নীল সাগরে লরার লড়াই

ছোটবেলায় পড়া রবিনসন ক্রুসোর গল্পের কথা মনে আছে? মাত্র ১৮ বছর বয়সে ক্রুসোর ঝোঁক উঠেছিল, সে সমুদ্র অভিযানে বের হবে। কিন্তু বাদ সাধল মা–বাবা। অনুমতি দিতে নারাজ তারা। যদিও মা–বাবার কথা অমান্য করে ক্রুসো ঠিকই বেরিয়ে পড়েছিল সমুদ্র অভিযানে। আর যাওয়ার পর থেকেই ক্রুসো পড়ে নানা বিপদের মুখে। একবার ঝড়ের কবলে পড়ে তো আরেকবার জলদস্যুরা আক্রমণ করে তাকে বেচে দেয় দাস হিসেবে। শেষমেশ ঝড়ে তার জাহাজ ধ্বংস হলে একমাত্র ক্রুসো সেই ধ্বংসস্তূপ থেকে বেঁচে ফিরে আশ্রয় নেয় এক দ্বীপে। এর পরের গল্পটা জানা না থাকলে বইটি পড়ে নিয়ো তোমরা। কারণ, আমাদের আজকের গল্পের মূল চরিত্র নেদারল্যান্ডসের লরা ডেকার। রবিনসন ক্রুসোর মতো তাঁরও ঝোঁক উঠেছিল সমুদ্র অভিযানে বের হয়ে একাই পুরো পৃথিবী চক্কর দেওয়ার। অর্থাৎ এককভাবে সমুদ্রপথে পৃথিবী প্রদক্ষিণ বা Circumnavigation। অদ্ভুত আর দুঃসাহসী অ্যাডভেঞ্চারের ঝোঁকটা লরার মাথায় এসেছিল মাত্র ১০ বছর বয়সে। মা–বাবারও সায় ছিল তাঁর সমুদ্র অভিযানের। কিন্তু বাধার পাহাড় হয়ে দাঁড়ায় নেদারল্যান্ডস তথা ডাচ কর্তৃপক্ষ। তারা সাফ জানিয়ে দেয়, এ ধরনের বিপজ্জনক অভিযানের জন্য লরার বয়স এখনো অনেক কম। অন্যদিকে তাঁর স্কুল থেকেও বলা হয়, এ বয়সে সমুদ্রে না ঘুরে ক্লাসরুমেই থাকা উচিত লরার। এমনকি যাত্রা শুরুর আগে তাঁর অভিযান নিষিদ্ধ করার দাবিতে মামলাও করে দেয় নেদারল্যান্ডসের শিশুকল্যাণ কর্তৃপক্ষ। তাদের মতে, লরা তাঁর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মতো উপযুক্ত বয়সী নন। কিন্তু লরা ও তাঁর পরিবার এমনটি মানতে নারাজ। তাই বলে রবিনসন ক্রুসোর মতো অবাধ্য হয়ে অভিযানে বেরিয়ে পড়েননি তিনি। বরং মামলা লড়ে জয়ী হয়ে তবেই লরা প্রস্তুতি নেন তাঁর সমুদ্র অভিযানের জন্য।

২০১১ সালের ২০ জানুয়ারি মাত্র ১৪ বছর বয়সে লরা ডেকার সমুদ্রপথে পৃথিবী প্রদক্ষিণ করার জন্য রওনা হন ‘গাপ্পি’ নামের প্রিয় ইয়টকে সঙ্গী করে। ক্রুসোর মতো বিপদে অবশ্য পড়তে হয়নি লরাকে। ৫১৮ দিন পর ১৬ বছর বয়সে যেখান থেকে যাত্রা শুরু করেছিলেন, ঠিক সেখানে ফিরে আসেন লরা। জয় করে নেন পৃথিবীর সর্বকনিষ্ঠ নাবিকের খেতাব।

উত্তাল সমুদ্রে লরা।

মাত্র ১৪ বছর বয়সে কী করে কেউ নাবিক হয়? আবার সমুদ্র ঘুরে পুরো পৃথিবীও প্রদক্ষিণ করে ফেলতে পারে? কিন্তু এটা কোনো গল্প নয়। প্রথম থেকে লরা ডেকারের জীবনকাহিনি শোনো তবে।

একবার ডিক ডেকার ও ব্যাবস মুলার দম্পতি সাত বছরের জন্য রওনা হন এক সমুদ্রযাত্রায়। সে যাত্রার মাঝপথে ১৯৯৫ সালের ২০ সেপ্টেম্বর নিউজিল্যান্ডের বিশাল সমুদ্রের মধ্যে তাঁদের কোল আলো করে জন্ম নেয় এক কন্যাসন্তান। তাঁরা সমুদ্রকন্যার নাম দেন লরা ডেকার। লরার জীবনের প্রথম পাঁচ বছর কেটে যায় তাঁর মা–বাবার সঙ্গে সমুদ্রে ঘুরে। এরপর তাঁরা ফিরে আসেন নেদারল্যান্ডসে। মাত্র ছয় বছর বয়সে তিনি অপটিমিস্ট নামের ডিঙিনৌকা নিয়ন্ত্রণ করা শিখে যান। বাবার প্রায় সব সমুদ্রযাত্রার সঙ্গী হয়ে উঠেছিলেন ছোট্ট মেয়ে লরা। সমুদ্রের কোলে যাঁর জন্ম ও বেড়ে ওঠা, তাঁর যে গৎবাঁধা পাঠ্যবইয়ের থেকে খোলা আকাশের নিচে বিশাল সমুদ্রে হারিয়ে যেতেই মন বেশি সায় দেবে, তা লরার বাবা ঠিকই বুঝেছিলেন। লরাও মাত্র ১০ বছর বয়স থেকে একা সমুদ্রপথে পৃথিবী প্রদক্ষিণ করার জন্য প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেন।

২০০৯ সালে তাঁর বাবা পরামর্শ দেন, প্রথমে ইংল্যান্ডের সমুদ্রে গিয়ে অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য। লরার বয়স তখন ১৩ বছর। কিন্তু ইংলিশ চ্যানেলের অসম্ভব শক্তিশালী স্রোত, রুক্ষ আবহাওয়া এবং বিশাল জাহাজের অহরহ চলাচলের কারণে পাল তোলা নৌকা বা Sailing Boat–এর চলাচল কঠিন হয়ে যায়। তাহলে এসব জেনেশুনেও লরার বাবা তাঁকে কেন পাঠান ইংলিশ চ্যানেলে? কারণ, লরা যাতে ভয় পেয়ে ওই বয়সে একা সমুদ্রে ঘোরার ঝোঁক মাথা থেকে বের করে দেন। কিন্তু হলো হিতে বিপরীত। লরা ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়ে ফিরে এসে এক ডাচ দৈনিক পত্রিকায় ঘোষণা দিয়ে দেন, তিনি দুই বছরের জন্য পৃথিবীজুড়ে একক সমুদ্রযাত্রায় যাওয়ার জন্য প্রস্তুত।

লরা এখন সেই অ্যাডভেঞ্চারের গল্প শোনান নতুন প্রজন্মকে।

অন্যদিকে ইংলিশ চ্যানেল অভিযান থেকে ফেরার সময় প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে লরা থেমেছিলেন ইংল্যান্ডের লোস্টফট ঘাটে। সেখানকার স্থানীয় কর্তৃপক্ষ মাত্র ১৩ বছর বয়সী নাবিককে দেখে তাঁর বাবাকে জানায়, তিনি না আসা পর্যন্ত তারা লরাকে একা সমুদ্রপথে ছাড়বে না। তারা বলে, এইটুকু বাচ্চার জন্য সমুদ্রপথ বিপজ্জনক। শেষ পর্যন্ত লরার বাবা সেখানে গিয়ে তাঁকে ফিরিয়ে আনতে বাধ্য হন। কিন্তু এতে দমে না গিয়ে লরা যখন নতুন উদ্যমে তাঁর সমুদ্রপথে পৃথিবী প্রদক্ষিণের পরিকল্পনার কথা সবাইকে জানান, তখন ডাচ কর্তৃপক্ষও ইংরেজদের অনুসরণ করে তাঁর স্বপ্নে জল ঢেলে দেয়। ডাচ আইনমতে, ১৬ বছরের নিচে কেউ নাবিক হতে পারে না। ফলে নিষিদ্ধ হয় তাঁর অভিযান। শিশুকল্যাণ কর্তৃপক্ষ করে দেয় মামলা। তখন মামলাটির খবর নেদারল্যান্ডস পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়েও ছড়িয়ে গিয়েছিল। যদিও লরার অভিযানের জন্য প্রস্তুতি, মনোবল ও অসীম ইচ্ছা পর্যবেক্ষণ করে এবং তাঁর মা–বাবার পূর্ণ অনুমতি থাকা সাপেক্ষে ২০০৯ সালের শেষের দিকে নেদারল্যান্ডস সরকার মামলা বাতিল করে দেয়। ২০১০ সালের সেপ্টেম্বরে লরার বয়স ১৫ বছর হলে তাঁকে সমুদ্র অভিযানে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়। লরাও তাঁর ১৫ বছর হওয়ার মাত্র এক মাস আগে, অর্থাৎ ২০১০ সালের ২১ আগস্ট সমুদ্রপথে পৃথিবী প্রদক্ষিণ করার লক্ষ্যে রওনা দেন জিব্রাল্টার হয়ে ক্যারিবিয়ানের সিন্ট মার্টিন থেকে। এরপর পানামা ক্যানেল থেকে প্রশান্ত মহাসাগর ও ভারত মহাসাগর পেরিয়ে কেপটাউন ঘুরে এবং বিভিন্ন বন্দরে বিশ্রামের জন্য থেমে শেষমেশ আবার চূড়ান্ত গন্তব্য সিন্ট মার্টিনে এসে পৌঁছান তিনি। এরই সঙ্গে সম্পন্ন হয় লরা ডেকারের ২৭ হাজার নটিক্যাল মাইল সমুদ্রপথ পাড়ি দিয়ে বিশ্ব ভ্রমণ করার ঐতিহাসিক এক অভিযান।

লরা ডেকার অভিযানের লক্ষ্যে সমুদ্রপথে ৫১৮ দিন বা ১ বছর ৫ মাস সময় কাটান। ২০১২ সালের ২০ জানুয়ারি মাত্র ১৬ বছর বয়সে তিনি সম্পন্ন করেন তাঁর সমুদ্র অভিযান। পান সর্বকনিষ্ঠ নাবিকের খেতাব। অস্ট্রেলিয়ার নাবিক জেসিকা ওয়াটসনের রেকর্ড ভেঙে একক সমুদ্র অভিযানে যাওয়া সর্বকনিষ্ঠ নাবিকের রেকর্ডও বাগিয়ে নেন লরা। যদিও গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস কাউন্সিল তাঁর এই কৃতিত্বকে স্বীকৃতি দেয়নি। তাদের মতে, এ ধরনের রেকর্ডে কিশোর-কিশোরীরা উৎসাহিত হয়ে নিজেদের ঝুঁকির মুখে ফেলতে পারে।

লরার নৌকা গাপ্পি।

কিন্তু আমাদের যেখানে সন্ধ্যার পর বাড়ির বাইরে বের হওয়ার কথা বলতেই মায়ের কানমলা খাওয়ার ভয়ে বুক ধুকপুক করে, সেখানে লরা ডেকার এমন সাহসী অভিযানের প্রেরণা কী করে পেলেন? এর উত্তরটা স্বয়ং লরার কাছেই শোনা যাক। লরা বলেন, ‘আমি জানতাম, বাইরে একটা জগৎ আমার অপেক্ষায় আছে। তাহলে কেন স্কুলে থেকে সময় নষ্ট করব? এমনকি স্কুল, আধুনিক জীবন আমাদের নির্দিষ্ট গৎবাঁধা পথে চলতে বলে, যা অনুসরণ করা মোটেও আবশ্যক নয়। সম্ভবত মা–বাবার সঙ্গে অভিযানে থেকে এমন উপলব্ধি হয়েছে আমার।’

বর্তমানে ২৫ বছর বয়সী লরা ডেকার ও তাঁর স্বামী বড় একটি ইয়ট তৈরি করে কিশোর-কিশোরীদের সমুদ্রযাত্রায় নিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ নিয়েছেন। এ ছাড়া লরা ডেকার ও তাঁর সমুদ্রযাত্রা সম্পর্কে আরও জানতে ঘুরে আসতে পারো তাঁর ওয়েবসাইট এ।

সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান, লরাডেকার.এনএল, সেইলিং টুডে