নীলকুঠি থেকে মুজিবনগর

ফকফকে সাদা স্কুলড্রেসটা পরিষ্কারের পর শেষ ধোয়ার আগে পানিতে এক ফোঁটা নীল ঢেলে দেন মা। সাদা ইউনিফর্মটা হয়ে ওঠে আরও ঝলমলে। নাম নীল, কিন্তু সাদা কাপড়কে করে আরও সাদা। এই নীলেরও কিন্তু একটা ইতিহাস আছে। তবে সে ইতিহাস নির্মমতা আর শোষণের। সেই অত্যাচারের কাহিনি চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন দীনবন্ধু মিত্র, তাঁর বিখ্যাত নীলদর্পণ নাটকে।

১৮৩৩ সাল। বাংলায় তখন ইংরেজদের শাসন। নীল চাষ সে সময় পুরো ভারতীয় মহাদেশে বিপুল জনপ্রিয়। বাংলার মাটি ছিল নীল চাষের জন্য বিশেষ উপযোগী। তাই ব্রিটিশ নীলকরেরা বিপুল পুঁজি বিনিয়োগ করেন নীল চাষে। যদিও নীল উৎপাদন লাভজনক ছিল না বাংলার কৃষকদের জন্য। নীল উৎপাদনে ১২ থেকে ১৪ টাকা খরচ করে চাষিরা পেতেন মাত্র ৩ থেকে ৪ টাকা। তারপরও পুরো বাংলার কৃষকদের নীল চাষে বাধ্য করা হয়। নীল চাষে অবাধ্য ও বিদ্রোহী কৃষকদের ধরে নিয়ে যাওয়া হতো বিভিন্ন নীলকুঠিতে। অত্যাচারের পর ফেলে দেওয়া হতো মৃত্যুকূপে। এমনই এক নীলকুঠি হলো আমঝুপি নীলকুঠি।

আমঝুপি নীলকুঠির পাশেই কাজলা নদী। কুঠিবাড়ির সাজঘর থেকে নদী পর্যন্ত ছিল এক সুড়ঙ্গ। অত্যাচারের পর কৃষকদের গুম করা হতো সুড়ঙ্গপথে। নির্মম ইতিহাসের সাক্ষী এই কাজলা নদীতে এখন আর পানি নেই। আছে শুধু নদীর ঘাটটি।

জনশ্রুতি আছে, আমঝুপির এখানেই রবার্ট ক্লাইভের সঙ্গে মিরজাফর ও ষড়যন্ত্রকারীদের শেষ বৈঠক হয়। বৈঠকে আঁকা হয় পলাশী যুদ্ধের নীলনকশা। বাংলায় কোম্পানি শাসন প্রতিষ্ঠার পর ১৮০০ সালে বাংলায় নীলকুঠি গড়ে উঠতে থাকে। কথিত আছে, রবার্ট ক্লাইভ সময় কাটানোর জন্য প্রায়ই এখানে আসতেন। নীল বিদ্রোহের পর এটি ক্রমেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দপ্তর হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে।

মেহেরপুরের সদর উপজেলার আমঝুপি ইউনিয়নে আমঝুপি নীলকুঠির অবস্থান। মেহেরপুর সদর থেকে ৭ কিলোমিটার পূর্বে কাজলা নদীর পাশে আমঝুপি নীলকুঠি। ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা অথবা ইঞ্জিনচালিত ভ্যান দিয়ে জেলা শহর থেকে খুব সহজেই যাওয়া যায় ঐতিহাসিক এই স্থানে।

আমঝুপির ৭৪ একর জমির ওপর নীল চাষ করা হতো। জমির একটি অংশে গড়ে উঠেছে নীলকুঠি। চারদিকে দেয়ালে ঘেরা কুঠিবাড়ির দরজা দিয়ে ঢোকার পর বাঁ পাশে এক বিশেষ ঘর। ‘স্নেকপ্রুফ রুম’ নামে ঘরটি পরিচিত। এ ঘরের মেঝে এতটাই মসৃণ যে এতে পিঁপড়াও হাঁটতে পারে না। 

মূল দরজা থেকে এগিয়ে গেলে দ্বিতীয় রুমটিতে আছে একটি ফায়ারপ্লেস। ইংরেজরা সে সময় বাংলায় ফায়ারপ্লেস ব্যবহার করত। ভেতরের ঘরগুলোর দেয়ালজুড়ে নীল চাষ ও নীল বিদ্রোহের বিভিন্ন ছবি। কুঠিবাড়ির পেছনের অংশে নকশা করা রেলিংযুক্ত বারান্দা। বারান্দা থেকে নামলেই দেখা যায় একটি কবুতরের ঘর। সেখানে বড় বড় করে লেখা, ‘ডাক বহনকারী কবুতরের ঘর’। পাশেই কাজলা নদীর ঘাট। 

আমঝুপি নীলকুঠির প্রতিটি দেয়াল ইংরেজদের নির্মম অত্যাচারের সাক্ষী। ভরদুপুরে একা একা কাজলা নদীর ঘাটে বসে নীলকুঠির দিকে তাকিয়ে থাকলে গভীর ঘোর চলে আসে। ভেসে ওঠে নীলকরদের অত্যাচারের বিভীষিকা। সে এক শোষণের ইতিহাস।

শোষণ থেকে মুক্তি একদিনে আসে না। নানা চড়াই-উতরাই, লড়াই-আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আসে মুক্তি। স্বাধীনতা।

এই নীলকুঠির কাছেই ঘটেছে আমাদের স্বাধীনতার এক ঐতিহাসিক ঘটনা। 

জায়গাটি আমঝুপি থেকে মাত্র ২২ কিলোমিটার দূরে। বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠিত হয় বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে, যা এখন মুজিবনগর। ৮০ একর জায়গার ওপর গড়ে উঠেছে মুজিবনগর স্মৃতি কমপ্লেক্স। মুজিবনগরে এখনো রয়েছে বিশাল আমের বাগান। ২০ একর জায়গাজুড়ে আমবাগান।

মূল ফটক থেকে বাগান পার হলেই চোখে পড়ে মুজিবনগর স্মৃতিসৌধ। স্মৃতিসৌধের ২৩টি দেয়াল তৈরি করা হয়েছে আমাদের ২৩ বছরের স্বাধীনতা আন্দোলনকে স্মরণ করে। পুরো স্মৃতিসৌধে রয়েছে ৩০ লাখ পাথর। মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদের সম্মানে স্মৃতিসৌধে নির্দিষ্টসংখ্যক পাথর ব্যবহার করা হয়েছে। বেদিতে অনেক ছোট ছোট গোল পাথর। পাথরগুলো শহীদ বুদ্ধিজীবীদের খুলির প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ ১১টি সেক্টরে ভাগ হয়েছিল। স্মৃতিসৌধের বেদিতে উঠতে পার হতে হয় ১১টি সিঁড়ি। 

কমপ্লেক্সের মূল অংশে আছে বাংলাদেশের বিশাল এক মানচিত্র। মানচিত্রে দেখা যায়, মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গা, মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন স্থাপনা ও মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন সেক্টর। আনুমানিক ৪০ ফুট উচ্চতার ওয়াচ টাওয়ার থেকে এ মানচিত্র দেখার স্বাদ একদম অন্য রকম। এ ছাড়া কমপ্লেক্সজুড়ে রয়েছে স্বাধীনতা আন্দোলনের বিভিন্ন দৃশ্যের ম্যুরাল। মুজিবনগর কমপ্লেক্সের ছয় ধাপের গোলাপবাগান বহন করে ঐতিহাসিক ছয় দফার প্রতীক।

মুজিবনগর কমপ্লেক্সের প্রতিটি স্থাপনা ও জায়গা স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস। ১৯৭১ সালের এ মাসেই শপথ গ্রহণ করে মুজিবনগর সরকার। এই বিশেষ মাসে ঘুরে আসতে পারো মুজিবনগর। মেহেরপুর থেকে খুব সহজেই এক দিনে ঘুরে আসতে পারবে আমঝুপির নীলকুঠি ও মুজিবনগর কমপ্লেক্স।