প্লাস্টিক পৃথিবী

বাবার সঙ্গে সাঁতার কাটছিল ইমা। ওপরে নীল আকাশ, নিচে নীল সমুদ্র। ইমার মনে যেন আনন্দ ধরে না! মনের আনন্দে সাঁতার কাটছে সে। মাঝেমধ্যে ঢেউয়ে গা ভাসিয়ে খানিকটা রোদও পোহাচ্ছে বলতে পারো। কিন্তু একটু পরে কিসের সঙ্গে যেন দেহ জড়িয়ে গেল ইমার। বুঝে উঠতে না উঠতেই পেঁচিয়ে গেল সম্পূর্ণ শরীর। প্লাস্টিকের এক বড় ব্যাগে আটকে গেছে ছোট্ট ইমা। বাবা চারপাশে অসহায়ের মতো ছুটছে। কিন্তু কোনোভাবেই সেই প্লাস্টিকের ব্যাগটি থেকে মেয়েকে ছাড়াতে পারছে না। চোখের সামনে সহ্যও করতে পারছে না মেয়ের যন্ত্রণা।

ইমা আসলে কোনো মানুষ না। একটি মাছ। পৃথিবীর সমুদ্রে তার মতো হাজার প্রজাতির জলজ প্রাণী ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিন্তু তাদের জীবনের জন্য এক জীবন্ত আতঙ্কের নাম এই ‘প্লাস্টিক’।

প্লাস্টিক পরিবেশে পচতে অথবা কারখানায় পুনঃপ্রক্রিয়াকরণ করতে প্রচুর সময় লাগে। এ জন্য একে বলা হয় অপাচ্য পদার্থ। নিয়মিত এর ব্যবহার পরিবেশদূষণের মাত্রাকে বাড়িয়ে দিচ্ছে। বিশেষ করে সমুদ্রে। আমেরিকাতেই প্রতিবছর ৫ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহৃত হয়। এর মধ্যে মাত্র ২৪ শতাংশ রিসাইকেল করা হয়ে থাকে। বাকি ৩ দশমিক ৮ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক বর্জ্য ফেলে দেওয়া হয়। এভাবে প্রতিটি দেশের কথা হিসাব করে দেখো তাহলে!

সম্প্রতি ইতালির সার্দিনিয়া আইল্যান্ডে একটি মৃত গর্ভবতী তিমি ভেসে ওঠে, যার পেটে ছিল প্রায় ৫০ পাউন্ড প্লাস্টিক—পাকস্থলীর তিন ভাগের দুই ভাগই! তার অন্ত্রগুলোর মুখ প্লাস্টিকে বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে খাবার পরিপাক হওয়ার পরেও কোনো প্রকার পুষ্টি তার দেহ গ্রহণ করেনি। আস্তে আস্তে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে সে।

শুধু যে তিমি, তা কিন্তু নয়। ছোট মাছের পাকস্থলীতেও প্লাস্টিক পাওয়া গেছে। সামুদ্রিক কচ্ছপের অন্যতম এক মৃত্যুর কারণ এই প্লাস্টিক। কচ্ছপ সাধারণত জেলিফিশ আর সামুদ্রিক কীট খেয়ে বেঁচে থাকে। জেলিফিশ দেখতে অনেকটা প্লাস্টিক ব্যাগের মতো হওয়ায় কচ্ছপ ভুল করে সেই ব্যাগ খেয়ে ফেলে। ফলে খাদ্যনালিকা বন্ধ হয়ে যায়। খাবার খেতে না পারায় মৃত্যু ঘটে একসময়।

প্রতিটি জলজ প্রাণীর জন্য প্লাস্টিক ফাঁদের মতো। কেউ জালে আটকা পড়ছে, কেউবা ব্যাগে জড়িয়ে পড়ছে। আবার অনেকে খাবার খেতে গিয়ে প্লাস্টিকে আটকা পড়ছে। প্রতিবছর ১৮ বিলিয়ন পাউন্ড প্লাস্টিক বর্জ্য সমুদ্রে ফেলা হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে ২০৫০ সাল নাগাদ সমুদ্রে জলজ প্রাণীর চেয়ে প্লাস্টিকের পরিমাণ বেশি থাকবে

শুধু যে জলজ প্রাণীই, তা কিন্তু নয়। সামুদ্রিক পাখির ওপরও এর ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। সামুদ্রিক পাখির পেটেও পাওয়া গেছে প্রচুর প্লাস্টিক। কারণ, সমুদ্রে ভাসমান মাছ ও প্লাস্টিক ব্যাগ বা পলিথিন আলাদা করতে পারে না তারা। ২০০৪ সালে এক গবেষণায় ‘সামুদ্রিক গিল’-এর পেটে ৩০ খণ্ডের সমপরিমাণ প্লাস্টিক পাওয়া যায়। প্লাস্টিক থেকে নির্গত হয় বিষাক্ত রাসায়নিক পলিক্লোরিনেটেড বায়োফেনল, যা দেহের টিস্যুকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ফলে দেহের প্রতিরোধক্ষমতা কমে যায়। পাখি ধীরে ধীরে মারা যায়।

পৃথিবী একটাই। সেটাকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্বও আমাদের। ঢাকা শহরে প্রতিদিন প্রায় ১৪ মিলিয়ন পলিথিন ব্যাগ ফেলা হয়। যেখানে-সেখানে ফেলা প্লাস্টিকের শেষ ঠিকানা হয় নদী-নালা। ২০১৮ সালে আর্থ ডে নেটওয়ার্কের প্রতিবেদন অনুযায়ী বিশ্বের সর্বোচ্চ প্লাস্টিক দূষণকারী ২০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান দশম। তবে বাংলাদেশই প্রথম দেশ, যেখানে পলিথিনের ব্যাগ নিষিদ্ধ করা হয়।

আমাদের অসচেতনতা বা বিলাসিতার ফল ভোগ করতে হচ্ছে বিভিন্ন প্রাণীকে, যার প্রভাব পড়ছে প্রকৃতির ওপরও। পৃথিবীকে বাঁচাতে, এসব নিরীহ প্রাণীকে বাঁচাতে এগিয়ে আসতে হবে সবাইকে। সবার নিজস্ব অবস্থান থেকে ছোট্ট পদক্ষেপ হলেও নিতে হবে।

তথ্যসূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফি