মুখগুলো প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। ফ্রক পরা একটা ছোট্ট মেয়ে, লম্বা চুলে চোখ ঢেকে থাকা একটা ছেলে, মোটাসোটা এক আন্টি, মাথায় লাল পাগড়ি বাঁধা এক বুদ্ধিদীপ্ত লোক...৬ আগস্ট সকাল থেকে হঠাৎ করেই চরিত্রগুলো আশপাশে ঘুরঘুর করতে লাগল। ছোট্ট যে মেয়েটার কথা বলছিলাম, পিঙ্কী নাম, কেমন আছে ও? টাক মাথার ঝপটজিকে কি নতুন কোনো বিপাকে ফেলতে যাচ্ছে সে? বিল্লু ছেলেটার বান্ধবীর নাম জোজী। ওদিকে জোজীর বাবার আবার ঘরভর্তি বন্দুক! বন্দুকের নল এড়িয়ে ওরা দুজন কি এখনো সিনেমা দেখতে যায়? চান্নি চাচি কেমন আছেন? কিংবা চাচা চৌধুরী আর সাবু?
ছোটবেলায় গোগ্রাসে গিলেছি ওদের গল্প। সাবু কী খেতে ভালোবাসে, পিংকীর সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু কে, বিল্লুুর সাইকেলটা কী রঙের—সব মুখস্থ ছিল। কী মজার সব কমিক! সত্যি বলতে কি, এসব কমিকের যে একজন আঁকিয়ে আছেন, যিনি দিন-রাত এসব গল্প তৈরি করেন; ছোটবেলায় অত ভাবতাম না। মনে হতো, এটা একটা কমিকের দুনিয়া। সেই দুনিয়ায় চাচা চৌধুরী, পিঙ্কী, বিল্লু আর চান্নি চাচিরা থাকেন। ব্যস! এগুলো আবার আঁকাআঁকির কী আছে! কিছু কিছু কমিক বইয়ের মলাটের পেছনে দেখেছি, প্রাণ নামের এক লোকের ছবি আর কিছু কথা লেখা থাকত। সাদা-কালো সেই ছবিটার চেয়ে রঙিন গল্পগুলো টানত অনেক বেশি। তাই ঝটপট পাতা উল্টে ডুব দিতাম কমিকের দুনিয়ায়।
মলাটের পেছনে লুকিয়ে এই সাদাকালো মানুষটাই আমার মতো অনেকের ছেলেবেলাটা রঙিন করেছেন। ২০১৪ সালের ৬ আগস্ট হুট করেই তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। চাচা চৌধুরীকে প্রথমবার আঁকার সময় কী ভাবছিলেন, পিঙ্কী নামে কাউকে কি তিনি সত্যিই চেনেন, এত নিত্যনতুন ছোট ছোট গল্প তাঁর মাথায় কী করে আসত, অনেক প্রশ্নের উত্তরই অজানা থাকল। ইন্টারনেটে ঘাঁটাঘাঁটি করে দেখলাম, তাঁর সম্পর্কে আসলে খুব বেশি তথ্য নেই। একটু আড়ালে থাকতেই বোধ হয় ভালোবাসতেন। ক্যানসারে আক্রান্ত প্রাণ কুমার শর্মা মৃত্যুর কয়েক দিন আগে হাসপাতালে থাকা অবস্থায়ও কার্টুন এঁকেছেন। শেষের দিকে নাকি ঠিকমতো বসতে পারতেন না, তবু তাঁর আঁকাআঁকি থামেনি। কাজপাগল মানুষটা কাজেই ডুবে ছিলেন।
অবিভক্ত ভারতবর্ষে, লাহোরের দক্ষিণে কাসুর শহরে ১৯৩৮ সালের ১৫ আগস্ট প্রাণের জন্ম। পলিটিক্যাল সায়েন্স বিষয়ে মাস্টার্স শেষ করে মুম্বাইয়ের স্যার জে জে স্কুল অব আর্ট থেকে পাঁচ বছরের একটা কোর্স করেছিলেন। ১৯৬০ সালে দিল্লির মিলাপ পত্রিকার জন্য প্রথম কার্টুন আঁকতে শুরু করেন। তাঁর সৃষ্ট প্রথম চরিত্রের নাম ছিল ডাব্বু। আর যে চাচা চৌধুরীর নামে তাকে সবাই চেনে, সেই সিরিজটি শুরু করেছিলেন ১৯৬৯ সালে। চাচা চৌধুরীকে বলা হয় ভারতের প্রথম সুপারহিরো। তবে এই সুপারহিরোর শক্তি হলো তার তীক্ষ বুদ্ধি আর হাস্যরস। ‘সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমার কমিকের গল্পও বদলেছে। যখন দেশে সন্ত্রাস আর বোমাবাজি দিন দিন বাড়ছিল, তখনই আমি সাবু চরিত্রটা তৈরি করেছি। সাবু এসব অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর একটা প্রতীক ছিল।’ এভাবেই নিজের আঁকা কমিকস নিয়ে বলেছেন প্রাণ। তোমরা যারা সাবুকে চেনো না, তাদের বলি: জুপিটার গ্রহ থেকে এসেছিল চাচা চৌধুরীর এই বিশালদেহী সঙ্গী। বিপদ দেখলেই সে ‘হু-হুবা’ বলে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
কী বিচিত্র সব চরিত্র! চাচা চৌধুরীর নামে প্রাণ বেশি পরিচিত পেলেও তাঁর সৃষ্ট অন্য চরিত্রগুলোও কম আকর্ষণীয় ছিল না। বিল্লু, পিঙ্কী, রমন, চান্নি চাচি— চরিত্রগুলো যেন আমাদের আশপাশেরই কেউ। কাহিনিও খুব সোজাসাপটা। অথচ হাস্যরসাত্মক। যার কমিকের নিয়মিত পাঠক এক কোটিরও বেশি, সেই প্রাণকে বলা হয় ভারতের ওয়াল্ট ডিজনি। যে মানুষটা ভারতে কমিকসকে জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন, চুপিসারেই চলে গেলেন তিনি।
প্রাণবৃত্তান্ত
চাচা চৌধুরীর মস্তিষ্ক কম্পিউটারের চেয়েও প্রখর।
সাবু বিদেশে যাতায়াতের সময় উড়োজাহাজের ছাদে বসে!
প্রাণের চাচা চৌধুরীর সঙ্গে আমাদের হুমায়ূন আহমেদের হিমুর একটা মিল আছে। দুজনই রাতে দরজা খুলে ঘুমায়।
চাচা চৌধুরীর পোষা কুকুর রকেট পৃথিবীর একমাত্র নিরামিষভোজী কুকুর।
সাবু যখন রেগে যায়, তখন দূরে কোথাও আগ্নেয়গিরি ফেটে পড়ে।।
চাচির (চাচা চৌধুরীর স্ত্রী) রুটি বানানোর বেলনকে চোর-গুন্ডা-বদমাশ সবাই ভয় পায়, এমনকি স্বয়ং চাচা চৌধুরীও!
বিল্লুর চোখ কেউ কখনো দেখেনি। কারণ, তার চোখ দুটো সব সময় চুল দিয়ে ঢাকা থাকে।
সাবু প্রতিবেলায় ১০৮টি রুটি, ২০ লিটার লাচ্ছি আর ১২ কেজি হালুয়া খায়!
দূরে কোথাও তাড়াতাড়ি যেতে হলে লোকজন গাড়ি না খুঁজে সাবুর কাছে আসে। সাবু লাথি দিয়ে অথবা ছুড়ে মেরে তাকে গন্তব্যে পৌঁছে দেয়!
সামনে বিপদের আশঙ্কা থাকলেই চাচা চৌধুরীর মাথা অথবা নাক চুলকায়।
প্রাণের দুনিয়ায়
ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব কার্টুনিস্টের পক্ষ থেকে ২০০১ সালে প্রাণ আজীবন সম্মাননা পুরস্কার পেয়েছিলেন।
যুক্তরাষ্ট্রের ইন্টারন্যাশনাল মিউজিয়াম অব কার্টুন আর্টে স্থান পেয়েছে চাচা চৌধুরী।
চাচা চৌধুরী কমিকের জন্য ১৯৯৫ সালে লিমকা বুক অব রেকর্ডসে উঠেছে প্রাণের নাম।
পলিটিক্যাল সায়েন্সে এমএ করা সত্ত্বেও প্রাণ রাজনৈতিক কার্টুন আঁকতে খুব একটা পছন্দ করতেন না।
চার শর বেশি কমিক বই লিখেছেন প্রাণ। ৩০টির বেশি পত্রিকায় নিয়মিত তাঁর কমিক স্ট্রিপ ছাপা হয়েছে।