প্রাণজুড়ানো হাতপাখার গ্রাম

ঘরের দাওয়ায় বসে চলছে হাতপাখা তৈরির কাজ। গরমে এই পাখা প্রাণ জুড়ায় কত মানুষের
ছবি: সোয়েল রানা

বিদ্যুতের আলো পৌঁছায়নি—এমন দুর্গম গ্রামে কিংবা লোডশেডিংমাখা শহুরে জীবনে শীতল পরশ বুলিয়ে দেয় হাতপাখা। তালপাতার তৈরি এই হাতপাখার সঙ্গে জড়িয়ে আছে বগুড়ার কাহালু উপজেলার প্রায় এক হাজার কারিগরের জীবন-জীবিকা। এখানকার হাতপাখা যাচ্ছে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের পাইকারি সব বড় বাজার ও মেলায়। প্রতিবছরের চৈত্র, বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ মাসে তালপাখার চাহিদা বেড়ে যায়। তখন কাহালুর আড়োলা, যোগীরভবন, বাগোইল, আখরাইল গ্রামজুড়ে ঘরে ঘরে পাখা তৈরির ধুম পড়ে যায়। সকাল থেকে রাত গভীর রাত পর্যন্ত কারিগরেরা বাড়ির উঠানজুড়ে দল বেঁধে হাতপাখা তৈরির কাজ করেন। তবে এই তিন মাসের তালপাখার বাজারকে কেন্দ্র করে কারিগরেরা ব্যস্ত থাকেন বর্ষাকাল ছাড়া বছরের অন্য সময়ও।

চলছে পাখা রঙিন করার কাজ
ছবি: সোয়েল রানা

কারিগরেরা জানান, যোগীরভবন গ্রামে রয়েছে শত বছরের পুরোনো মন্দির। প্রাচীনকালে দূর-দূরান্ত থেকে ভক্তরা মন্দিরে পূজা-অর্চনা করতে আসতেন। ভক্তদের ভিড়ে সরগরম ছিল যোগীরভবন। মন্দিরে আসা ভক্তদের সেবায় তখন গ্রামের হিন্দু কারিগরেরা হাতপাখা তৈরি শুরু করেন।

কাহালুর যোগীরভবন গ্রামের কারিগর রাশেদুল ইসলাম (৪৫) বলেন, ‘ব্রিটিশ আমল থেকে এখানকার কারিগরেরা হাতপাখা তৈরি করে জীবিকা চালাচ্ছেন। চার পুরুষ ধরে এ পেশায় সংসার চালাচ্ছেন গ্রামবাসী। বংশপরম্পরায় এখনো যোগীরভবনসহ আশপাশের আরও কয়েকটি গ্রামের মানুষ পাখা তৈরির পেশা বেছে নিয়েছে। আমি নিজেও ১৮ বছর বয়স থেকে তালপাখা তৈরির কাজ করছি।’

পাখা তৈরি কিন্তু এত সহজ নয়!
ছবি: সোয়েল রানা

হাফিজা বেগম (৬০) বলেন, স্বাধীনতার পর একটি পাখা তৈরিতে খরচ পড়ত আট আনা। বিক্রি হতো এক থেকে দেড় টাকায়। এখন একটি পাখা তৈরিতে খরচ পড়ে গড়ে আট টাকা। বিক্রি হয় ১০ থেকে ১১ টাকায়।

কারিগর মজিবুর রহমান বলেন, একসময় গ্রামে বিদ্যুৎ ছিল না। তখন গরমে হাতপাখাই ছিল গ্রামের মানুষের ভরসা। এখন বিদ্যুৎ-জেনারেটর-আইপিএসসহ নানা যান্ত্রিকতার দাপট বেড়েছে। তবে কমেনি হাতপাখার কদর। এখনো গ্রাম-শহর দুই জায়গাতেই হাতপাখার বাজার রয়েছে। এই বাজার ধরে রাখতে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে হাতপাখায় আধুনিকতা ও নান্দনিক পাখা তৈরি করা হচ্ছে। বর্তমানে কারিগরপাড়ায় হর্তন, ঘুরকি, তেওয়াল ঘুরকি, ডাগুর পাখা, পকেট পাখা, নকশা পাখাসহ নানা ধরনের পাখা তৈরি হচ্ছে।

বৈদ্যুতিক পাখার কারণে হাতপাখার ব্যবহার কমলেও এর কদর কিন্তু কমেনি
ছবি: সোয়েল রানা

আড়োলা গ্রামের কারিগর ঘুটু মণ্ডল বলেন, বৈশাখের এক মাস আগে-পরে গরম বেশি পড়ে। দেশজুড়ে গ্রামীণ মেলা শুরু হয়। তখন তালপাখার কদরও বেড়ে যায়। তখন দূর-দূরান্ত থেকে পাইকারেরা কারিগরদের বাড়ি বাড়ি এসে তালপাখা কিনে নিয়ে যান। তবে ওই তিন মাসের বাজার ধরতে বছরের ফাল্গুন থেকে আশ্বিন মাসজুড়েই কারিগরেরা পাখা তৈরি ও তা মজুত করে রাখেন।

হাতপাখা ব্যবসায়ী আবদুল খালেক বলেন, ‘এখানকার কারিগরেরা একসময় দেশের বিভিন্ন মেলা এবং গ্রাম-শহরে ফেরি করে হাতপাখা বিক্রি করতেন। এখন বাড়ি বাড়ি ঘুরে আমার মতো পাইকারেরা হাতপাখা কিনে নিয়ে যান। ঢাকা, সিলেট, যশোর, রংপুর, দিনাজপুর, গাইবান্ধা, জয়পুরহাট, নওগাঁ, নাটোর, সিরাজগঞ্জ, পাবনা, টাঙ্গাইলসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে পাইকারেরা এসে হাতপাখা কিনে নিয়ে যাচ্ছেন।’

পাখা তৈরির কাজ শেষ। এবার বিক্রির জন্য যাচ্ছে বিভিন্ন মেলা আর গ্রামের বাজারে
ছবি: সোয়েল রানা

কারিগর মিনারা বেগম বলেন, ‘বিদ্যুতের পাখার ভিড়ে হাতপাখা হারিয়ে যাচ্ছে। এতে পেশা নিয়ে আমরা শঙ্কিত। তবে শিল্পীর কণ্ঠে যখন, “তোমার হাতপাখার বাতাসে, প্রাণ জুড়িয়ে আসে” গানটা শুনি, তখন পাখার কারিগর হিসেবে সত্যি সত্যিই প্রাণটা জুড়িয়ে যায়।’

(কিশোর আলোর মে ২০১৫ সংখ্যায় প্রকাশিত)