ফিনিয়াসের নির্বাসন

বহুকাল আগের কথা। তখনো ট্রয় নগরী দখল করার জন্য গ্রিসের যোদ্ধারা যুদ্ধযাত্রা করেনি। সেকালে কৃষ্ণসাগরের বুকে একটা দ্বীপ ছিল। সেই দ্বীপে কোনো মানুষের বসবাস ছিল না। সেই জনমানবহীন দ্বীপে একজনকে নির্বাসন দেওয়া হলো। যাকে নির্বাসন দেওয়া হলো, সে বাধ্য হলো সেখানে যেতে। কারণ, যিনি এ নির্বাসনের আদেশ দিয়েছিলেন, তিনি ছিলেন স্বয়ং দেবরাজ জিউস। যাকে নির্বাসন দেওয়া হলো, তার নাম ফিনিয়াস। জিউস অবশ্য এমনি এমনি তার ওপর ক্ষিপ্ত হননি। এর পেছনে কারণ ছিল। কী ছিল সেই কারণ, তা জানলেই বোঝা যাবে ব্যাপারটা। তাহলে আমরা এবার জেনে নিতে পারি সেই কাহিনি।

ফিনিয়াসের স্ত্রীর নাম ছিল ক্লিওপেট্রা, আর ক্লিওপেট্রার বাবার নাম ছিল বোরিয়াস। তো, ফুটফুটে শিশুপুত্র নিয়ে ফিনিয়াস আর ক্লিওপেট্রার সংসার বেশ সুখেই কাটছিল। কিন্তু সেই সুখের সংসার আর রইল না বেশি দিন। ক্লিওপেট্রার একদিন মৃত্যু হলো। অকালেই হলো সেই মৃত্যু। এ মৃত্যুই বদলে দিল সবকিছু। ফিনিয়াস আবার বিয়ে করল। যার সঙ্গে ফিনিয়াসের বিয়ে হলো, সে কিন্তু ক্লিওপেট্রার মতো ভালো ছিল না। তার মন ছিল হিংসায় ভরা। ছোট বাচ্চাদের প্রতিও দয়ামায়া-ভালোবাসা কিছুই ছিল না তার মনে। ক্লিওপেট্রার বাচ্চাদের একটুও দেখতে পারত না সে। সব সময় বাচ্চাদের নামে কানভারী করত সে ফিনিয়াসের। মন্দ কথা শুনতে শুনতে দিনে দিনে সেগুলোকেই ভালো কথা বলে মনে হতে লাগল ফিনিয়াসের। ওই হিংসুটে নারীর কুপরামর্শ শুনে একদিন সে ঘটিয়ে ফেলল ভয়ংকর এক ঘটনা। সে তার নিজের ছেলেদের চোখ অন্ধ করে দিল। মানুষ হায় হায় করে উঠল, কিন্তু ফিনিয়াসের বিবেকে তাতে সাড়া পড়ল না। এত বড় একটা ঘটনা তো আর গোপন থাকতে পারে না। রইলও না গোপন। ছেলেদের নানা, অর্থাৎ ক্লিওপেট্রার বাবা বোরিয়াস এ ঘটনা শুনে যেমন কষ্ট পেলেন, তেমনি রেগে উঠলেন। তিনি গেলেন দেবরাজ জিউসের কাছে। এই ঘোরতর অন্যায়ের প্রতিকার চেয়ে বিচার দাবি করলেন। জিউস ব্যাপারটা মন দিয়ে শুনলেন। তারপর এর বিচার করলেন। তিনি রায় দিলেন, এই অপরাধে ফিনিয়াসকে মরতে হবে। তবে মৃত্যুদণ্ড থেকে রেহাই পাওয়ার একটা ব্যবস্থাও রাখলেন। সেই ব্যবস্থাটা হলো অন্ধ হয়ে গিয়ে মৃত্যু পর্যন্ত যদি সে নির্বাসনে থাকতে পারে, তাহলেই শুধু সুযোগ আছে মৃত্যুদণ্ড থেকে রক্ষা পাওয়ার। ফিনিয়াস দেখল, অন্ধ হয়ে নির্বাসনে গিয়েও যদি প্রাণ রক্ষা করা যায়, তাহলে সেটাই ভালো। সে না মরে অন্ধ হতে রাজি হলো। তাই প্রথমে তাকে অন্ধ করে দেওয়া হলো, তারপর তাকে নির্বাসন দেওয়া হলো জনমানবহীন দ্বীপে। সেই থেকে শুরু হলো তার দুর্বিষহ কষ্টের জীবন।

তবে ফিনিয়াসের এই শাস্তিকে যথেষ্ট বলে মনে করলেন না সূর্যের দেবতা হেলিওস। তিনি ফিনিয়াসের কষ্টকে আরও বাড়িয়ে তোলার চেষ্টা করলেন। এই কাজে তিনি নিয়োজিত করলেন ডানাওয়ালা হারপিসকে। ফিনিয়াস বেঁচে থাকার চেষ্টায় কষ্টেসৃষ্টে নিজের জন্য যে খাবার জোগাড় করে আনত, সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে খারাপগুলো রেখে বাকি সব খাবার চুরি করে আনতে শুরু করল হারপিস। ভালো খাবার যাতে ফিনিয়াস খেতে না পারে এবং খারাপ খাবার খেয়ে কোনোরকমে যাতে সে বেঁচে থাকে, সে জন্য এই ব্যবস্থা। তবে শুধু এটাই নয়, আরও যত রকমে পারা যায়, ফিনিয়াসকে তত রকমে কষ্ট দেওয়াই হয়ে উঠল হারপিসের কাজ। এমন দুঃখকষ্টের মধ্যে বেঁচে থাকাটাই দায় হয়ে উঠল ফিনিয়াসের জন্য।

এমন কষ্টের দিনে ওই দ্বীপের কাছ দিয়ে জাহাজে চেপে যাচ্ছিল জ্যাসন আর তার সঙ্গী নাবিকের দল। তাদের সেই সমুদ্রযাত্রা ছিল ভীষণ বিপদাপদে ভরা। এরই মধ্যে ওই দ্বীপের কাছে জাহাজ ভেড়াল তারা। দ্বীপে নেমে তারা দেখা পেল ফিনিয়াসের। অন্ধ লোকটাকে দেখে তাদের খুব মায়া হলো। সেখানেই তারা জানতে পারল হারপিসের উৎপাতের কথা। এবার তারা ঠিক করল, হারপিসকে ধরে ফেলবে। কিন্তু কী করে ধরবে? তারা বুদ্ধি করে একটা ফাঁদের ব্যবস্থা করল, যাতে তাকে আটকানো যায়। কিন্তু ভাগ্য খারাপ। ফাঁদে আটকাতে পারল না তাকে। তার যে ডানা আছে! যে–ই না তাকে ফাঁদে ফেলতে যায়, অমনি সে উড়ে পালিয়ে যায়। তাহলে কী করা যায়? বুদ্ধি খাটিয়ে জ্যাসন তার দলের এমন দুজনকে ডেকে আনল, যাদের পিঠে ডানা আছে। আবার ঘটনাচক্রে তারাও ছিল বোরিয়াসের ছেলে। অর্থাৎ, তারা ফিনিয়াসের প্রথম স্ত্রী ক্লিওপেট্রার ভাই এবং ফিনিয়াসের অন্ধ করে দেওয়া ছেলেদের মামা। তবে এত দিন ধরে ফিনিয়াস যে সাজা ভোগ করেছে, তাতে তার প্রতি কিছুটা মায়া জন্মেছে তাদের। তারা ভাবল, ফিনিয়াস যে অন্যায় করেছে, তার সাজাও তো কম পায়নি। একে নিজে অন্ধ হয়েছে। তার ওপর মানুষের সমাজ থেকে বহু দূরে একাকী নির্জন দ্বীপে বসবাস করতে হচ্ছে । এ ছাড়া একা একা যে সামান্য খাবারদাবার জোগাড় করে আনতে পারছে, তারও বেশির ভাগই চুরি হয়ে যাচ্ছে। তাই তারা হারপিসকে ধরার ব্যাপারে সাহায্য করতে এগিয়ে এল। যে–ই না হারপিস এল, অমনি তাকে ধরতে এগিয়ে গেল তারা। তারপর পালানোর চেষ্টা করতেই তারা উড়ে তাকে ধাওয়া করে ধরে ফেলল। বহু চেষ্টা করেও মুক্ত হতে পারল না হারপিস। তখন ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে উড়ে এল তার বোন আইরিস। এই আইরিস কিন্তু সাধারণ কেউ ছিল না। সে ছিল আসলে রংধনুর দেবী। তার মা মেঘপরি ইলেকট্রা, আর বাবা থমাস সাগরপুত্র। মেঘ থেকে সমুদ্র, আর সমুদ্র থেকে মেঘের মধ্যে চোখের পলকে উড়ে যাওয়ার ক্ষমতা ছিল তার। এভাবেই সোনালি ডানায় ভর করে মেঘ ও সমুদ্রের মধ্যে সেতুবন্ধ তৈরিতে জুড়ি ছিল না তার। আজও রংধনু দেখে স্বর্গ ও মর্ত্যের মধ্যে সেই যোগাযোগের কথাটাই মনে পড়ে।

তো, সেই আইরিস এসে প্রথম প্রথম ভয় দেখিয়ে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করল বোনকে। কিন্তু বোরিয়াসের ছেলেরা তাদের ছাড়ল না। তখন সে এই বলে বোঝাল যে হারপিস তো আর নিজের ইচ্ছায় এ কাজ করেনি, সে করেছে দেবতার আদেশ মানতে গিয়ে। তবু তারা ছাড়ল না হারপিসকে। তখন সে এমন একটা দোহাই দিল, যা এড়ানোর সাধ্য তাদের ছিল না। পাতাল ঘেঁষে চলে যাওয়া স্টিক্স নদীর দোহাই দিল বা এই নদীর নামে শপথ নিল আইরিস। এ বড় কঠিন শপথ। দেবতারা এই নদীর নামেই শপথ নিতেন। আর এই শপথে অবিশ্বাস কেউই করত না। কারণ, শপথ করে মিথ্যে বললে তাকে পেতে হতো কঠিন সাজা। তা ছাড়া দেবালয় থেকে জিউস অনেকবার আইরিসকে পাঠিয়ে স্টিক্সের জল পর্যন্ত আনিয়েছেন। কাজেই আইরিসের এই শপথে তারা বিশ্বাস রাখল যে হারপিস আর কোনো দিনও ফিনিয়াসকে উপদ্রব করবে না। এভাবেই উটকো বিপদ থেকে বাঁচার উপায় হলো তার।

বোনকে মুক্ত করার জন্য আইরিস এত বড় শপথ নিয়েছিলেন বলেই গ্রিক পুরাণে এই ঘটনাকে বোনের প্রতি ভালোবাসার একটি আদর্শ উদাহরণ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।

এই কাহিনির শিক্ষা: মন্দ কাজের পরিণতি ভালো হয় না। আর ভালোবাসার টানে মানুষ কঠিন কাজ করতেও পিছপা হয় না।