ক কিন্তু এখানেই থামতে রাজি নন। গত বছরের নিউরালিংক ইভেন্টে তিনি বলেছেন, ভবিষ্যতে নিউরালিংক স্মৃতি ‘সেভ’ করে রাখতে পারবে এবং সময়মতো ‘রিপ্লে’ দেখাতে পারবে। তিনি মনে করেন, চাইলে স্মৃতির ‘ব্যাকআপ’ রেখে দেওয়া এবং পরে ‘রিস্টোর’ করে নেওয়া সম্ভব। তাঁর মতে, ‘আপনারা চাইলে এসব স্মৃতি নতুন কোনো দেহে বা কোনো রোবটের ভেতরে ডাউনলোড করে নিতে পারবেন। বড় বিচিত্র এক ভবিষ্যতের দিকে এগোচ্ছি আমরা!’

ছবিতে পেজারের করটেক্স স্নায়বিক অঞ্চলের নিউরাল থ্রেডগুলো দেখা যাচ্ছে

স্মৃতি যদি আসলেই ডাউনলোড করে নেওয়া যায়, সেটা কি ভালো হবে? কিংবা রিপ্লে করে স্মৃতি দেখা গেলে, কিছু ভোলা সম্ভব না হলে পৃথিবীটা কি আরও সুন্দর হয়ে উঠবে, নাকি নরক? আমরা জানি না। যদিও বিজ্ঞান কল্পকাহিনির লেখকেরা বারবার এ রকম বিভিন্ন ব্যাপারে সতর্ক করে দিচ্ছেন।

আসলে যেকোনো প্রযুক্তি একই সঙ্গে ভালো-মন্দ—দুভাবেই ব্যবহার করা যায়। এ নিয়ে রিচার্ড ফাইনম্যান তাঁর মিনিং অব ইট অল বইতে বলে গেছেন, ‘আমার মনে হয়, কিছু করতে পারার ক্ষমতা মানেই এর মূল্য আছে। ফল ভালো না খারাপ হবে, সেটা অবশ্যই ব্যবহারের ওপর নির্ভর করে। কিন্তু ক্ষমতা মানেই আমার কাছে এর একটা মূল্য আছে।

নিউরালিংকেরও ভালো-মন্দ দুই ধরনের ব্যবহারই হতে পারে। তবে এর মূল্য অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই।

শেষের আগে

শেষ করার আগে একটা কথা বলার লোভ সামলাতে পারছি না। মানুষ ‘ক্রিসপার’ নামের একধরনের জৈব কাঁচি আবিষ্কার করে ফেলেছে। এই ক্রিসপার দিয়ে জিন কাটা যায়, ডিএনএ কাটা যায়। এগুলোকে বদলে দেওয়া যায় প্রয়োজনমতো। করোনাভাইরাসের যেসব টিকা তৈরি করা হয়েছে, তার পেছনে চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের পাশাপাশি বড় ভূমিকা রেখেছেন কম্পিউটারবিজ্ঞানী ও প্রকৌশলীরা। বিভিন্ন ধরনের টিকার সিমুলেশন তৈরি করে করে গবেষণাগারে পরীক্ষা করে দেখেছেন তাঁরা।

প্রযুক্তিনির্ভর ভবিষ্যতের দুনিয়া আমাদের সামনে যেসব বিচিত্র সুযোগ নিয়ে আসবে, তার চাবিকাঠি হচ্ছে প্রোগ্রামিং। প্রোগ্রামিং শেখার জন্য কম্পিউটারবিজ্ঞান ও প্রকৌশল নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা করা জরুরি নয়। বিশেষ করে বাংলাদেশের বাস্তবতায় এটি আরও বড় সত্যি। তুমি যদি ভবিষ্যতের বিচিত্র পৃথিবীতে চমৎকার কিছু করতে চাও, তোমার নিজস্ব আগ্রহের বিষয়ে চর্চার পাশাপাশি চাইলে একটুখানি প্রোগ্রামিং শিখে নিতে পারো। আর সে জন্য এখন আছে পাইথনের মতো সহজ প্রোগ্রামিং ভাষা। নিউরালিংকও লেখা হয়েছে মূলত সি প্লাস প্লাস ও পাইথন দিয়ে।

তুমি যদি প্রোগ্রামিং শিখতে চাও, তাহলে শুরু করতে পারো ‘হাকুশ পাকুশের প্রোগ্রামিং শিক্ষা’ নামের চমৎকার একটি ওয়েবসাইট থেকে।

প্রোগ্রামিংয়ের চমৎকার জগতে তোমাকে স্বাগত!

সূত্র: বিবিসি, দ্য গার্ডিয়ান, অ্যানালাইটিকস ইন্ডিয়াম্যাগ, উইকিপিডিয়া ও নিউরালিংক ডটকম