পৃথিবীর ‘ওজন’ মাপল কীভাবে?

পল্টু আজকাল আমাকে প্রশ্ন করে ঘায়েল করতে চেষ্টা করে মাঝেমধ্যে। একদিন জানতে চাইল, পৃথিবীর ওজন কত? আমি বললাম, শূন্য। পল্টু তো অবাক, ওর মতো পিচ্চির ওজন ৩১ কেজি, আর এত বড় পৃথিবীর ওজন শূন্য! তখন ওকে বুঝিয়ে দিলাম, ৩১ কেজি হলো ভর, ওজন না। ওজন হলো পৃথিবী ওকে যে বলে টানছে তা। পৃথিবী নিজেকে তো আর টানছে না, তাই পৃথিবীর ওজনও নেই।

এবার কিন্তু পল্টু আমাকে বিপদেই ফেলল, পৃথিবীর ভরটাই বা মাপল কীভাবে? এত বড় দাঁড়িপাল্লা কোথায় আছে, সেটা ঝোলানোই বা যাবে কোথায়? জানালাম, অঙ্ক কষে মাপা হয়েছে পৃথিবীর ভর। অঙ্ক করে পৃথিবীর ভর মাপা যায়! ব্যাপারটা হজম করা একটু কঠিন। তাই কাগজ-কলম নিয়ে বসলাম। পুরোটা লিখে বোঝানো যাক।

আমাদের পৃথিবীটা কিন্তু গোল। আড়াই হাজার বছর আগের কথা, গ্রিসের বিজ্ঞানীরা প্রথম বুঝতে পারেন পৃথিবীটা গোল। ব্যাপারটা তাঁরা বুঝেছিলেন সহজ একটা বুদ্ধি দিয়ে। অ্যারিস্টটলের মতো বিজ্ঞানীরা দেখলেন, অর্ধেক চন্দ্রগ্রহণের সময় চাঁদের ওপর পৃথিবীর যে ছায়া পড়ে, তা গোলাকৃতির। আর এটা বোঝা তো সহজ, কোনো কিছুর ছায়া গোল হলে সেটা নিশ্চয় গোলই হবে।

কেমন গোল? অনেকটা কমলালেবুর বা ফুটবলের মতো। ফুটবলের ওপর হাঁটতে গিয়ে পিঁপড়া কিন্তু পড়ে যায় না। আমরাও পৃথিবীর ওপর তেমন হেঁটে বেড়াই। অভিকর্ষ বল দিয়ে পৃথিবী আমাদের টেনে রাখে। আমরাও পড়ে যাই না।

চাঁদের ওপর পৃথিবীর গোল ছায়া

পৃথিবীটা কত বড়?

গোল পৃথিবীটা আসলে কত বড়? গোলাকৃতির কিছু কত বড়, তা বোঝা যায় তার ব্যাসার্ধ দিয়ে। গোল কোনো বস্তুর কেন্দ্র থেকে পৃষ্ঠ পর্যন্ত দূরত্বই হলো ব্যাসার্ধ। তাই পৃথিবী কত বড়, তা বুঝতে হলে আমাদের মাপতে হবে তার ব্যাসার্ধ। কাজটি করা সহজ নয়। গর্ত করে তো আর পৃথিবীর কেন্দ্রে পৌঁছানো যাবে না। তবে উপায়? উপায় হচ্ছে জ্যামিতি। জ্যামিতি করে মেপে ফেলা যায় এই ব্যাসার্ধটাও।

পৃথিবী কত বড়, তা প্রথম মেপেছিলেন ইরাটোস্থেনিস। প্রায় ২ হাজার ২৫০ বছর আগে, ২৫০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে। তিনি ছিলেন মিসরের আলেক্সান্দ্রিয়া লাইব্রেরির প্রধান গ্রন্থাগারিক। তিনি জানতে পারলেন, সায়িন শহরে বছরের সবচেয়ে বড় দিনে মধ্য দুপুরে সূর্য থাকে একদম মাথার ওপর। সোজা হয়ে দাঁড়ালে কোনো ছায়া পড়ে না মানুষের। এদিকে আলেক্সান্দ্রিয়ায় যেহেতুু সূর্য সোজা মাথার ওপর থাকবে না, তাই সবকিছুর একটা ছায়া ঠিকই দেখা যাবে। ইরাটোস্থেনিস একটা বুদ্ধি করলেন, আলেক্সান্দ্রিয়ায় ছায়াটা কত ডিগ্রি কোণ বানাচ্ছে, তা মেপে ফেললেন। দেখা গেল কোণের মান হচ্ছে ৭ দশমিক ২ ডিগ্রি।

বাকি কাজটুকু জ্যামিতির। জ্যামিতি দিয়ে প্রমাণ করা যায় সায়িন ও আলেক্সান্দ্রিয়া পৃথিবীর কেন্দ্রে যে কোণ উৎপন্ন করে, তা ওই ছায়ার কোণের সমান। ওই কোণ দুটোকে বলে একান্তর কোণ। আমাদের ক্লাস সিক্সের বইয়ে কিন্তু এই উপপাদ্যটা আছে। চাইলে তুমিও প্রমাণ করে ফেলতে পারো।

এবার একটা পিৎজার কথা চিন্তা করা যাক। ধরো আমরা পিত্জাটা স্লাইস করে কাটব। এমনভাবে কাটলাম যাতে প্রতিটি স্লাইসের কোণটা ৭ দশমিক ২ ডিগ্রি হয়। কত স্লাইস হবে বলতে পারো? পিৎজার মোট কোণ ৩৬০ ডিগ্রি। ৩৬০ কে ৭ দশমিক ২ দিয়ে ভাগ করলেই পাবে কয়টা স্লাইস হবে। মোট ৫০টা। অর্থাৎ আমরা যদি পৃথিবীকেও এমন স্লাইস করি, মোট ৫০টা টুকরা হবে, যার একটা টুকরার এক মাথায় থাকবে সায়িন, আরেক মাথায় আলেক্সান্দ্রিয়া।

সায়িন ও আলেকজান্দ্রিয়া শহরে সূর্যের ছায়া
সৌজন্যে: ওরাকল থিংককোয়েস্ট

সায়িন থেকে আলেক্সান্দ্রিয়ার দূরত্ব ৫ হাজার স্টেডিয়ান। তখন দূরত্ব মাপা হতো স্টেডিয়ান দিয়ে। এক স্টেডিয়ান সমান ১৮৫ মিটার। বর্তমান হিসাবে দূরত্ব দাঁড়ায় ৯২৫ কিলোমিটার। এক স্লাইসের দূরত্ব ৯২৫ কিলোমিটার হলে ৫০ স্লাইসের দূরত্ব হবে ৪৬ হাজার ২৫০ কিলোমিটার।

এই হিসাবটা একদম নিখুঁত হয়নি। কারণ, তখন দূরত্ব ঠিকঠাক মাপা সম্ভব ছিল না। তবে আসল মানের খুব কাছাকাছি এইটা। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে হিসাব করে দেখা গেছে, পৃথিবীর পরিধি হবে ৪০ হাজার ৩০ কিলোমিটারের মতো। সোয়া দুই হাজার বছর আগে একজন বিজ্ঞানী কীভাবে এত নিখুঁত হিসাব করেছিলেন, আজও সবাইকে অবাক করে।

পরিধি জানা থাকলে ব্যাসার্ধ বের করা কোনো ব্যাপার না। পাই নামে একটা সংখ্যা আছে। পাইয়ের মান প্রায় ৩ দশমিক ১৪। পরিধির অর্ধেককে পাই দিয়ে ভাগ করলে পাওয়া যায় ব্যাসার্ধ। তাহলে পৃথিবীর ব্যাসার্ধ দাঁড়ায় মোটামুটি ৬ হাজার ৩৭০ কিলোমিটার বা ৬৩ লাখ ৭০ হাজার মিটার। আমাদের পরের হিসাবে ব্যবহার করতে হবে এই মিটারের হিসাব। কিলোমিটারে করলে ভুল হবে।

মহাকর্ষ মহাশয়

এরপরের গল্প প্রায় দুই হাজার বছর পর। ১৬৮৬ সালে নিউটন প্রকাশ করলেন, তাঁর বিখ্যাত বই ন্যাচারালিস প্রিন্সিপিয়া ম্যাথমেটিকা। এই বইয়ে তিনি অনেকগুলো সূত্র দিলেন। এর একটা ছিল মহাকর্ষ সূত্র। এই সূত্র অনুযায়ী মহাবিশ্বের প্রতিটি বস্তু অন্য সব বস্তুকে আকর্ষণ করছে। যাদের ভর যত বেশি, তাদের আকর্ষণ বল তত বেশি। দুটি বস্তুর দূরত্ব বাড়লে আকর্ষণ কমে, দূরত্ব কমলে আকর্ষণ বাড়ে। আরেকটা কথা, এই আকর্ষণ কাজ করে দুটি বস্তুর কেন্দ্র বরাবর। আরেকটা সূত্র ছিল গতি নিয়ে, যা নিউটনের গতির দ্বিতীয় সূত্র নামে চেনে সবাই। এই সূত্র বলছে, কোনো বস্তুর ওপর বল প্রয়োগ করলে তার বেগ বাড়তে থাকবে।

বলের ওপর হাটলে যেমন পিঁপড়া পোড়ে যায় না ঠিক তেমনি আমরাও পৃথিবী থেকে পড়ে যাই না

বিজ্ঞানীরা সবকিছু সমীকরণ দিয়ে প্রকাশ করেন। ওই দুইটা সূত্র মিলিয়ে বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর ভর বের করার একটা সূত্র বানালেন। সূত্রটা ছিল M=gR2/G বাকি কথা বলার আগে একটু বলা যাক এই সূত্রের কোনটা কী।

M হলো আমাদের কাঙ্ক্ষিত পৃথিবীর ভর। g হলো কোনো কিছু ওপর থেকে ছেড়ে দিলে এক সেকেন্ডে তার বেগ কতটা বাড়ছে তা। বিভিন্নভাবে এটা হিসাব করা যায়, সবচেয়ে সহজ হলো একটা দোলক দুলিয়ে কিছু হিসাবকিতাব করে বের করা। হিসাব করে দেখা গেছে, গড়ে এর মান হয় ৯ দশমিক ৮। R পৃথিবীর ব্যাসার্ধ, যা ইরাটোস্থেনিসের হিসাব থেকে আমরা আগেই বের করে রেখেছি। বাকি থাকল ধ্রুবক G। এর গালভরা নাম, সর্বজনীন মহাকর্ষ ধ্রুবক। ধ্রুবক মানে হলো তুমি যদি কোনো একটা বস্তুর জন্য এর মান বের করতে পারো, সবার জন্য খাটবে। সেখান থেকে বের করে ফেলতে পারব পৃথিবীর ভরও।

G এর মান বের করার জন্য অনেক বিজ্ঞানীই চেষ্টা করেন। নিউটন এই ধ্রুবকটা দিয়েছিলেন ১৬৮৬ সালেই। কিন্তু এর মান প্রথমবার বের করতে ১০০ বছরের বেশি লেগে যায়। প্রথম এটা বের করতে সক্ষম হন ব্রিটিশ বিজ্ঞানী ক্যাভেন্ডিস, ১৭৯৮ সালে। এই মানটা ক্লিন্তু খুব ছোট। 6.674x10-11

এই মানগুলো সব ক্যালকুলেটরে বসিয়ে হিসাব করলেই পেয়ে যাবে পৃথিবীর ভর। পল্টুকে সব বুঝিয়ে দেওয়ার পর ও হিসাব করেছে। ওর হিসাবে পৃথিবীর ভর এসেছে প্রায় 6x1024 কেজি। অর্থাৎ, ৬-এর পর ২৪টা শূন্য দিলে যে বিশাল সংখ্যা হয়, তত কেজি। অঙ্ক কষে এবার তুমিও বের করে ফেলতে পারো পৃথিবীর ভর। কোনো দাঁড়িপাল্লা ছাড়াই!