নোবেলের জাদুঘরে

নোবেল মিউজিয়ামে ঢোকার পথ
ছবি: লেখক

বলা নেই, কওয়া নেই হঠাৎ করে নোবেল যাত্রা! নোবেল পুরস্কার দেওয়া হবে সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে। প্রথম আলো থেকে সেখানে যাওয়ার সুযোগ হলো।

জানা ছিল, একটি ছাড়া সব কটি নোবেল পুরস্কারই দেওয়া হয় স্টকহোমে, শুধু শান্তি পুরস্কার দেওয়া হয় নরওয়ের রাজধানী অসলোতে। আমার গন্তব্য স্টকহোম। এখানেই চলছে নোবেল সপ্তাহ। নানা আয়োজনে ৫ ডিসেম্বর থেকে ১০ ডিসেম্বর মেতে থাকে সুইডেনের রাজধানী।

একটি আক্ষেপ দিয়েই শুরু। সাহিত্যে নোবেলবিজয়ী বব ডিলান আসছেন না। তাঁকে নিয়েই ছিল সবচেয়ে বেশি আলোচনা, হইচই। নোবেল কমিটি ভেবেছিল আসবেন ডিলান। অন্য সব নোবেলবিজয়ীর বক্তৃতায় উপস্থিত থাকার জন্য অনুমতি মিলেছিল, কিন্তু ডিলানের ব্যাপারটা স্পষ্ট ছিল না। এরই মধ্যে ডিলান জানালেন, আগেই যে পরিকল্পনা করা আছে, তা থেকে বের হয়ে স্টকহোমে আসতে পারবেন না তিনি। তাই ডিলান রইলেন নোবেল সপ্তাহের বাইরে। তবে ছিলেন অন্যভাবে। সে কথাও বলব পরে।

তাতে কী! নোবেল পুরস্কার তো নোবেল পুরস্কারই। পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, অর্থনীতি আর চিকিৎসাশাস্ত্রের বিজয়ীরা তো থাকছেনই। সুতরাং তাঁদের অনুষ্ঠানগুলোয় উপস্থিত থাকতে পারাও একটা অভিজ্ঞতা তো বটেই।

নোবেল মিউজিয়ামে

স্টকহোমের মেট্রো পরিচ্ছন্ন। ৫ ডিসেম্বর সুইডেনের রাজধানীতে পৌঁছানোর পর প্রথমে তো মনে হলো, এ কী গোলকধাঁধারে বাবা! হাতের সামনে ম্যাপ, কিন্তু কোথায় যাব, কীভাবে যাব, তা যেন বুঝে উঠতে পারছিলাম না। এ সময় মুশকিল আসান হয়ে দেখা দেয় ফাতেমা-তুজ-জোহরা নামের মেয়েটি। স্টকহোমের শিক্ষার্থী। ৬ ডিসেম্বর ফেসবুকের মাধ্যমে জানিয়ে দেয়, কীভাবে আমি পৌঁছাতে পারি গ্যামলা স্তানে।

গ্যামলা স্তান মানে প্রাচীন শহর। এ শহরেই নোবেল মিউজিয়াম। মেট্রো থেকে নেমে এক কিশোরীকে জিজ্ঞেস করি, ‘নোবেল মিউজিয়ামে যাব। কীভাবে যাব?’

একটু সময় নেয় মেয়েটি। তারপর বুঝি মাথায় একটা মানচিত্র বানিয়ে নেয়। বলে, ‘এই পথ ধরে সোজা চলে যাবে। তারপর লেফট, তারপর রাইট, তারপর লেফট, তারপর রাইট। ব্যস, তুমি নোবেল মিউজিয়ামে।’

নোবেল মিউজিয়ামে রবীন্দ্রনাথ
ছবি: লেখক

আমি বলি, ‘তার মানে মার্চ পাস্ট? লেফট-রাইট-লেফট-রাইট?’

খিলখিল করে হেসে ওঠে মেয়েটি। আর তখনই সকালের সোনালি নরম আলো বাড়িগুলোর ওপর এসে পড়ে আর অদ্ভুত ছবির মতো এক দৃশ্য আমার মনে গেঁথে যায়।

একটু হাঁটতেই বুঝতে পারি, এ এক অন্য জগতে চলে এসেছি। পরিকল্পিত বিশাল বিশাল অট্টালিকা আর সুপ্রশস্ত সড়কের আধুনিক স্টকহোম থেকে বেরিয়ে এখন আমি অষ্টাদশ শতাব্দীতে এসে যেন হাজির হয়েছি। চকচকে ইটের অপরিসর গলি, দুধারে তিন-চারতলা উঁচু এক একটা বাড়ি। তারই মধ্য দিয়ে আমি বাঁ-ডান-বাঁ-ডান করে সত্যিই একটি প্রাসাদের সামনে হাজির হই। নোবেল মিউজিয়াম। তার সামনে মেরুন রঙের কয়েকটি কিয়স্ক। সেখানে আসন্ন ক্রিসমাসের জন্য নানা ধরনের উপহারসামগ্রী।

মিউজিয়ামের দরজা বন্ধ। তখনো জানি না, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, অর্থনীতি আর চিকিৎসাশাস্ত্রে নোবেল পাওয়া বিজ্ঞানীরা আছেন বদ্ধ দরজার অন্য পাশে। জানি না, তাঁরা কালোরঙা চেয়ারগুলোর পেছনে সাদা কালিতে স্বাক্ষর করছেন। এদিক-ওদিক ঘুরে আমরা যখন মিউজিয়ামে ঢুকলাম, ততক্ষণে দুটো বেজে গেছে।

যার জন্য যাওয়া

অ্যালফ্রেড নোবেল বা নোবেল পুরস্কার বিষয়ে এখানে নতুন করে কিছু বলার নেই। যে-কেউ ওয়েবে অনুসন্ধান করলেই এ নিয়ে ভূরি ভূরি লেখার দেখা পাবেন। শুধু বলে রাখি, নোবেল সপ্তাহে স্টকহোমে থাকে নানা আয়োজন। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হলো নোবেল মিউজিয়ামে বিজয়ীদের স্বাক্ষর করা চেয়ারগুলো দেখা, সেই সঙ্গে মিউজিয়ামটা ঘুরে দেখা, এক দিন স্টকহোম বিশ্ববিদ্যালয়ের আউলা মাগনায় নোবেল বিজয়ীদের বক্তৃতা শোনা, এক দিন কনফারেন্স হলে নোবেল সংলাপে অংশ নেওয়া, এক দিন কনসার্ট হলে নোবেল পুরস্কার দেওয়ার অনুষ্ঠানে থাকা। সেদিনই থাকে ভোজসভা।

শিরিন এবাদির তোয়ালে
ছবি: লেখক

একের পর এক অনুষ্ঠান

নোবেল মিউজিয়ামে ঢোকার জন্য বিশাল কিউ। সাংবাদিক জেনে ভিড়ের মধ্যেই একদিক দিয়ে ভেতরে যাওয়ার রাস্তা করে দিল প্রহরীরা। সেখানে ছিলেন মিউজিয়ামের প্রেস অ্যান্ড মার্কেটিং ম্যানেজার হেলেনা ওয়াল্লেমোর। তিনি বললেন, ‘সোজা সামনে গিয়ে ডান দিকে দেখতে পাবেন চেয়ারগুলো।’ হ্যাঁ, উৎসুক মানুষ ততক্ষণে পৌঁছে গেছে সেখানে। একটি টেবিলের ওপর মোট ছয়টি চেয়ার উল্টে রাখা আছে। তাতে জ্বলজ্বল করছে স্বাক্ষর। এক এক চেয়ারে স্বাক্ষর করেছেন এক এক বিষয়ে নোবেল বিজয়ীরা। তার মানে পদার্থবিদ্যার তিনজনই স্বাক্ষর করেছেন একটি চেয়ারে, তেমনি অর্থনীতির দুজনও করেছেন একটি চেয়ারে। শুধু সাহিত্যের চেয়ারটায় বব ডিলানের স্বাক্ষর নেই। সেখানে রয়েছে গত বছরের নোবেল বিজয়ী সে্ভতলানা আলেক্সিয়েভিচের স্বাক্ষর। কখনো যদি ডিলান আসেন এখানে, হয়তো তাঁর স্বাক্ষরটাও নেওয়া হবে এই চেয়ারে!

ছিল এ বছরের বিজয়ীরা যেসব স্মৃতিচিহ্ন রেখে গেছেন তার প্রদর্শনীও।

৮ অক্টোবর ছিল নোবেল বক্তৃতা। স্টকহোম বিশ্ববিদ্যালয়ের আউলা মাগনায় ছিল এ অনুষ্ঠান। চিকিৎসাবিজ্ঞানের বক্তৃতা হয়েছিল অন্যখানে। আমি ছিলাম পদার্থবিদ্যা, রসায়ন ও অর্থনীতিতে নোবেল বিজয়ীদের বক্তৃতা অনুষ্ঠানে। সারিবদ্ধভাবে ঢুকেছে মানুষ। চোখের সামনে থেকে দেখেছে মানবতার কল্যাণে নিয়োজিত এই মানুষদের। পদার্থবিজ্ঞানী জে মাইকেল কোস্টেরলেজ বললেন, ‘আমরা যে বিষয়ে কাজ করেছি, তা এতটাই বিশেষায়িত যে আমাদের ডিসিপ্লিন ছাড়া আর কোনো ডিসিপ্লিনের বিজ্ঞানীদের পক্ষেও তা বোঝা কঠিন। তারপরও সাধারণ জনগণের জন্য সহজ করে বলার চেষ্টা করছি।’ আসলে সহজ ছিল না সে বক্তৃতা। আমরা একটু একটু বুঝতে পারছিলাম, বেশির ভাগই থেকে যাচ্ছিল বোঝার বাইরে। রসায়নের অবস্থাও তা-ই। শুধু ন্যানো গাড়ি-বিষয়ক আলোচনায় একটু ঢুকতে পারলাম। হয়তো কোনো একদিন বিজ্ঞান আরও এগোলে ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে মানুষের শরীরে ঢুকিয়ে দেওয়া হবে এই ন্যানো গাড়ি। রক্তে থাকা সুগারগুলো এরা খেয়ে নেবে। ডায়াবেটিক রোগী তাতে কিছুটা হলেও স্বস্তি পাবে।

আইনস্টাইনের চিঠি
ছবি: লেখক

নোবেল সংলাপ শুনতে গিয়ে রাস্তা হারিয়ে ফেলেছিলাম। হন্যে হয়ে যখন রাস্তা খুঁজছি, তখন এক মোড়ে দাঁড়িয়ে নানাজনকে জিজ্ঞেস করছি, ‘কনফারেন্স সেন্টারটা কোথায়?’

এ কদিনের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, মানুষ খুব সাহায্য করে পথে। এ দিনেই কেন যেন ভাগ্য সহায় হচ্ছিল না। এ সময় এক নারীকে জিজ্ঞেস করায় তিনি সামনের দিকে হাত প্রসারিত করে বললেন, ‘এই তো কনফারেন্স সেন্টার।’

একেবারে কনফারেন্স সেন্টারের সামনে দাঁড়িয়েই দিশেহারা হয়ে ছিলাম!

খুব গোছানো একটি অনুষ্ঠান। এবারের নোবেল সংলাপের বিষয় ছিল খাদ্য। ‘আওয়ার প্লেট, আওয়ার প্ল্যানেট’ নামের এই সংলাপে অংশ নিয়েছেন এ বিষয়ের বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশের মুহাম্মদ ইউনূসসহ বিগত দিনের পাঁচজন নোবেল বিজয়ী এ সংলাপের বিভিন্ন সেশনে অংশ নেন। এখানে একটি কথা খুব ভালো লেগেছে। লিন্ডি ম্যাজেল সিবান্ডা বলেন, ‘দুটো বিষয়ে আমাদের ভাবতে হবে। একটি হলো, খাবারের বৈচিত্র্য বাড়াতে হবে। অন্যটি হলো, অন্তত সপ্তাহে একবার সবাই মিলে বসতে হবে, একসঙ্গে রান্নাবান্না করতে হবে এবং একসঙ্গে টেবিলে বসে খেতে হবে।’

সত্যিই একসঙ্গে বসে খাওয়ার অভ্যাসটা যেন চলে যাচ্ছে আমাদের।

কত বিষয়ে যে কথা হলো! সবচেয়ে বড় কথা, এত দ্রুত বিষয়ের পর বিষয়ে গিয়ে একেকটা সংলাপ হলো, কিন্তু তা কী পরিচ্ছন্ন, একেবারে ঘড়ির সময়ে বাঁধা!

পরদিন ১০ ডিসেম্বর ছিল নোবেল পুরস্কার দেওয়ার দিন। এই দিন আলফ্রেড নোবেলের মৃত্যুবার্ষিকীও। এ দিন সুইডেনের রাজা কার্ল গুস্তাফ নোবেল বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেন। এই দিনের আকর্ষণ ছিল প্যাটি স্মিথের কণ্ঠে বব ডিলানের গান। ভোজসভায় ডিলানের বক্তৃতা পড়ে শোনানো হয়।

নোবেলজয়ীদের স্বাক্ষরিত চেয়ার
ছবি: লেখক

তুষারপাত

শেষ দুই দিন তুষারে ছেয়ে গিয়েছিল স্টকহোম। আকাশ থেকে অঝোর ধারায় ঝরছিল তা। পায়ের নিচে শুভ্র তুষারের স্তূপ। রাস্তাঘাটে কমে গেছে গাড়ির গতি।

শীত থেকে বাঁচার উপায় জানা ছিল অভিজ্ঞতা থেকেই। পা, বুক আর মাথা (কানসহ, কান টানলে মাথা আসে, কথাটা তো সবারই জানা) ভালো করে ঢেকে বের হলে ঠান্ডা কাউকে কাবু করতে পারে না।

তীব্র তুষারপাতের মধ্যেও নোবেল মিউজিয়ামের সামনে উৎসুক মানুষের কমতি নেই। নোবেল পুরস্কার আর আশু ক্রিসমাসের যুগপৎ আনন্দে তাঁদের মন এখন উড়ছে।

(কিশোর আলোর জানুয়ারি ২০১৭ সংখ্যায় প্রকাশিত)