যে বইয়ের অনুবাদ হয়েছিল কঠোর গোপনীয়তায়

বাংকারের ভেতর। ফরাসি চলচ্চিত্র Les Traducteurs-এর একটি দৃশ্য
বাংকারের ভেতর। ফরাসি চলচ্চিত্র Les Traducteurs-এর একটি দৃশ্য

২০১৩ সালের মার্চের কথা। ৩৭ বছর বয়সী ফ্রেঞ্চ অনুবাদক ক্যারল ডেলপোর্তেকে একটি বিশেষ কাজের জন্য খুবই গোপনীয়তা রেখে বাছাই করা হয়। বাছাইয়ের পরেই তাঁকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় মিলানে। কেবল প্যারিসে থাকা তাঁর স্বামী ও দুই মেয়েই জানতেন তিনি কোথায় আছেন। 

একজন অনুবাদকের জন্য কী এমন কাজ থাকতে পারে যে এত গোপনীয়তা রাখা হলো? ক্যারলের ঘটনা পুরোটা পড়লেই বোঝা যাবে। 

হোটেলে চেক-ইনের পরেই একটি ইন্ডাস্ট্রিয়াল এলাকার মডার্ন বিল্ডিংয়ের বেসমেন্টে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁকে। গেটে দুজন সিকিউরিটি গার্ড তাঁর ব্যাগ ও মুঠোফোন নিয়ে লকারে রেখে দেন। এক বিশাল ঘরের মধ্যে প্রবেশ করেই ক্যারলের চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়। বেশ দূরত্ব রেখে ১০ জন কাজ করছেন। যাঁরা ৬টি দেশ থেকে এসেছেন। যাঁরা সবাই টাইপিংয়ের কাজ করছেন। ক্যারলও শুরু করেন কাজ। কাজটা অনুবাদের। ড্যান ব্রাউনের রবার্ট ল্যাংডন সিরিজের চতুর্থ বই ইনফার্নো অনুবাদের কাজ সম্পূর্ণ গোপনীয়তা রেখে পরবর্তী দুই মাস করতে থাকেন ক্যারল। 

মজার ব্যাপার হচ্ছে, ড্যান ব্রাউনের বই অনুবাদকদের গল্পটি পরবর্তী সময়ে একজন পরিচালকের নজরে আসে। তিনি একটি চলচ্চিত্রও তৈরি করে ফেলেন। ফ্রেঞ্চ পরিচালক রেজিস রইনসার্ড পরিচালিত চলচ্চিত্রটির নাম Les Traducteurs, যার অর্থ অনুবাদক। 

চলচ্চিত্রের অনুবাদকদের মোকাবেলা করতে হয় কঠিন সব সমস্যার
চলচ্চিত্রের অনুবাদকদের মোকাবেলা করতে হয় কঠিন সব সমস্যার



চলচ্চিত্রটিতে দেখানো হয় সমসাময়িক সময়ের এক বেস্টসেলিং ট্রিলজির শেষ বইটি প্রকাশিত হবে। এ জন্য সারা পৃথিবী থেকে ৯ জন অনুবাদককে আনা হয়েছে। শুরুতেই যাঁদের ফোন নিয়ে নেওয়া হয়। যোগাযোগবিচ্ছিন্ন অবস্থায় তাঁরা অনুবাদ শুরু করেন। কিন্তু শুরুতেই গন্ডগোল হয়ে যায়। বইয়ের প্রথম ১০ পাতা অনলাইনে লিক বা প্রকাশিত হয়ে যায়। স্বয়ং লেখক খেপে যান। অনুবাদকদের মধ্যে সন্দেহ ছড়িয়ে পড়ে। সম্পূর্ণ বাংকার কুরুক্ষেত্র হয়ে পড়ে। বাস্তবে অবশ্য বাংকারে ছিলেন ১১ জন অনুবাদক। এবং তাঁদের এ ধরনের কোনো সমস্যাই হয়নি। 

ক্যারলরা যেখানে কাজ করেছিলেন, সেটি আসলে ইতালির সবচেয়ে বড় প্রকাশনা সংস্থা গ্রুপ্পো মোন্দাদোরির প্রধান কার্যালয়। ১৯৭৫ সাল থেকে কোম্পানিটি এক বিশাল ভবনে স্থাপিত। ব্রাজিলিয়ান স্থপতি অস্কার নিয়েমেয়ারের করা বাড়িটি এক 'আইকনিক' স্থাপনা।

ইতালির সবচেয়ে বড় প্রকাশনা সংস্থা গ্রুপ্পো মোন্দাদোরির প্রধান কার্যালয় ভবনটি তৈরি করেন ব্রাজিলের স্থপতি অস্কার নিয়েমেয়ার
ইতালির সবচেয়ে বড় প্রকাশনা সংস্থা গ্রুপ্পো মোন্দাদোরির প্রধান কার্যালয় ভবনটি তৈরি করেন ব্রাজিলের স্থপতি অস্কার নিয়েমেয়ার



রইনসার্ডের মুভিতে যদিও বাংকারটাকে বেশ বিলাসবহুল হিসেবে দেখানো হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে তা একটি বিশাল কনফারেন্স রুম মাত্র। যেখানে কফি মেশিন, ফ্রিজ, মাইক্রোওয়েভ আর প্রিন্টার আছে। বেসমেন্ট হওয়া সত্ত্বেও জায়গাটি বেশ আরামদায়ক। রয়েছে দুটি বিশাল জানালা, যা রুমের মধ্যে আলো-বাতাস চলাচলে সহায়তা করে। তবে মুভি ও বাস্তবের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর একটি মিলও ছিল। সেটি হলো, প্রত্যেক অনুবাদকের ডেস্কেই সেই দেশের পতাকা ছিল। স্প্যানিশ, ইতালিয়ান, ফ্রেঞ্চ, জার্মান, পর্তুগিজ আর কাতালান। 

যদিও সব দক্ষ অনুবাদকেরাই আলাদা আলাদা কাজ করেছিলেন, তবু অধিকাংশই সম্পন্ন করেছেন ৩ হাজার পৃষ্ঠার পাণ্ডুলিপি। ক্যারলও বেশ অভিজ্ঞ একজন অনুবাদক। তিনি আরও কাজ করেছেন ডমিনিক ডেফার্টের সঙ্গে। অনুবাদ করেছেন ওয়াল্টার ইজাকসনের স্টিভ জবসের জীবনী। ক্যারলের মতে, এ ধরনের কাজ করার ক্ষেত্রে অবশ্যই মানসিকভাবে বেশ শক্ত হতে হবে। কারণ, কোনো বাংকারে দেড় মাস ধরে টানা কাজ করা মোটেও সহজ নয়। 

আসলে অপ্রত্যাশিত লিক আটকানোর জন্যই এত বিশাল ব্যবস্থা নেওয়া হয়। পাঁচ বছর আগে সে রকম এক অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছিল। টোয়ালাইটের লেখিকা স্টেফেনি মায়ারের ভ্যাম্পায়ার সিরিজের পঞ্চম বই মিডনাইট সান-এর এক অসমাপ্ত অংশ অনলাইনে লিক হয়ে যায়। ঘড়ির কাঁটা ধরে সশস্ত্র নিরাপত্তাকর্মীরা যদিও পাহারা দিয়েছিলেন। ইন্টারনেট সংযোগও বিচ্ছিন্ন ছিল। অনুবাদকদের ল্যাপটপ কখনো ঘরের বাইরে নিয়ে যাওয়া যেত না। পাণ্ডুলিপিগুলো লকারে আটকে রাখা হতো রাতে। বাথরুমে যেতে হলেও নিরাপত্তাকর্মী সঙ্গে নিয়ে যেতে হতো। 

ইনফার্নোর লেখক ড্যান ব্রাউন
ইনফার্নোর লেখক ড্যান ব্রাউন



ড্যান ব্রাউনের বইয়ের প্রথম পাঠক ছিলেন এই অনুবাদকেরাই। অনুবাদকদের সবার মনেই বই পড়ার সময় নানা প্রশ্ন আসত। অবশ্য তাঁরা নিজেরা আলোচনাও করতে পারতেন। এ জন্য রুমের মাঝখানে একটি হোয়াইট বোর্ড রাখা ছিল, যেখানে সবাই প্রশ্নগুলো লিখতে পারতেন এবং সেই প্রশ্নগুলো ড্যান ব্রাউনের কাছে পাঠানো হতো। 

প্রায় লকডাউনের এ অবস্থা শুধু ইতালিতেই চলছিল, তা কিন্তু নয়। ডাচ, সুইডিশ, ড্যানিশ, তুর্কিশ অনুবাদকদেরও একই পথে হাঁটতে হয়েছে। 

আগে ড্যান ব্রাউনের বইগুলো বেস্টসেলারের তালিকায় ওঠার পরেই অনুবাদে বসত। ইউরোপীয় প্রকাশকেরা তড়িঘড়ি করে কাজে লেগে যেতেন। দ্য লস্ট সিম্বল যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইংল্যান্ডে প্রথম দিনের বেস্টসেলার হয়ে উঠেছিল। কিন্তু ইতালিয়ান, স্প্যানিশ, ফ্রেঞ্চ অনুবাদগুলো আসতে এক মাস লেগে যায়। এর মধ্যে অনেকে ইংরেজি বইগুলোই কিনে ফেলেন। তাই ইনফার্নোর ইংরেজি সংস্করণের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ইতালিয়ান ভাষায়ও প্রকাশ করার তাগিদ ছিল। 

২০১৭ সালে পুনরায় এ রকম অনুবাদের ঘটনা ঘটে। স্পেন ও লাতিন আমেরিকার প্রভাবশালী প্রকাশনা সংস্থা গ্রুপো প্লানেটা অরিজিন বইটি অনুবাদের জন্য ২৬ জন অনুবাদককে একসঙ্গে করেন বার্সেলোনাতে। 

কিন্তু এত পরিশ্রম বৃথা যায়নি আসলে। ২০১৩ সালের মে মাসে ইনফার্নো প্রকাশিত হওয়ার পর ইতালিতে প্রথম ২৪ ঘণ্টায় ৫০ হাজারের বেশি কপি বিক্রি হয়। স্পেনে মুহূর্তেই অরিজিন বিক্রি হয়ে যায়। ৬ লাখ কপির প্রাথমিক প্রিন্ট বিক্রি হয়ে গেলে পুনরায় ১ লাখ কপি ছাপানোর ঘোষণা দেওয়া হয়। 


(দ্য গার্ডিয়ান অবলম্বনে)