পাঁচ পাঁচালি

সংখ্যাদের কি বিয়ে হয়? প্রশ্নটি অনেকের কাছেই আজগুবি মনে হবে। কিন্তু উত্তরদাতা গ্রিক পণ্ডিত পিথাগোরাস হলে বলতেন: হ্যাঁ, পারে। তিনি বিশ্বাস করতেন, পাঁচ হচ্ছে প্রথম বিবাহিত পুরুষ সংখ্যা। কারণ, প্রথম নারী সংখ্যা (২) ও পুরুষ সংখ্যা (৩) যোগ করে সংখ্যাটি পাওয়া যায়। পাঁচ বিবাহিত কি না তা গণিতবিদেরা জানেন না। তবে গণিতের দৃষ্টিতে ৫ মৌলিক সংখ্যা। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ইংরেজিতে  Prime লিখতেও লাগে পাঁচটি বর্ণ। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে পাঁচের অনেক গুরুত্ব। যারা কথাটা শুনে অবাক হচ্ছ, তাদের জন্যই আজকে পাঁচ নিয়ে একটু প্যাঁচাল।

মানবদেহের দিকে তাকালেই এর সত্যতা বোঝা যাবে। আমাদের প্রতি হাতে-পায়ে আঙুল পাঁচটি। অনেকের মতে, হাতের আঙুল ছাড়ালে ভি-এর মতো দেখায় বলেই পাঁচ বোঝাতে রোমানরা ভি ( V) চিহ্ন ব্যবহার করেছিল। পাঁচ ঘাপটি মেরে আছে খামচাখামচির মধ্যেও। শব্দটি এসেছে আরবি  খমস থেকে, যার অর্থ পাঁচ। খামচি দিলে পাঁচ নখের দাগ ফুটে উঠে। সে কথা মাথায় রেখেই বাংলায় খামচাখামচির উৎপত্তি। আঙুলের মতো মানুষের ইন্দ্রিয়ও পাঁচটি। চোখ, কান, নাক, ত্বক ও জিহ্বা এ পাঁচটিকে একত্রে বলে পঞ্চেন্দ্রিয়। এদের মধ্যে স্বাদ বোঝা যায় জিহ্বা দিয়ে। জিহ্বায় প্রায় ১০ হাজার স্বাদকঁুড়ি থাকলেও বয়সকালে কমে পাঁচ হাজারে এসে দাঁড়ায়। আগে ধারণা ছিল, জিহ্বায় চারটি স্বাদ বোঝা যায়। তবে আধুনিক গবেষকদের দাবি পাঁচটি: মিষ্টি, লবণ, তিতা, টক ও উমানি। জাপানি উমানি অর্থ মসলাদার বা সুগন্ধি স্বাদ। টমেটো, স্পিনাজ, সবুজ চা, চীনা বাঁধাকপি, বুকের দুধে আছে উমানি স্বাদ।

এদিকে, পূর্ণবয়স্ক মানুষের দেহে পাঁচ-ছয় লিটার রক্ত থাকে। পুরো রক্ত বিশুদ্ধ করতে কিডনির সময় লাগে মাত্র পাঁচ মিনিট। কিডনি বা পুরো শরীর ভালো রাখতে দিনে পাঁচ লিটার পানি প্রয়োজন। কিডনি আর দেহত্বক দিয়ে প্রতি দুদিনে গড়ে পাঁচ লিটার পানি বেরিয়ে যায়। মজার ব্যাপার হচ্ছে, দেহত্বক বা চামড়া খুলে ওজন করা সম্ভব হলে তা হতো পাঁচ পাউন্ড। সুস্থ থাকার জন্য প্রতিদিন হাঁটা খুবই দরকার। হিসেবে দেখা গেছে, মানুষ সারা জীবনে যে পরিমাণ হাঁটে, তা পাঁচবার পৃথিবীর চারদিকে ঘুরে আসার সমান। এমন আজব তুলনায় অনেকের হাসি পেতে পারে।

তবে জেনে রাখা ভালো, হাসাও সোজা নয়। কারণ, হাসিতে মুখের অন্তত পাঁচ জোড়া পেশি ব্যবহার করতে হয়। বেশি হাসিতে লাগে ৫৩টা পেশি। তবে রাগ করা আরও কঠিন। গোমড়া থাকলে মুখের ৫৬টি পেশিকে খাটতে হয়। সে বড় ঝক্কি আর শক্তিক্ষয়ের কাজ। পরীক্ষায় দেখা গেছে, রাগ করলে দেহের যে শক্তি খরচ হয়, তা দিয়ে ২৫ ওয়াটের একটি বাল্ব পাঁচ মিনিট জ্বালানো যায়। তাই রেগেমেগে দেহের বিদ্যুৎ অপচয়ের কী মানে! তারচেয়ে সুযোগ পেলে আকাশে তাকিয়ে থাকার পরামর্শ দেন বিজ্ঞজনেরা। তাতে নাকি মন উদার হয়। এ কথায় সন্দেহ থাকলেও, রাতের আকাশে খালি চোখে প্রায় পাঁচ হাজার তারা দেখা যায়, সেটি কিন্তু মিথ্যে নয়। বিশ্বাস না হলে যে কেউ গুনে দেখতে পারে। অবশ্য আকাশে তারা আর মাথার চুল গোনা প্রায় সমান কঠিন। কারণ, মাথায় চুল আছে প্রায় ১০ লাখ। প্রতিবছর চুল পাঁচ ইঞ্চি করে বাড়ে, আর তা টিকে থাকে পাঁচ বছর।

মানুষের মতোই স্টারফিসের পা বা বাহুও পাঁচটি। ওদের দেহের গড়ন এমন যে ওগুলো হাত নাকি পা তা বির্তকের বিষয়। এদিকে কেঁচোজাতীয় প্রাণীর হৃৎপিণ্ড সাধারণত পাঁচটি। কিছু জিরাফ প্রজাতির মাথায় থাকে পাঁচটি শিং। এদিকে চেঁচামেচিতে এগিয়ে আছে বনের রাজা সিংহ। এদের গর্জন পাঁচ মাইল দূর থেকেও দিব্যি শোনা যায়। সিয়ামাং প্রজাতির বনমানুষের ডাকও শোনা যায় পাঁচ মাইল দূর থেকে। তবে এককাঠি সরেস মৌমাছি। মাত্র পাঁচ লিটার মধু খেয়ে একঝাঁক মৌমাছি পাড়ি দিতে পারে ৪০ হাজার মাইল।

পৃথিবীতে আমাদের বাস ত্রিমাত্রিক জগতে। এর সঙ্গে বিজ্ঞানী আইনস্টাইন সময় যোগ করে বললেন, জগৎ চার মাত্রার। এখন অনেকে তথ্যকে আরেক মাত্রা ধরে জগৎ পাঁচ মাত্রার বলে দাবি করেন। প্রাচীন জ্যোতির্বিদেরা বুধ, শুক্র, পৃথিবী, মঙ্গল ও বৃহস্পতি—মাত্র এ পাঁচটি গ্রহ সম্পর্কে জানতেন। সে কারণেই সপ্তাহের বারের নামে এ গ্রহগুলো মিশে আছে। এখনো জ্যোতিষীরা এ পাঁচ গ্রহ এবং সূর্য (রবি) ও চাঁদ (সোম) দিয়ে মানুষের ভাগ্য নির্ণয় করেন। বুধ গ্রহ বোঝাতেও পাঁচ ব্যবহার করেন তাঁরা।

এদিকে, প্রাচীন ভারতীয় জ্যোতির্বিদ্যা মতে, পৃথিবী পাঁচ ভুতে বা উপাদানে গঠিত: মাটি, পানি, শক্তি, বাতাস ও আকাশ। মৃত্যুকে বলে পঞ্চত্বপ্রাপ্তি। কারণ, মৃত্যুর পর দেহ পাঁচভুতে মিশে যায়। বৌদ্ধধর্মের ও চীনসহ পূর্ব-এশিয়ার অনেক দেশের বিশ্বাস, পৃথিবী পাঁচ উপাদানে গঠিত। প্রধান পাঁচ ধর্ম ইহুদি, খ্িরষ্টান, ইসলাম, হিন্দু ও বৌদ্ধধর্মে পাঁচ তাৎপর্যপূর্ণ। আবার সংখ্যাটি শিখ, জৈন ও কুনফুসিয়ানিজমেও গুরুত্বপূর্ণ। মধ্যযুগে শয়তান ও ডাইনি তাড়াতে ইউরোপে পাঁচ বাহুবিশিষ্ট তারা পেন্টাগ্রাম বা পেন্টাকল প্রতীক ব্যবহার হতো। বাহাই, খ্িরষ্টান, তাও, থেলেমা, ফ্রিমেসোনারি ও উইক্কা ধর্মে এবং শয়তান উপাসকদের কাছেও গুরুত্বপূর্ণ পেন্টাগ্রাম। তবে পেন্টাগন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা সদরদপ্তরের নাম। ভবনটি পাঁচকোনা বলেই এমন নাম। আর জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য পাঁচটি। যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ব্রিটেন, ফ্রান্স ও চীন। এ পাঁচ সদস্যকে বলে বিগ ফাইভ।

তবে ফোমাস ফাইভ কোনো সংগঠন নয়, এটি ব্রিটিশ লেখিকা এনিড ব্লাইটনের বিখ্যাত গোয়েন্দা সিরিজের নাম। এতে পাঁচ খুদে গোয়েন্দা জুলিয়ান, ডিক, অ্যান, জর্জিনা আর তাদের কুকুর টিমি নানান অ্যাডভেঞ্চারে অংশ নেয়। রকিব হাসানের তিন গোয়েন্দা সিরিজে কিশোর, মুসা, রবিনের সঙ্গে জিনা আর কুকুর রাফিয়ান যোগ দিলেও হয়ে যেত পাঁচজনের গোয়েন্দা দল। এই সিরিজের পাঁচ গোয়েন্দার কাহিনি লেখা হয়েছিল ব্লাইটনের ফেমাস ফাইভ অবলম্বনে।

একইভাবে বাংলাদেশের আলী ইমামের দুঃসাহসী পাঁচ কিশোরের গোয়েন্দা সিরিজ ‘দুঃসাহসী পাঁচ’। এতে কিশোর গোয়েন্দারা হচ্ছে তকি, আশরাফ, আকরাম, ফয়সাল আর লিপন। ভারতের পশ্চিমবাংলার লেখক ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়ের লেখা ‘পাণ্ডব গোয়েন্দা’ সিরিজও পাঁচ খুদে গোয়েন্দার রহস্য অভিযানের গল্প। খুদে পাঁচ গোয়েন্দার নাম বাবলু, বিলু, ভোম্বল, বাচ্চু আর বিচ্ছু। বিখ্যাত কার্টুন সিরিজ ‘স্কুবি ডু’তেও আছে খুদে পাঁচ গোয়েন্দা। কুকুর স্কুবিসহ বাকিরা হচ্ছে ফ্রেড জোনস, ড্যাপনে ব্লেক, ভেলমা ডিঙ্কলে আর শ্যাগি।

আগেই বলেছি, পিথাগোরাসের বিশ্বাস ছিল, পাঁচ বিবাহিত সংখ্যা। তবে পাঁচ বিবাহবার্ষিকী পালন করে কি না তা জানা না গেলেও অনেক বিবাহিত প্রতিবছর পালন করে। বিয়ের পাঁচ বছর পূর্তিকে বলে কাঠবার্ষিকী। অন্য কিছুর বর্ষপূর্তিতেও শব্দটির ব্যবহার চলে। পাঁচ নিয়ে এমন মজা ছড়িয়ে আছে চারদিকে। আজ নয় সেসব পাঁচমিশালি গল্প, কোনো এক কাঠবর্ষের জন্য তোলা রইল।

সূত্র: ওয়েবসাইট