নিজেকে কাতুকুতু দেওয়া যায় না কেন?

লোকে বলে, পৃথিবীতে যত রহস্য আছে, তার মধ্যে সবচেয়ে রহস্যময় নাকি মানুষের মন। সেটি সত্যিই কি না, তা টের পেতে চাইলে ছোট্ট এক পরীক্ষা করে দেখতে পারো। এ পরীক্ষার জন্য দরকার একটি পাখির পালক আর তোমার পা। তোমার পা’টা আশা করি তোমার সঙ্গেই আছে। তাই এই বেলা শুধু পাখির পালক জোগাড় করে নিলেই হবে। এবার কোথাও হেলান দিয়ে আরাম করে বসে পাখির পালক দিয়ে তোমার পায়ের পাতায় সুড়সুড়ি দাও। কী, কিছু হলো? এবার তোমার কোনো বন্ধুকে বলো ওই একই পালক দিয়ে তোমার পায়ে সুড়সুড়ি দিতে। কেউ বলে না দিলেও সবাই জানে কাতুকুতুর চোটে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছ তুমি। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, একই যাত্রায় পৃথক ফল কেন? আজব ব্যাপার হলো, নিজেকে নিজেই কখনো কাতুকুতু দেওয়া যায় না।

কিন্তু কেন? এ প্রশ্ন ছোটবেলা থেকেই অনেকের মনে উঁকি দেয়। তোমাদের মতো এ একই প্রশ্ন নিয়ে বাঘা বাঘা স্নায়ুবিজ্ঞানীও ভীষণ চিন্তিত। বর্তমানে এ নিয়ে ব্যাপক গবেষণা শুরু করেছেন তাঁরা। অনেক মাথা ঘামানোর পর তাঁরা এর পেছনের কারণ হিসেবে মাথার পেছন দিকটাকেই দায়ী করেছেন। আসলে আমাদের মাথা বা মস্তিষ্কের পেছনে সেরেবেলাম নামে একটা অংশ আছে। এ অংশের মাধ্যমেই নিজের নড়াচড়ার অনুভূতি আমরা টের পাই। তবে অন্য কেউ কিছু করলে তখন সেরেবেলাম কোনো সংকেত দেয় না। তাই যখন নিজেকে নিজে সুড়সুড়ি দেওয়ার চেষ্টা করো, তখন সেরেবেলাম সতর্ক হয়ে যায়। মস্তিষ্কের বাকি অংশকেও সর্তক করে দেয়। তখন গোটা মস্তিষ্ক সাবধান হয়ে সুড়সুড়ির অনুভূতিটাকে পুরোই নিয়ন্ত্রণ করে ফেলে। ভাগ্যিস সেরেবেলাম ছিল, তাই নিজের স্পর্শ আর অন্যের স্পর্শকে আলাদা করা যায়। নয়তো নিজের হাত দিয়ে নিজের পা ধরলেও মনে হতে পারত অন্য কেউ আক্রমণ করছে না তো! তখন আবার কী মুশকিল হতো! তখন নিজেকেই নিজে থাপ্পড় কষাতে হয়তো!

অন্য কেউ কাতুকুতু দিলে যে আনন্দপূর্ণ অনুভূতি হয়, এতে মস্তিষ্কের মূলত দুটি অংশ জড়িত থাকে। সোমাটোসেন্সরি কর্টেক্স (স্পর্শের অনুভূতি জাগায়) ও সিংগুলেট কর্টেক্স (আনন্দ অনুভূতি দেয়)। নিজেকে সুড়সুড়ি দেওয়ার সময় এ অংশগুলো অত সক্রিয় থাকে না। কিন্তু অন্য কেউ দিতে এলেই খুব সক্রিয় হয়ে যায়।

পৃথিবীজুড়ে বিজ্ঞানীরা কত কাণ্ডই না করছেন, মস্তিষ্ককে বোকা বানিয়ে নিজেকে নিজে কাতুকুতু দেওয়ার উপায় উদ্ভাবন করতে। এর মধ্যে একটা উপায় হলো ম্যাগনেটিক ব্রেইন স্টিমুলেশন ব্যবহার। এর মাধ্যমে প্রথমে মানুষটার পায়ের নড়াচড়া নিয়ন্ত্রণ করা হয়। তখন নিজের হাত দিয়েই পায়ে সুড়সুড়ি দেওয়া যায়। আবার আরেকটা গবেষণায় কিছু মানুষকে সুড়সুড়ি দেওয়ার আগে তাদের বিশেষ ধরনের ভিডিও গগলস পরিয়ে আউট অব বডি অনুভূতি দেওয়া হয়। তখন তারা বুঝেই উঠতে পারে না যে আসলে তাদের শরীর কোনটা। সামনে বসে থাকা মানুষের দেহটাকেই নিজের দেহ বলে মনে করে। তখন একটা সুইচে চাপ দিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে সুড়সুড়ির অনুভূতি পাওয়া যায়। কিন্তু তারপরও এ ক্ষেত্রে নিজের হাত-পা নাড়িয়ে নিজেকে নিজে সুড়সুড়ি দেওয়া যায় না। এমনকি পরীক্ষায় দেখা গেছে, ঘুমের মধ্যে বা স্বপ্নের মধ্যেও নিজেকে নিজে সুড়সুড়ি দেওয়া যায় না। তারপরও বিজ্ঞানীরা হাল ছেড়ে বসে নেই। নিজেকে সুড়সুড়ি দেওয়ার কৌশল বের করতে নানা গবেষণা করছেন। কারণ, কৌশলটা জানতে পারলেই অনেক বৈজ্ঞানিক প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে। আর যদি সেই কাতুকুতুর অ্যালগারিদম তৈরি করে রোবটদের দিয়ে দেওয়া যায়, তবে নতুন রোবট তৈরি করা সম্ভব হবে। যারা নিজের আর অন্যের স্পর্শের পার্থক্য ধরতে পারবে। তখন হাতে পালক নিয়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নতুন ধরনের গবেষণা শুরু হবে। হয়তো রোবটের পায়ে পালক ছুঁয়ে দেখা হবে—কোনো রোবট হাসিখুশি কি না। সেটি নিশ্চয়ই অনেক মজার হবে।

বিবিসি ফিউচার অবলম্বনে