পিরামিডের রহস্য ভেদ করতে গিয়ে এ পর্যন্ত যতগুলো দুর্ঘটনা ঘটেছে, তার মধ্যে সবচেয়ে রোমহর্ষক ঘটনাটা ঘটেছিল রাজা তুত আনখ আমেনের কবর আবিষ্কারের পর।
প্রাচীন মিসরের ইতিহাসে রাজা তুত কিন্তু খুব একটা বিখ্যাত লোক নন। পুতুলের মতো সিংহাসনে বসে থাকা ছাড়া এই অল্প বয়সী রাজার আর কোনো কাজ ছিল না। রাজ্য শাসন করত আসলে একদল শক্তিশালী হিংস্র পুরোহিত। মাত্র নয় বছর রাজত্ব করেছিলেন তুত আনখ আমেন, খ্রিষ্টপূর্ব ১৩৩২ থেকে ১৩২৩ সাল পর্যন্ত। সেকালে ততটা নামডাক না থাকলেও হাজার হাজার বছর পরে যখন দুজন দুঃসাহসী ইংরেজ তাঁর কবর আবিষ্কার করেন, তখন অতি অল্প সময়ের মধ্যেই পৃথিবীর বিখ্যাত হয়ে ওঠেন রাজা তুত। ১৯২৩ সালে পৌরাণিক ‘ভ্যালি অব দ্য কিংস’-এর এক কবর থেকে আবিষ্কার করা হয় তাঁর মমিকৃত দেহ। ওই দুজন নাছোড়বান্দা প্রত্নতাত্ত্বিকের নাম হাওয়ার্ড কার্টার ও লর্ড কার্নারভন।
মিসরের পিরামিড সম্পর্কে গভীর আগ্রহ ছিল লর্ড কার্নারভনের। তাঁর সঙ্গে এসে যোগ দিয়েছিলেন অতি অভিজ্ঞ হাওয়ার্ড কার্টার। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে আগেই ফারাওদের কবর আবিষ্কারের নেশা পেয়ে বসে দুজনকে, কাজ শুরু করেন তাঁরা তখনই। যুদ্ধের সময় কাজ বন্ধ রাখতে হয় তাঁদের বাধ্য হয়ে, কিন্তু যুদ্ধ থামার পরপরই আবার পূর্ণোদ্যমে কাজে নামেন তাঁরা। বিভিন্ন বই পড়ে আর অনেক জায়গায় খোঁজখবর নিয়ে অনুমান করেন, ভ্যালি অব দ্য কিংসেরই কোথাও লুকিয়ে আছে রাজা তুতের কবর। অনেক বাধাবিপত্তি পেরিয়ে ১৯২২-এর শেষ নাগাদ কয়েকটা প্রাচীন কুঁড়ে আবিষ্কার করেন তাঁরা, দেখেই বুঝতে পারেন, কবর নির্মাতা শ্রমিকদের ঘর ওগুলো। ঘরগুলো একটা ব্যাপারই ইঙ্গিত করে—রাজার কবর আশপাশেই আছে কোথাও।
এ সময় কী কাজে দিন কয়েকের জন্য ইংল্যান্ডে ফিরে যেতে হলো কার্নারভনকে। কাজ এগিয়ে নিতে পারতেন কার্টার, কিন্তু যিনি এত দিন ধরে তাঁর সঙ্গে এত পরিশ্রম করছেন, তাঁকে বাদ দিয়ে আবিষ্কারের আনন্দ উপভোগ করতে মন চাইল না তাঁর। কয়েক সপ্তাহ পর কাজ সেরে ফিরে এলেন কার্নারভন। আবার শুরু হলো কাজ। যেদিন প্রথম কবরে নামার সিঁড়িটা আবিষ্কার করেন তাঁরা এবং সিঁড়ি বেয়ে নেমে গিয়ে সিল করা দরজাটা দেখতে পান, দুজনের আনন্দ আর ধরে না। কারণ, তাঁরা জানেন ওই দরজার ওপাশেই আছে রাজা তুত আনখ আমেনের কবর। প্রত্নতাত্ত্বিকের জন্য এর চেয়ে বড় আনন্দের মুহূর্ত আর হতে পারে না।
পরের বছর ফেব্রুয়ারি মাসেই কবরে ঢোকেন দুজনে। সঙ্গে সঙ্গে খবর ছড়িয়ে পড়ে মিসর ছাড়িয়ে ইংল্যান্ডে আর আমেরিকায়। দেখতে দেখতে ২০ জন প্রথম সারির প্রত্নতাত্ত্বিক এসে হাজির হলেন মিসরে। শুরু হলো শ্বাসরুদ্ধকর আবিষ্কারের প্রধান কাজ। কোথায় কী জিনিস আছে, একে একে খুঁজে বের করতে শুরু করলেন প্রত্নতাত্ত্বিকেরা। সমস্ত কবরকক্ষে ছড়িয়ে আছে মহামূল্যবান অসংখ্য সোনা-রুপার তৈজসপত্র, মূর্তি, সোনা আর বিভিন্ন দুষপ্রাপ্য পাথরের কারুকাজ করা আসবাব, হাতির দাঁতের তৈরি জিনিস, যেগুলোর মূল্য কল্পনার অতীত। ঘরের ঠিক মাঝখানে রাখা আছে পাথরের তৈরি শবাধার। শবাধারের ডালা খুলেই স্থির হয়ে গেলেন সব কজন প্রত্নবিদ, বড় বড় হয়ে গেল সবার চোখ। ভেতরে আর একটা শবাধার রাখা আছে, একেবারে খাঁটি সোনার তৈরি। এটারও ডালা তোলা হলো। আরও বিস্মিত হলেন বিজ্ঞানীরা। সোনার গায়ে হাতির দাঁত আর মণিমুক্তাখচিত অপূর্ব এই তৃতীয় কফিনটির তুলনা হয় না। এই জিনিস এর আগে কখনো দেখেনি সভ্য জগতের মানুষ। এটার ডালা খুলতেই পাওয়া গেল রাজা তুত আনখ আমেনের মমিকৃত দেহ। হাজার হাজার বছর পরেও বিন্দুমাত্র মলিন হয়নি রাজার চেহারা। দেখে মনে হয়, আসলে মরেননি রাজা, শবাসনে শুয়ে ঘুমিয়ে আছেন যেন। রাজার বুকে পড়ে আছে একটা ফুলের মালা। তখনো তাজা ফুলের মতো গন্ধ ছড়াচ্ছে ফুলগুলো। বোধ হয় শেষ মুহূর্তে চোখের পানিতে চিরবিদায় জানিয়ে এই ফুলের মালা তাঁর বুকে রেখে গিয়েছিলেন রানি। বিষাদে ছেয়ে গেল ২০ জন প্রত্নতাত্ত্বিকের মন। হাজার হাজার বছর অগের এক করুণ দৃশ্য অবলোকন করলেন সবাই মানসচক্ষে। আনন্দে উত্তেজনায় আবেগে কেঁদে ফেললেন লর্ড কার্নারভন, এত বড় আবিষ্কার এর আগে আর কেউ করতে পারেনি। কবরকক্ষের সমস্ত সোনা-রুপা, মণি-মুক্তার দাম ম্লান হয়ে গেল শুধু ওই একটি ফুলের মালার কাছে।
কিন্তু কবর পাওয়ার পরও মলিন মনে হলো লর্ড কার্নারভনের চেহারা। কী এক ভয় ঢুকে গেছে তাঁর মনে। ভয়ের কারণ সামান্য একটা কাদার তৈরি ট্যাবলেট। কবরকক্ষের পাশের একটা ঘরে খুঁজে পেয়েছেন এটা কার্টার। ট্যাবলেটের গায়ে লেখা কথাগুলো লর্ড কার্নারভনের চিন্তার কারণ। লেখা আছে:
ফারাওয়ের শান্তি ভঙ্গকারীরা হুঁশিয়ার,
যে-ই হও না কেন তুমি,
ভয়ংকর মৃত্যুর কবল থেকে তোমার মুক্তি নেই।
ট্যাবলেটটা পড়ে শুধু একবার শ্রাগ করলেন কার্টার। চুপচাপ তুলে দিলেন কার্নারভনের হাতে। ওই অভিশাপবাক্য ভয় ধরাতে পারেনি তাঁর মনে। কিন্তু কার্নারভনের কথা আলাদা। পিরামিডে ঢুকে দুর্ঘটনায় মরার কথা শুনেছেন তিনি, জানেন মিথ্যা হুমকি দেয় না ফারাওরা। এ-ও জানেন তিনি, ট্যাবলেটের গায়ে লেখা কথা কোনো না কোনোভাবে ফলবেই।
এরপর আর একটা অভিশাপবাক্য আবিষ্কার করলেন দুজনে। কবরকক্ষেই পাওয়া গেল ওটা। একটা মূর্তির পেছনে লেখা আছে বাক্যটা:
ফারাও তুত আনখ আমেনের আমি পাহারাদার,
আমিই কবরের কাছ থেকে দস্যু-তস্করদের দূরে রাখি,
ধু ধু মরুর বুকে বিলীন করে দিই তাদের অস্তিত্ব।
ইঙ্গিতে এটাও দেখালেন কার্নারভনকে কার্টার। আস্তে করে সরিয়ে নিলেন হেলপারদের চোখের সামনে থেকে। কারণ তারা যদি দেখে ফেলে এটা, পড়ে ফেলে একজনেও, ওদের দিয়ে আর এই কবরের ভেতরে কাজ করানো যাবে না; একটা জিনিসও বের করে নেওয়া যাবে না এখান থেকে।
এরপর আরও একটা অভিশাপবাক্য আবিষ্কার করলেন কার্নারভন। লেখা আছে একটা ফ্লাওয়ার ভাসের গায়ে। কাদার ট্যাবলেটের গায়ে লেখা কথারই পুনরাবৃত্তি এটাতে। ভেতরে কিছু আছে কি না দেখার জন্য ওটার ভেতরে আঙুল ঢুকিয়ে দিলেন কার্নারভন। সুচের মতো কিসের যেন খোঁচা লাগল আঙুলে। চোখের সামনে এনে দেখলেন, এক ফোঁটা রক্ত আঙুলের ডগায়। অস্বস্তিতে ভরে গেল তাঁর মন।
প্রাচীন কবরটা আবিষ্কার হওয়া মানে কাজের শেষ নয়, শুরু। মাটির গভীরে, ওই দুর্গম কবর থেকে সমস্ত জিনিসপত্র বের করে নিয়ে যাওয়া সহজ কাজ নয়। রাজা তুতের মমি কফিনসুদ্ধ বের করে নিয়ে যাওয়া, সে তো এক অসম্ভব ব্যাপার। শরীর খারাপ লাগায় সব কাজের ভার কার্টারের ওপর দিয়ে মোটরে করে কায়রো চলে গেলেন কার্নারভন। হোটেল কন্টিনেন্টালে রুম নিলেন।
কবর আবিষ্কারের ছয় সপ্তাহ পর খবর পেলেন কার্টার, দারুণ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন কার্নারভন। বিন্দুমাত্র দেরি না করে হাতের সব কাজ ফেলে রেখে বন্ধুকে দেখতে কায়রো ছুটলেন। হোটেলে পৌঁছে দেখলেন, কার্নারভনের স্ত্রী লেডি আলমিনাও তাঁর পাশে আছেন। এর দুই দিন পর সকালে মারা গেলেন কার্নারভন। তাঁর মৃত্যুর সঠিক কোনো কারণ দর্শাতে পারলেন না চিকিৎসক। প্রথমে বললেন, দাড়ি কামাতে গিয়ে একটা পুরোনো ক্ষত খুর দিয়ে কেটে ফেলেছিলেন কার্নারভন, সেই কাটা সেপটিক হয়ে মারা গেছেন তিনি। তারপর বললেন, মশার কামড় কোনো কারণে বিষাক্ত হয়ে যাওয়াতেই মৃত্যু হয়েছে তাঁর। এসব কথাবার্তা সবই ভিত্তিহীন। আসলে ডাক্তাররা লর্ড কার্নারভনের রোগই নির্ণয় করতে পারেননি।
দলনেতার মৃত্যুতে কেমন যেন বিমর্ষ হয়ে পড়লেন কার্টার আর তাঁর লোকজন। কানাঘুষা শুরু হয়ে গেল। কেউ কেউ বলতে লাগল, এ আর কিছু নয়, ফারাওয়ের অভিশাপ।
কিন্তু প্রথম দিকে একটু মন খারাপ হয়ে গেলেও বন্ধুর অসমাপ্ত কাজ সম্পূর্ণ করার জন্য আবার পূর্ণোদ্যমে শুরু করলেন হাওয়ার্ড কার্টার। কিন্তু কয়েক সপ্তাহ পরেই আবার ঘটল অঘটন। কবরকক্ষে কাজ করতে করতে হঠাৎ বসে পড়লেন একজন আমেরিকান প্রত্নবিদ আর্থার মেস, অস্বাভাবিক পরিশ্রান্ত বোধ করছেন তিনি। দেখতে দেখতে একেবারে মেঝেতে শুয়েই পড়লেন, জ্ঞান হারালেন কয়েক সেকেন্ড পর। ধরাধরি করে বাইরে নিয়ে আসা হলো তাঁকে, যত শিগগির সম্ভব কায়রোয় পাঠিয়ে দেওয়া হলো। কার্নারভনের মতো ওই একই হোটেলে পরদিন মৃত্যু হলো তাঁর।
কাজ তবু বন্ধ থাকল না। দিন কয়েক পরে একজন বিখ্যাত আমেরিকান ব্যবসায়ীর ছেলে লর্ড কার্নারভনের বন্ধু জর্জ জে গাউল্ড তুত আনখ আমেনের কবর দেখতে এলেন। কায়রো থেকে তাঁকে পথ দেখিয়ে আনলেন কার্টার। কবরে নামার বেশ কয়েক ঘণ্টা পর অসুস্থ বোধ করতে লাগলেন গাউল্ড, দেখতে দেখতে গা গরম হয়ে উঠল তাঁর। দেহের তাপমাত্রা বিপদসীমা ছাড়িয়ে গেল। সেই রাতেই মারা গেলেন তিনি।
পরবর্তী পাঁচ মাসে মারা গেল আরও অনেকে। লর্ড কার্নারভনের সৎভাই অব্রে হার্বার্ট এমপি রাজা তুতের কবর দেখতে এসে মারা গেলেন। এর পরপরই দক্ষিণ আমেরিকার একজন কোটিপতি হোটেলের সিঁড়ি থেকে আচমকা পড়ে গিয়ে মারা গেলেন। এর মাত্র এক দিন আগে রাজা তুতের কবরে ঢুকেছিলেন তিনি। তারপর মারা গেলেন ইজিপশিয়ান এনটিকুইটিজর ইন্সপেক্টর আর্থার ওয়েইগাল। রাজার কফিন খোলার সময় উপস্থিত ছিলেন তিনি কবরে। ডাক্তাররা রায় দিয়েছেন, ‘অজানা জ্বরে’ মারা গেছেন ওয়েইগাল।
রাজা তুতের কবরের সঙ্গে জড়িত থাকা লোকদের মধ্যে আরও কয়েকজন মারা গেল এর পরের বছর। প্রিন্স আল ফাহেমি লন্ডনের লাক্সারি হোটেল স্যাভয়ে আততায়ীর গুলি খেয়ে মারা যান। ওই একই হোটেলে পরদিন আত্মহত্যা করেন তাঁর ভাই। দুজনেই ফারাওয়ের অভিশাপের শিকার। কারণ, রাজার কফিন খোলার সময় কবরে উপস্থিত ছিলেন তাঁরাও। এরপর আততায়ীর হাতে খুন হলেন মিসরীয় সেনাবাহিনীর সরদার, স্যার লি স্ট্যাক সিরদাহ্। কফিন খোলা অনুষ্ঠান দেখার অপরাধেই বোধ হয় স্যার লি স্ট্যাকের ওপরও খেপে গিয়েছিলেন ফারাও।
অতি অভিজ্ঞ রেডিওলজিস্ট আর্চিবাল্ড ডগলাস রেইড। রাজা তুতের দেহ এক্স-রে করে দেখার দায়িত্ব পড়েছিল তাঁর ওপর। কাজ শেষ করার খানিক পরে অভিযোগ করলেন তিনি, মাথা ঘুরছে তাঁর, ক্লান্তি লাগছে। পরদিন ইংল্যান্ডে ফিরে গেলেন, মারা গেলেন কয়েক দিন পর।
রেডিওলজিস্ট ইংল্যান্ডে ফিরে গেলে একজন ফটোগ্রাফার ফ্র্যাংক রেলিকে নিযুক্ত করলেন কার্টার। রাজার কফিনের ছবি তোলার জন্য ডাকা হলো তাঁকে। ছবি তোলার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে অন্ধ হয়ে গেলেন রেলি, মারা গেলেন এর কয়েক দিন পর।
কবরের প্রধান কক্ষে ঢুকতে সাহায্য করেছিলেন দুজন বিজ্ঞানী। একজন কানাডার ম্যাকজিল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ব্যাফ্লেয়ার, অন্যজন তরুণ পিরামিড বিশেষজ্ঞ এইচ ই এভলিন-হোয়াইট। প্রথমজন কোনো কারণ ছাড়াই হঠাৎ মারা যান, দ্বিতীয়জন আত্মহত্যা করেন। মৃত্যুর আগে নোট লিখে যান তিনি, ‘আমি জানি, আমার ওপর ফারাওয়ের অভিশাপ আছে।’
এরপর মারা গেলেন ব্রিটিশ মিউজিয়ামের একজন সাইনমেকার। কবরে পাওয়া সমস্ত জিনিসপত্রের লেবেল বানিয়েছেন তিনি।
কবর আবিষ্কারের পর দুই বছর পেরিয়ে গেল। এর মধ্যে এতগুলো লোক মারা গেল, কিন্তু কাজ বন্ধ থাকল না তবু। কফিন খোলার সময় উপস্থিত ছিলেন দুজন ফরাসি প্রত্নবিদ, ড. প্যাসানোভা আর ড. জর্জ বেনেডাইট। হঠাৎ মারা গেলেন দুজনেই।
এরপর একে একে মারা গেলেন আরও অনেকে। শেষ দুজনের একজন শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর জেমস ব্রেস্টেড। কবরকক্ষ এবং এর আশপাশের ঘরগুলো থেকে জিনিস বের করার সময় তিনি সক্রিয় সাহায্য করেছিলেন। হঠাৎ মারাত্মক স্ট্রেপটোকক্কাল ইনফেকশন হয়ে মারা গেলেন তিনি। অন্যজন এক আমেরিকান লেখক, লুই কে সিগিন্স। রাজা তুতের অভিশাপ নিয়ে একটা নাটক লিখেছিলেন তিনি। বোধ হয় এটাকে তেমন দোষ মনে করতেন না রাজা, কিন্তু নাটকের সিন রচনা করার জন্য সশরীরে তুত আনখ আমেনের কবরকক্ষ দর্শন করেছিলেন নাট্যকার।
রাজা তুত আনখ আমেনের কবর উদ্ঘাটনের সঙ্গে জড়িত ৩০ জন লোকের সব কজনই মারা গেলেন এভাবে অপঘাতে। রাজার অভিশাপ ঠিকই ফলল।
‘ফারাওদের অভিশাপ কী করে এত ফলপ্রসূ হয়?’ প্রশ্ন রেখেছেন বিখ্যাত প্রত্নতাত্ত্বিক ও পিরামিড বিশেষজ্ঞ ভ্যান্ডেনবার্গ। কিছু যুক্তি-তর্ক দেখিয়েছেন তিনি।
সব মৃত্যুর কারণ তলিয়ে দেখে স্থির সিদ্ধান্তে এসেছেন ভ্যান্ডেনবার্গ, দু-তিনটি ছাড়া বাকি সব কটা মৃত্যুর কারণ তিনটি রোগ:
১. প্রলাপ বকাসহ সাংঘাতিক জ্বর
২. কোনো কারণ ছাড়াই হঠাৎ প্যারালাইসিস হয়ে যাওয়া
৩. এবং টার্মিনাল ক্যানসার
পিরামিডে ঢুকলে এই রোগগুলো কেন হয়, সেটা খুঁজে বার করার চেষ্টা চালালেন ভ্যান্ডেনবার্গ।
প্রাচীন মিসরীয় কবিরাজদের স্পেশালিটি ছিল ‘বিষ’। বিষ সম্পর্কে অসাধারণ জ্ঞান ছিল তাঁদের। প্যারিশিয়ান বিষ বিশেষজ্ঞ ড. এম মার্টিনি বলেছেন, শুকিয়ে ফেললেও ক্ষমতা নষ্ট হয় না বিষের। আলট্রাভায়োলেট-রে বিষের ক্ষমতা নষ্ট করতে পারে, কিন্তু পিরামিডের টন টন পাথরের নিচে কিছুতেই ঢুকতে পারবে না ওই রশ্মি। কাজেই বিষ সংরক্ষণের জন্য পিরামিডের তুলনা হয় না।
ভ্যান্ডেনবার্গ যুক্তি দেখিয়েছেন, নির্দিষ্ট একটা ডোজে নিয়মিত বিষ সেবন করলে বিষ নিরোধক ক্ষমতা অর্জন করে মানুষের দেহ। জীবনের অর্ধেকেরও বেশি সময় পিরামিডের নিচে কাটিয়েছেন হাওয়ার্ড কার্টার, এ জন্যই হয়তো বিষ নিরোধক হয়ে গিয়েছিল তাঁর শরীর। তবু মাঝে মাঝে শরীর অসাড় হয়ে আসা, মাথা ঘোরা কিংবা গা গোলানো, মতিভ্রম কিংবা মাথা ধরা ইত্যাদির অভিযোগ করতেন তিনি। এসবই বিষে আক্রান্ত হওয়ার লক্ষণ।
ভ্যান্ডেনবার্গ আরও বলেন, ব্যাকটেরিয়ার সম্ভাবনাকেও বাদ দেওয়া যায় না কিছুতেই। প্রাচীন মিসরীয়রা এদের আলাদা নামে হয়তো চিনত না, কিন্তু ওগুলোর ক্ষমতা সম্পর্কে নিশ্চয় ওয়াকিবহাল ছিল। বেশির ভাগ ব্যাকটেরিয়াই শাকসবজি আর প্রাণীদেহের বিশেষ করে তৈলাক্ত পদার্থ খেয়ে বেঁচে থাকে। ফারাওদের মমিতে প্রচুর পরিমাণে ব্যবহার করা হতো চর্বি, তেল ও রেজিন। শতাব্দীর পর শতাব্দী ওই সব তৈলাক্ত পদার্থ খেয়ে মমিতে বেঁচে থেকে বংশবৃদ্ধি করে থাকতে পারে ভয়ংকর, মারাত্মক কোনো ধরনের ব্যাকটেরিয়া। এবং যারাই মমির সংস্পর্শে এসেছে, তাদের শরীরে বায়োকেমিক্যাল ইনফেকশন ঘটিয়েছে ওগুলো। রসায়নবিদেরা স্বীকার করেছেন, এটা সম্ভব।
পিরামিডে ঢুকে ‘ফারাওদের অভিশাপগ্রস্ত’ বিজ্ঞানীরা যে প্রলাপ বকেছেন, প্যারালাইসিসে মারা গেছেন, চেতনা হারিয়েছেন, জ্বরে ভুগেছেন এবং আরও যেসব অসুবিধায় ভুগেছেন, তাঁরা কি আসলে এই ব্যাকটেরিয়ার শিকার? সম্ভাবনাটাকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
আরও বিস্ময়কর একটা সম্ভাবনার কথা বলেছেন জার্মান সম্পাদক: রেডিয়েশন, অর্থাৎ বিকিরণ!
তুত আনখ আমেনের কবরে ঢুকে মারা যাওয়া বিজ্ঞানীদের সঙ্গে মিলে যায় আণবিক বিকিরণে আক্রান্ত মানুষের লক্ষণসমূহ। একটা কথা বলে প্রত্নত্ত্ববিদদের বিস্মিত করে দিয়েছেন বিখ্যাত আণবিক বিজ্ঞানী প্রফেসর লুই বুলগারিনি, ‘লজ অব অ্যাটমিক ডিকে’ সম্পর্কে নাকি বিশেষজ্ঞ ছিলেন প্রাচীন মিসরীয় পাদরিরা। ইউরেনিয়াম পরিচিত ছিল তাঁদের। হয়তো নিজেদের কবর কিংবা ধর্মমন্দিরসহ পবিত্র স্থানগুলো অনুপ্রবেশকারীদের হাত থেকে রক্ষার জন্য রেডিয়েশনের ব্যবহার করতেন ফারাওরা। এখনো পিরামিডের আশপাশে এবং মিসরের কোথাও কোথাও নাকি ইউরেনিয়ামসমৃদ্ধ পাথর পাওয়া যায় মাটির নিচে, এগুলো নাকি ওই সব জায়গায় জড়ো করে রেখেছিলেন ফারাওরাই।
রেডিয়েশনের কার্যক্ষমতার বিভিন্নতা আছে। দ্বিতীয় বিশ্ব্বযুদ্ধের সময় হিরোশিমা আর নাগাসাকির আণবিক বোমা বিস্ফোরণই তার বড় প্রমাণ। বিস্ফোরণের সময় তো বটেই, পরেও রেডিয়েশনে মারা গিয়েছিল বহু লোক, কেউ কেউ কিন্তু আবার একেবারেই আক্রান্ত হয়নি। কে জানে, আণবিক বিকিরণের ধ্বংসক্ষমতা প্রতিরোধ করার শক্তিও বোধ হয় আছে কারও কারও শরীরে। হাওয়ার্ড কার্টারের ব্যাপারটা বিবেচনা করে দেখলেও এটা সত্যি বলে মনে হয়।
আত্মহত্যাকারীরা ফারাওয়ের সরাসরি অভিশাপের আওতায় না গেলেও এর প্রভাবেই মারা গেছেন। কারণ, মানসিক বিভ্রান্তিতে একধরনের আতঙ্ক পেয়ে বসে। এই আতঙ্ক থেকে মুক্তির জন্য আত্মহত্যা করেন তাঁরা। সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে বা এ ধরনেরই কোনো কারণে যাঁরা মারা গেছেন, তাঁদের মৃত্যুর আসল কারণ হয়তো মস্তিষ্ক বিকৃতি কিংবা মাথা ঘোরা। মাথা ঘুরে গিয়েই হয়তো সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়েছিলেন আমেরিকান কোটিপতি।
যাঁরা আততায়ীর গুলিতে মারা গেছেন, তাঁদের ব্যাপারটা অত বিস্ময়কর নয়। পিরামিডের ভেতরে না ঢুকলেও মানুষ আততায়ীর হাতে মারা যায়। এখানে একটা ব্যাপারেই খটকা লাগে, যাঁরাই কবরে ঢুকলেন কিংবা কবর আবিষ্কারের সঙ্গে জড়িত থাকলেন, সবাইকেই মরতে হলো। কেন? একজনও কি বাঁচতে পারলেন না?
কেবল একজন মানুষের ওপরই যেন ফারাওয়ের অভিশাপ কোনো ক্রিয়া করেনি, তিনি হাওয়ার্ড কার্টার। কবর আবিষ্কারের পরও বহাল তবিয়তেই বেঁচে ছিলেন তিনি। ১৯৩৯ সালে স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে তাঁর।