প্লেগ চিকিৎসকদের অদ্ভুত পোশাক

গায়ে সাদা অ্যাপ্রোন, গলায় স্টেথিসকোপ ও মুখে মাস্ক—স্বভাবতই আমাদের চিকিৎসকের কথা মনে করিয়ে দেয়। তবে সেই চিকিৎসকের মুখে যদি মাস্কের বদলে থাকে পাখির মতো মুখোশ, তবে কেমন অদ্ভুতই না লাগবে। দেখতে উদ্ভট হলেও মারণ রোগ প্লেগের সংক্রমণ ঠেকাতে এমন কষ্টদায়ক পদক্ষেপ নিতে হয়েছিল প্রাচীন যুগের সাহসী কিছু চিকিৎসককে।

চৌদ্দ শতক, চিকিৎসা বিজ্ঞানের অন্ধকার এক যুগ। যে সময়টাতে কবিরাজ, বৈদ্য কিংবা স্বয়ং চিকিৎসকেরা ‘রোগতত্ত্ব’ কিংবা ‘অণুজীবতত্ত্ব’ সম্পর্কে বিশেষ কিছুই জানতেন না, তখনই প্লেগ নামের এক মারণ রোগের সংক্রমণ দেখা দিল ইউরোপ মহাদেশজুড়ে। প্রায় তিন শতক ধরে পৃথিবীর বুকে রাজত্ব করে বেড়িয়েছে ব্যাকটেরিয়া-ঘটিত এ মহামারি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এ রোগের পরিণতি ছিল নিশ্চিত মৃত্যু। প্লেগের লক্ষণ ছিল চামড়ায় কালশিটে দাগ, নাক-মুখ দিয়ে রক্তক্ষরণ ও লসিকাগ্রন্থি বন্ধ হয়ে যাওয়া। 

রোগটি বায়ু মাধ্যমে খুব দ্রুত সংক্রমিত হতো বলে তখনকার চিকিৎসকেরা কিছু সুরক্ষাপোশাক তৈরি করার চেষ্টা করেছিলেন। তবে এই রোগের ব্যাকটেরিয়া সম্পর্কে বিশেষ কোনো জ্ঞান না থাকায় তাঁদের সুরক্ষাসামগ্রী কোনো কাজেই আসেনি। তাই ক্রমেই এ রোগের প্রকোপ ছড়িয়ে পড়েছিল দেশান্তরে।

সতের শতকে প্লেগ চিকিৎসকদের পেশাকে জঘন্য পেশা হিসেবে বিবেচনা করা হতো। তখনকার জনসাধারণের ধারণা ছিল, রোগটি ঈশ্বরের কোনো অভিশাপ এবং এর চিকিৎসকেরা সেই অভিশাপের দূত। চিকিৎসকেরা তাঁদের অজ্ঞতার কারণে এই রোগের উপশম ও সংক্রমণ রোধ করতে না পারায় মানুষের মনে এই ভ্রান্ত ধারণার জন্ম হয়েছিল। এ কারণে তারা চিকিৎসকদের মানুষ বলে তো গণ্যই করতই না, বরং তাঁদের সঙ্গে বিভিন্ন আগ্রাসী আচরণ করত। তাঁদের শূকরপালক এবং ময়লাওয়ালাদের সঙ্গে তুলনা করা হতো। তবুও চিকিৎসকেরা নিজ পরিবার ছেড়ে মানুষের সেবা করতে দূরে যেতেন। যার দরুন রোগে সংক্রমিত হয়ে অনেক সময় নিজেরাও মারা যেতেন।

চিকিৎসকদের এই দুর্দশা দেখে তখনকার এক বিখ্যাত ফরাসি চিকিৎসাবিজ্ঞানী চার্লস দ্য আইওরম এক অদ্ভুতুড়ে পোশাকের নকশা করেন, যা তাঁদের সংক্রমণমুক্ত রাখতে পারে। বিশেষ এই সুরক্ষাপোশাকের মধ্যে ছিল ক্যানভাস কাপড়ের স্যুট, চামড়ার তৈরি বুটপ্যান্ট, বড় টুপি ও গ্লাভস। সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও আজব অংশটি ছিল পাখির মাথার আকৃতির একটি মুখোশ। এই বিশেষ হুডে পাখির ঠোঁটের মতো একটি লম্বা ঠোঁট থাকায় অনেকে তাঁদের ‘চঞ্চু চিকিৎসক’ বা ‘Beak Doctor’ বলতেন। এই মুখোশে নাকের কাছে দুটো ছিদ্র বিশেষভাবে সিল করা হতো, যাতে দূষিত বায়ু শ্বাসতন্ত্রে প্রবেশ করতে না পারে। চিকিৎসকেরা এই পোশাক পরে যখন চিকিৎসাকাজে বের হতেন, তখন তাঁদের ভৌতিক চলচ্চিত্রের কোনো চরিত্রের মতো লাগত। এই পোশাক ১২ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে দেহে বহন করা তাঁদের পক্ষে অত্যন্ত অসহনীয় ব্যাপার ছিল। তাঁরা এর সঙ্গে কাঠের ছড়িও ব্যবহার করতেন, যা দিয়ে রোগীর সঙ্গে ত্বকীয় সংস্পর্শ এড়িয়ে রোগ নির্ণয় করতেন। এই লাঠি অনেক সময় রুষ্ট জনসাধারণ থেকে আত্মরক্ষার কাজেও লাগত। প্লেগের টিকা আবিষ্কার হওয়ার আগ পর্যন্ত এই বিশেষ সুরক্ষাপোশাক সংক্রমণ অনেকাংশে কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়।

বিভিন্ন উপেক্ষা, অবহেলা সহ্য করে প্রাচীন প্লেগ চিকিৎসকেরা রোগ-বিয়োগে বিলিয়েছেন মেধা, শ্রম এমনকি নিজের অমূল্য জীবন। এরই ধারাবাহিকতায় ১৮৯৫ সালে প্লেগ রোগের ভ্যাকসিন আবিষ্কারের মাধ্যমে নতুন করে মানুষের মনে জন্ম নেয় চিকিৎসকদের প্রতি শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস। বিশ্বে নেমে আসে শান্তি।


তথ্যসূত্র: রিপ্লিস ডটকম