
‘গুয়ের্নিকা’ কী? অনেকেরই হয়তো জানা। পাবলো পিকাসোর আঁকা একটি ছবির নাম। গুয়ের্নিকা আবার একটি শহরের নামও। উত্তর স্পেনের এই শহরটির একটি বিশেষ সময়ের গল্পই পিকাসো এঁকেছেন তাঁর এই ছবিতে। গুয়ের্নিকা প্রায় ৭০০ বছরের পুরোনো শহর হলেও পিকাসোর আঁকা ছবিটির ১০০ বছরও হয়নি। কিন্তু এই ছবিটি দুনিয়াজুড়ে এতই বিখ্যাত যে এখন ‘গুয়ের্নিকা’ বললে শহরটির আগে পিকাসোর ছবিটির কথাই সবার মাথায় আসে। গুয়ের্নিকা আর পিকাসোর গল্পটি তো আমাদের জানা দরকার।
১৯৩৬ সালের জুলাই থেকে ১৯৩৯ সালের এপ্রিল পর্যন্ত প্রায় তিন বছর এক গৃহযুদ্ধ হয়েছিল স্পেনে। নিজ দেশের দুই পক্ষের ক্ষমতা দখলের লড়াই। ভোটের মধ্য দিয়ে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠার পক্ষ নিয়েছিল প্রজাতন্ত্রপন্থী বা রিপাবলিকানরা, আর এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল জাতীয়তাবাদীরা। স্পেনের শিল্পী-সাহিত্যিকদের অনেকেই তখন রিপাবলিকানদের পক্ষ নিয়েছিলেন। শিল্পী পাবলো পিকাসোর সমর্থনও ছিল রিপাবলিকানদের পক্ষে। ১৯৩৭ সালের ২৬ এপ্রিল জাতীয়তাবাদীদের পক্ষ নিয়ে জার্মান নািস ও ইতালির ফ্যাসিস্ট বিমানবাহিনী গুয়ের্নিকা শহরে বিমান হামলা চালায়। মারা যায় শত শত বেসামরিক নাগরিক। আহত ও পঙ্গু হয়ে যায় অসংখ্য মানুষ।
এবার পিকাসোর গল্প। ছবি আঁকবেন বলেই যেন জন্ম হয়েছিল তাঁর। স্পেনের আন্দালুশিয়া অঞ্চলের মালাগাতে জন্ম নেওয়া পিকাসো যখন শিশু, তখন থেকেই তাঁর বাবার কাছে আঁকাআঁকি শেখা শুরু করেন। বয়স ১৪ হতে না হতেই হয়ে ওঠেন একজন পুরোদস্তুর ছবি আঁকিয়ে। সেই বয়সে তাঁর আঁকা ‘পোর্ট্রেট অব আন্ট পেপা’ ছবিটি সম্পর্কে স্প্যানিশ কবি ও শিল্প সমালোচক জ্যঁ এদুয়ার্দো শার্লি মন্তব্য করেছিলেন, সন্দেহ নেই এটা স্প্যানিশ আর্টের ইতিহাসে অন্যতম শ্রেষ্ঠ একটি কাজ।
এভাবে যাঁর শুরু, তাঁকে আর থামাবে কে! ১৯ বছর বয়সে পিকাসো চলে আসেন ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে। শিল্পী-সাহিত্যিকদের বসবাসের জন্য এটাই তখন ইউরোপের সেরা জায়গা। শুরুতে কিছুদিন আসা-যাওয়ার মধ্যে থাকলেও এরপর তিনি ফ্রান্সেই পাকাপাকিভাবে থাকা শুরু করেন। ১৯৩৬ সালে স্পেনে যখন গৃহযুদ্ধ শুরু হয়, তখনো প্যারিসেই থাকেন পিকাসো।
তত দিনে প্যারিস, ইউরোপের নানা দেশ ছাড়িয়ে যুক্তরাষ্ট্রেও চিত্রশিল্পী হিসেবে খ্যাতি আর সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে পিকাসোর। এমন একজন শিল্পীকে তাঁর দেশ স্পেন হারাতে চাইবে কেন! তখন স্পেনের রাজধানী মাদ্রিদের সবচেয়ে বড় বিখ্যাত আর্ট মিউজিয়াম হচ্ছে প্রাদো। পিকাসোকে এর সম্মানসূচক প্রবাসী পরিচালকের দায়িত্ব দিয়ে রেখেছিল স্পেনের প্রজাতন্ত্রী সরকার। ১৯৩৭ সালে ফ্রান্সে যখন আন্তর্জাতিক শিল্প প্রদর্শনী ‘প্যারিস ইন্টারন্যাশনাল এক্সপোজিশন’ আয়োজনের প্রস্তুতি চলছে, স্পেন তখন গৃহযুদ্ধের মধ্যে। স্পেনের পক্ষ থেকে একটি ম্যুরাল তৈরি করে সেখানে অংশ নেওয়ার জন্য দেশটির প্রজাতন্ত্রী সরকার দায়িত্ব দিয়েছিল পিকাসোকে। এরই মধ্যে ২৬ এপ্রিল গুয়ের্নিকায় ঘটে যায় সেই ভয়াবহ বিমান হামলা। ২৮ এপ্রিল দ্য টাইমস ও দ্য নিউইয়র্ক টাইমস-এ প্রকাশিত এই বিমান হামলার বিবরণ পড়ে থমকে যান পিকাসো। প্যারিস প্রদর্শনীতে অংশ নেওয়ার জন্য তিনি যে ম্যুরাল আঁকার পরিকল্পনা করেছিলেন, তা সঙ্গে সঙ্গে বাদ দেন। প্রদর্শনীর তখন মাত্র মাস খানেক বাকি। তাঁর মাথায় ঘুরছে গুয়ের্নিকার ভয়াবহ ঘটনা। মে মাসের ১ তারিখ, তিনি এই বিষয় নিয়ে একটি পেইন্টিংয়ের স্কেচ করা শুরু করেন। এভাবেই জন্ম নেয় পৃথিবীর বিখ্যাত ছবি ‘গুয়ের্নিকা’। পিকাসোর সবচেয়ে আলোচিত ছবিগুলোর একটি।
জুনের মাঝামাঝি সময়ে শেষ হয় সাদা, কালো ও ধূসর রঙে আঁকা সাড়ে তিন মিটার উঁচু ও প্রস্থে ৭ দশমিক ৮ মিটার দীর্ঘ এই বিশাল ছবি। প্যারিস ইন্টারন্যাশনাল এক্সপোজিশনে ছবিটি স্প্যানিশ বিভাগে প্রদর্শিত হয়। এরপর শুরু হয় পৃথিবীর বড় বড় জাদুঘরে ছবিটির প্রদর্শনী।
কী আছে গুয়ের্নিকা ছবিটিতে? মানুষ ও প্রাণীর আর্তনাদ, দুর্দশা আর হাহাকারের ছবি গুয়ের্নিকা। যেখানে সহিংসতায় দুমড়ে-মুচড়ে গেছে বাড়িঘর। মনোযোগ দিয়ে দেখলে এ ছবিতে নারী, মৃত শিশু, ষাঁড়, ঘোড়া, মানুষের মাথার খুলি, মৃত যোদ্ধা, তরবারি, নির্যাতনকেন্দ্রের বাল্ব, এমনকি ফুল—নানা কিছুই চোখে পড়বে। সমালোচকেরা এই ছবির নানা দিক খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে নানা ব্যাখ্যা দিয়েছেন। এসব পড়লে ছবিটিকে নানাভাবে দেখা যায়, তবে নিজে মনোযোগ দিয়ে দেখলে যা অনুভব করা যায়, সেটাই আসল কথা।
ইউরোপের নানা দেশ, ব্রাাজিল ও যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন রাজ্য ঘুরে ১৯৫৬ সালে ছবিটির একটি স্থায়ী জায়গা হয় নিউইয়র্কের মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্টে (মমা)। এরই মধ্যে যুদ্ধবিরোধী ছবি হিসেবে দুনিয়াজুড়ে পরিচিতি পেয়ে যায় গুয়ের্নিকা। স্পেনের গৃহযুদ্ধে গণতন্ত্রকামী প্রজাতন্ত্রীদের হটিয়ে জেনারেল ফ্রাঙ্কোর নেতৃত্বে স্বৈরশাসন জেঁকে বসলে দেশের সঙ্গে সম্পর্ক চুকে যায় পিকাসোর। ১৯৬৮ সালের দিকে ফ্রাঙ্কো ‘গুয়ের্নিকা’ ছবিটি স্পেনে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পিকাসোর শর্ত, জনগণের প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত তাঁর ‘গুয়ের্নিকা’ স্পেনে ফিরবে না।

স্পেনে গণতন্ত্র ফিরে আসার আগেই ১৯৭৩ সালে মারা যান পিকাসো। এর দুই বছর পর স্বৈরশাসক ফ্রাঙ্কোর মৃত্যু সেখানে গণতন্ত্র ফিরে আসার পথ তৈরি করে। কিন্তু নিউইয়র্কের মমা এই অমূল্য সম্পদটিকে তাদের হাতছাড়া করতে চায়নি। মমা কর্তৃপক্ষ ও স্পেনের সরকারের মধ্যে অনেক দেনদরবারের পর ১৯৮১ সালে পিকাসোর জন্মশতবার্ষিকীতে ‘গুয়ের্নিকা’ ফিরে আসে স্পেনে। বোমা ও বুলেটপ্রুফ কাচের পেছনে পিকাসোর জন্মদিনে (২৫ অক্টোবর) ছবিটি স্পেনের দর্শকদের সামনে হাজির করা হয়। প্রথম বছরেই ১০ লাখ দর্শক ছবিটি দেখতে আসেন। ১৯৯২ সাল থেকে ছবিটি দর্শকদের জন্য স্থায়ীভাবে রাখা হয়েছে মাদ্রিদের রেইনা সোফিয়া মিউজিয়ামে। এখনো ছবিটির সামনে দর্শকদের ভিড় লেগেই থাকে।