ফুচকাবিলাস

ছবি: খালেদ সরকার | মডেল: মরিয়ম, সারা ও সাদাত

‘ফুচকা’! এই নামটা শুনলেই তো জিবে জল চলে আসে। কুড়মুড়ে গোলাকৃতির একটা পাপড়ির ভেতর মসলাদার ঝাল ঝাল চটপটি আর তার ওপর টক-মিষ্টি তেঁতুলপানি। আস্ত একটা ফুচকা মুখে পুরে নিয়ে কামড় দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভেঙে যায়। এরপর মুখে স্বাদের যে ঝড় ওঠে, সেটার তুলনা কি অন্য কিছুর সঙ্গে হয়? না, একদমই হয় না। সারা সকাল স্কুলে একঘেয়ে ক্লাসটাস করে ছুটির পর বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে মিলে আড্ডা দিতে দিতে ফুচকা খাওয়ার যেমন জুড়ি নেই, তেমনি কোনো এক ঝড়-বৃষ্টির দিনে নিজের একলা সময় পার করতে গিয়েও এই খাবারই সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে। উৎসবে-পার্বণে ঘুরতে গেলে তো ফুচকা চাই-ই চাই। এই মুখরোচক খাবারটি প্রায় সবারই প্রিয়, তা হোক সে ভোজনরসিক কিংবা বেরসিক, সব মানুষকেই কাছে টানে ফুচকা। তাই আমাদের আশেপাশে খুব কম মানুষই পাওয়া যাবে, যারা ফুচকা খেতে ভালোবাসে না।

ফুচকা বাংলাদেশসহ পুরো উপমহাদেশেরই একটি বিখ্যাত জনপ্রিয় জলখাবার কিংবা স্ন্যাকস। বলতে গেলে স্ন্যাকসের রাজা এই ফুচকা। বাংলাদেশ এবং ভারতের শহরাঞ্চলে প্রায় সর্বত্রই এই খাদ্যটির প্রচলন রয়েছে।

ফুচকাকে ডাকা হয় নানা নামে। যেমন গোলগাপ্পা, ফুলকি, টিক্কি, পানি কে বাতাসে, ফুচকা, গুপচুপ, বাতাসি, পাকাডা, পানিপুরি ও পাকোরি। এসব নামকরণের কারণও বেশ মজার। যেমন গোলগাপ্পার নামকরণ গোল একটা ফুচকাকে এক গাপ্পায় অর্থাৎ একেবারে মুখে পুরে নেওয়ার কারণে হয়েছে। আবার পানিপুরি বলা হয় ফুলন্ত মচমচে পুরির ভেতর টক-ঝাল-মিষ্টি পানি দিয়ে খাবার কারণে। ফুচকার মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ও প্রচলিত নাম হলো পানিপুরি, যার উদ্ভব হয়েছিল ভারতের দক্ষিণ বিহারে। প্রথম দিকে ফুলকি নামে পরিচিত এই খাবার সম্পর্কে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক জার্নাল অব ইন্ডিয়া বিশদ বিবরণ দিয়েছে। ওই বিবরণে এ খাবারের উৎপত্তিস্থল হিসেবে অবশ্য ভারতের বারানসির কথা বলা হয়েছে। জনপ্রিয় খাবার লুচির ক্ষুদ্র সংস্করণকে শক্ত কুড়মুড়ে করে খাওয়ার প্রচলন শুরু হয়েছিল। পরে মোগলাই খানার সংস্পর্শে এসে এর চেহারায় পরিবর্তন আনে ভারতীয়রা। সাধারণ শক্ত লুচি পরিণত হয় মসলাদার-রসাল গোলগাপ্পা তথা পানিপুরিতে, যা আমাদের দেশে ফুচকা নামে পরিচিত।

অবশ্য ১৯৪৭-এর আগ পর্যন্ত বাংলাদেশ অঞ্চলে ফুচকা ততটা জনপ্রিয় হতে পারেনি। এ অঞ্চলের কেউ ফুচকাজাতীয় খাবার খেলে তাদের সরাসরি ‘ঘটি’ কিংবা ‘কেইশো’ নামে উপহাস করা হতো। তবে ভারত-পাকিস্তান আলাদা হওয়ার পর পশ্চিমবঙ্গের অনেক অধিবাসী এ দেশে চলে এসে স্থায়ী আবাস গড়ে তোলেন। তাদের সংস্পর্শে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এ পানিপুরি তথা ফুচকা।

ভারতের মরুভূমি অঞ্চল রাজস্থান ও উত্তর প্রদেশে পাতাসি নামে পরিচিত এই খাবারকে তামিলনাড়ুতে পানিপুরি নামে ডাকা হয়। তবে পাকিস্তান, নয়াদিল্লি, জম্মু-কাশ্মীর, হরিয়ানা, ঝাড়খণ্ড, বিহার, মধ্য প্রদেশ ও হিমাচল প্রদেশে এর নাম গোলগাপ্পা। তেলেঙ্গানা, ওডিশা, ছত্তিশগড়, হায়দরাবাদের অনেক অঞ্চলে একে ডাকা হয় গুপচুপ নামে। কিন্তু নেপালে এবং শ্রীলঙ্কায় এ খাবার জনপ্রিয়তা লাভ করেছে ফুলকি নামে। আমরা জানি, দক্ষিণ এশিয়া বিখ্যাত তার সুন্দর-রুচিশীল মসলাজাতীয় খাবারের জন্য। তাই ফুচকাকে একান্ত দক্ষিণ এশীয় খাবার হিসেবে ধরা হয়।

অঞ্চলভেদে নামকরণের ভিন্নতার পাশাপাশি এর পরিবেশনের পদ্ধতিতেও ভিন্নতা লক্ষ করা যায়। আর মূল পার্থক্যটি লক্ষ করা যায় পুর তৈরিতে। নানা জায়গায় আলুর পুর, সবজির পুর, সালাদের পুর, ঘুঘনির পুর কিংবা কেবল ডাবলিমিশ্রিত টকমিষ্টি জল ব্যবহূত হয়। কোনো কোনো এলাকায় ঝালের পরিবর্তে মিষ্টিজাতীয় পুর ব্যবহার করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে সব ঠিক থাকে, কেবল তেঁতুলজলের পরিবর্তে দেখা যায় ধনেপাতার চাটনি, পুদিনামিশ্রিত জল, লেবুর জল কিংবা মিষ্টি খেজুর জল। তবে দেশজুড়েই দই-ফুচকা বা টক দইসহযোগে পরিবেশিত ফুচকা বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করছে। যেখানে পুরে নানা রকম বুট, চানাচুর, মিষ্টি পাপড়ের সঙ্গে দেওয়া হয় বাদামকুচি। ওপরে তেঁতুলজলের বদলে থাকে টক-মিষ্টি দই।

ছবি: খালেদ সরকার

সাধারণত শহর-গ্রামের আনাচেকানাচে ছোট ছোট বোল, ভ্যান এবং শপিং কমপ্লেক্স কিংবা স্কুল-কলেজের পাশের দোকানগুলোই ফুচকা বিক্রির আখড়া। দামে সস্তা ফুচকা সাধারণত এক প্লেট ২০ টাকা থেকে শুরু করে ১০০ টাকা পর্যন্ত হয়। পরিমাণ অনুসারে আবার পানিপুরি খাবার বেলায় ঠিক উল্টোটা। এখানে নির্দিষ্ট কোনো পরিমাণ নেই, হাতে থাকা ছোট্ট শুকনো পাতার বাটিতে যে যত খুশি ততবার নিয়ে খেতে পারে।

অনেক বিদেশিকেই দেখা যায় ফুচকার প্রশংসা করতে। তাই তো দেশ-বিদেশের নানা ব্লগ, ট্রাভেলিং এবং ফুড ডকুমেন্টারি অনুষ্ঠানগুলোতে ফুচকার কথা উঠে এসেছে বারবার। বিবিসি নেটওয়ার্কের বিখ্যাত ফুড অ্যান্ড ট্রাভেলিং চ্যানেল ‘টিএলসি’ এবং ‘ফক্স ট্রাভেলার’-এ বহুল প্রচলিত অনুষ্ঠান ‘ফুড সাফারি’তে ফুচকাকে আখ্যায়িত করা হয়েছিল ‘আ কমপ্লিট বেঙ্গলি স্ট্রিটফুড’ হিসেবে।

বিজ্ঞানীদের গবেষণায় ফুচকার ব্যাপারে মজাদার এক তথ্য উঠে এসেছে। আর তা হলো ফুচকার স্বাদ খুব দ্রুত উজ্জীবিত করে মুখের স্বাদগ্রন্থিগুলোকে। এ কারণে মন খারাপ থাকলে তা সহজেই ভালো হয়ে যায়। তাই তোমার মন খারাপ থাকলে ফুচকা খাওয়াটা কিন্তু অনেক ভালো একটা সমাধান হতে পারে। অনেকটা এক ঢিলে দুই পাখি মারার মতো। এক দিক দিয়ে যেমন তোমার পেট ভরল, তেমনি মনটাও ভালো হয়ে গেল।