পাহাড়ধসের ভয়াল দিনগুলো

জুন ১৩ তারিখ একটু অসুস্থ ছিলাম বলে আর কলেজে যাইনি। বাসায় বসে বসে ফেসবুকে নিউজফিড দেখছিলাম। হঠাত্ একজনের পোস্ট দেখে শিউরে উঠলাম আমি। ভোররাতে প্রবল বৃষ্টিতে ভূমিধস হয়েছে রাঙামাটিতে। আমার এক পিসতুতো ভাই মাটিচাপায় মারা গেছে ঘুমন্ত অবস্থায়। স্বজনের মৃত্যু! চোখের পানি আটকাতে পারলাম না। দিদি আর আমি দুজনেই কাঁদতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পর শান্ত হলাম। মা-বাবাসহ বাসার কাউকেই ফোনে পাওয়া যাচ্ছিল না। খুবই চিন্তা হচ্ছিল বাসার সবার জন্য। ফেসবুকেই খবর পেলাম, পা কেটে গেছে ছোটবোনের বান্ধবী তারুমীর। কী ভয়াবহ ব্যাপার! অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন এল রাতে। ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে শুনতে পেলাম মায়ের কণ্ঠ। কী যে ভালো লাগল!  মা বললেন, ‘আমরা সবাই এখন ভাবনা কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছি। তোমরা, আমাদের জন্য চিন্তা করো না, কেমন? পরে কথা হবে।’ কিন্তু মন মানছিল না কিছুতেই। শুধু মানুষের মৃত্যুর খবর পাচ্ছিলাম। ১৪ তারিখ পত্রিকায় দেখলাম, ১২৬ জন মারা গেছে পাহাড়ধসে। পরিচিত লোকজনের মুখ ভেসে উঠছিল শুধু। কিন্তু কিছু করার ক্ষমতাও নেই আমার। রাস্তার অবস্থাও খারাপ। সবকিছু সামলে অবশেষে ১৭ তারিখ রওনা দিলাম রাঙামাটির উদ্দেশে। ১৮ তারিখ ভোরবেলা পৌঁছালাম। একটা সিএনজিচালিত অটোরিকশা নিয়ে সরাসরি চলে গেলাম রাঙাপানির মোনাঘর ভাবনা কেন্দ্রে। একটা বৌদ্ধবিহার এটা। এখানেই আশ্রয় নিয়েছে আমাদের পরিবার। আমিও মিশে গেলাম আশ্রয়কেন্দ্রের সীমাবদ্ধ জীবনে।     

প্রথম দিন

অটোরিকশা থেকে নামার সময় সঙ্গে দিদি আর বাবা ছিলেন। আকাশের অবস্থা ভালো নয়। গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে। আমরা এসেছি বলে বর্ষামুনু, ভাইয়া, কাকিমা, ভাবি, পিসিমা সবাই খুশি। একসঙ্গে কথা বলে উঠল অনেকে। আমার ছোট বোন বলল, ‘জানো দিদি, ওদের বাড়িটা ঠিক এভাবেই ধসে পড়েছিল।’ কে যেন বলল, ‘জানো দিদি, ও এভাবেই মাটির নিচে চাপা পড়ে গিয়েছিল।’ কানে বাজল কাকিমার কথাটা, ‘আমাদের এখানে ত্রাণও দিতে আসে। কখনো ভাবিনি এমন পরিস্থিতির সামনে এসে পড়ব!’

অনেক লোক! কীভাবে ঘুমাব! কীভাবে গোসল করব! টয়লেটেরই বা কী অবস্থা, কিছুই জানি না। সেনাবাহিনীর গাড়ি আসছে-যাচ্ছে। পানি, খাবারের ব্যবস্থা করে দিতে। বন্ধুসভা থেকেও ত্রাণ দিতে লোক আসছে। শ্রাবস্তী মাসি দেখতে এসেছিলেন আমাদের! তবু মন বসছে না একটুও! বাইরে যাচ্ছি, আবার আসছি ভেতরে। মনটা অস্থির হয়ে উঠছে বারবার। স্থির করতেই পারছি না! ব্যাংকে একটু কাজ ছিল, কাকার সঙ্গে বের হলাম। ফেরার পথে দেখলাম সেই জায়গাটা, যেখানে ঘুমোচ্ছিল ছোট ভাইটা। সৃষ্টিকর্তা ওকে তাঁর কাছেই নিয়ে গেছেন!

কী সুন্দর বাসা ছিল! দু-তিন বছর হবে, নিচ দিয়ে নেমে গেছে রাস্তাটা। এখন ৮-১০টা বাড়ির চিহ্নই খুঁজে পাওয়া মুশকিল! মাটির সঙ্গে মিশে গিয়ে একাকার হয়ে গেছে! আমার মতো আরও অনেকেই রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে ভূমিধসে ক্ষতিগ্রস্ত সেই স্বর্গীয় স্থানটিকে দেখছিল। কাকা বললেন, ‘ওই দিন বাসার সবাই ঘুমোচ্ছিলাম। যে ভাঙা বাড়িটা দেখছ, তা আমাদের বাড়ির পাশ দিয়েই মাটিতে গড়িয়ে পড়েছে। গলা পর্যন্ত ডুবে গিয়েছিল ও বাড়ির কর্তার বুড়ো মা! ফায়ার সার্ভিসকে কল দেওয়া হলো। রিসিভই করল না কেউ। চারদিকে একই সময়ে এত ধস হচ্ছিল, আর ফায়ার সার্ভিসের লোকও এত কম যে ওনাদের পক্ষে অসম্ভব ছিল সব দিক সামাল দেওয়া!’ অজান্তেই পানি ঝরতে লাগল চোখ দিয়ে! এ কী দেখতে হচ্ছে! তবে আমি একা নই! আড়ালে অশ্রু বিসর্জন দেওয়া মানুষের সংখ্যা অগণিত!

দ্বিতীয় দিন

ঘুমটা ভাঙল খুব ভোরে। চারদিকে একপলক তাকিয়েই ঘুমিয়ে পড়লাম আবার। রোদ উঠবে মনে হচ্ছে। মা, ভাবি, কাকিমা উঠে পড়লেন ভান্তেদের(সন্যাসী) স্বীয়ংয়ের জন্য রান্না করতে। সাড়ে ছয়টার দিকে উঠলাম ঘুম থেকে। প্রকৃতির শোভায় মনটা বেশ ভালোই লাগছে। হঠাত্ দেখলাম, সুবিধাভোগীরাও একে একে আসা শুরু করে দিয়েছে ত্রাণ নিতে। মন-মেজাজ খুবই খারাপ। গা জ্বলে এসব দেখলে।

তৃতীয় দিন

বাসাটা দেখতে ইচ্ছে করছে খুব। কাকিমা যাবেন শুনে আমিও গেলাম সঙ্গে। পুরো এলাকাটা খুব কাছ থেকে দেখতে লাগলাম। সেই সুন্দর, জীবিত এলাকাটা আজ প্রাণহীন। কে জানে, হয়তো খুব বেশি অহংকার করত সবাই। সে জন্যই আজ এই দশা! আবার বৃষ্টি শুরু হলো। এই মুহূর্তে এখানকার মানুষদের কাছে বৃষ্টি মানেই আতঙ্ক।

বেলা তিনটা বেজে গেছে। বাবা আর মা যাবেন বাসাটা পরিষ্কার করতে। আমি তো সুযোগ ছাড়ব না। বাসায় যাবই যাব। তিনজন একসঙ্গে রান্নাঘর পরিষ্কার শুরু করলাম। চারদিকে এত মাটির বন্যা যে একবার আমাদের পুরো এলাকাটা না দেখলে বোঝা যাবে না। বিকেলের দিকে রিবেং দাদারা ত্রাণ দিতে এলেন। রাত নেমে এল, এখনো বিদ্যুত্ নেই। যাক, তবু তো সবাই মিলে একসঙ্গে একই ছাদের তলায় খাবার খাচ্ছি, এটাই বা কম কী! পরিস্থিতি আরও খারাপও তো হতে পারত। সবাই ঠিক আছি, এ আনন্দটাই অন্য রকম। বেশ স্বস্তির একটা দিন গেল আজ।  তিন দিন পর দুবার বাসায় গিয়েছিলাম আজ। আমাদের বাসা।

চতুর্থ দিন

দুর্গত মানুষকে সহায়তা করতে রাঙা সংগঠনের ভাইয়াদের সঙ্গে ত্রাণ দিতে গেলাম উলুসরা এলাকায়। খুবই শোচনীয় ওখানকার অবস্থা। সব ফসল পানিতে ডুবে একাকার। পাহাড়গুলো দিয়ে যেন মাটির ঝরনা গড়িয়ে পড়ছে।  বড় দুই দিদি রাঙামাটি এসেছেন আজ। এখন পরিবার পরিপূর্ণ। সব ভাইবোন একসঙ্গে। একই ছাদের তলায়! ১৩ জুনের ভয়ংকর ঘটনার কাহিনিগুলো নিয়ে আড্ডা বসেছে। একটু দেরিই হলো ঘুমাতে।

পঞ্চম দিন

দিদির সঙ্গে আজও বাসায় গিয়েছি দুবার। ভয়াল সেই ঘটনার পর আজই প্রথম বাসায় এল দিদি। ডিসি আসবেন, তাই একটু কাজ সেরে ফিরলাম আশ্রয়কেন্দ্রে। আজ ইউনিসেফ থেকেও এসেছে ত্রাণ দিতে। ছোট কাকা একটা কথা বলতেন, ‘যেখানে টাকা, সেখানেই ঝামেলা।’ আসলেই তা-ই! নিজের চোখে দেখলাম সবকিছু। সুবিধাবাদীর সংখ্যাই বাড়ছে শুধু! অসহ্য! আজও একগাদা সুবিধাবাদীর দল এসে হাজির! দুপুরের খাওয়া শেষে থালা-বাসন ধুতে গিয়ে এক সুবিধাবাদী ভদ্রমহিলা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘শোনো, তোমাদের বাসা কি একেবারেই ভেঙে গিয়েছে?’ আমি বললাম, ‘আমাদের বাসা তো ভাঙেনি। বাসার ভেতর মাটি আর পানির বন্যা হয়েছে মাত্র। নিরাপদ আশ্রয়ের জন্যই এখানে অবস্থান আমাদের। আচ্ছা নানি, আপনাদের বাসা কি ভেঙে গেছে?’ তিনি বললেন, ‘আর বইলো না, বাসার তেমন কিছু হয় নাই, তবে বাথরুমটা ভেঙেই গিয়েছে একেবারে, কী আর করব বলো?’ মন খারাপ হয়ে গেল আমার। মানুষ এমন হয়ে যাচ্ছে কেন দিন দিন?

মায়ের মনটাও খুব খারাপ। একপর্যায়ে বলেই ফেললেন, ‘আমরা কুকুরের মতো করে খাচ্ছি এখানে! সবার উচ্ছিষ্ট খাবার খেতে হচ্ছে আমাদের শুধু বাঁচার জন্য! ’ কথা সত্য, কিন্তু কিছু তো করারও নেই। কাকিমা গর্ভবতী। এ মাসেই ডেট পড়েছে তাঁর। প্রেশারটা বেড়ে গেছে। অনেক ঝামেলা। অনেক কষ্ট। সবচেয়ে বেশি মানসিক অশান্তি। তবে হ্যাঁ, একটাই ভালো ব্যাপার যে সবাই একসঙ্গে আছি। একসঙ্গে থাকলে সব অশান্তি দূর হয়ে যায়!

পরের দিনগুলোও ছিল একই রকম। আশ্রয়কেন্দ্রেই কাটাতে হলো আরও পাঁচটা দিন। এর মাঝে যতটুকু সম্ভব ঠিকঠাক করে নিলাম বাসাটা। অবশেষে ৩০ তারিখ বাসায় এলাম সবাই। খুবই ভালো লাগছে যে বাসায় আসতে পেরেছি। যদিও আমার আর দিদির জন্য সেটা ক্ষণিকের প্রাপ্তি—সেদিনই রওনা দিতে হলো ঢাকার উদ্দেশে। এখনো মন কাঁদে বাসার জন্য। আর বৃষ্টি! এমন এক বৃষ্টিস্নাত রাতেই তো ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল আমার মাতৃভূমি। প্রাণ হারিয়েছে প্রায় দেড় শ মানুষ। তাই বৃষ্টি মানেই সেই ভয়ানক দিনগুলোর স্মৃতি। তবু বৃষ্টি হোক, কিন্তু এমন ঘটনা যেন আর কারও জীবনে না ঘটে।

লেখক : শিক্ষার্থী, হলি ক্রস কলেজ, ঢাকা