যেভাবে বঙ্গবন্ধুর অটোগ্রাফ নিয়েছিল ছোট্ট এলি, পেয়েছিল তাঁর হাতের ছোঁয়া

রংপুর সার্কিট হাউজ

১৯৭২ সালের মে মাসে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম রংপুর সফরে আসেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। রংপুর সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী জেনিফার আলী এলি স্মৃতি রোমন্থন করে জানান, ১০ মে বঙ্গবন্ধুকে কাছ থেকে দেখার আশা নিয়ে কয়েকজন বান্ধবীসহ রংপুর কালেক্টরেট মাঠে যান তিনি। কিন্তু লাখো জনতার মধ্যে শত চেষ্টা করেও ভিড় ঠেলে কাছে যেতে পারেননি।

ভাষণে আকৃষ্ট হয়ে পরদিন কাছ থেকে দেখার আশা নিয়ে ক্লাসের কজন বান্ধবী মিলে মর্নিং স্কুল শেষে আবারও যান রংপুর সার্কিট হাউসে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ফেরার দিন অসংখ্য জনতার মধ্যে পুলিশ তাঁদের মূল গেটেই আটকে দেয়, সরে যেতে বলে। তৎকালীন সময়ে নিরাপত্তাব্যবস্থা শক্ত না থাকায় ছোট্ট শিশুদের দলটি সার্কিট হাউসের দেয়াল টপকে বঙ্গবন্ধুর কক্ষের কাছে চলে যায়। বারান্দার করিডরে সাজেদা চৌধুরী তাদের থামিয়ে প্রশ্ন করেন, ‘এই, তোমরা কোথায় যাও?’ তারা জানায় বঙ্গবন্ধুকে দেখতে আসার কথা। তিনি বলেন, ‘যাও, তিনি আছেন ওই রুমের ভেতর।’

দরজা খোলা থাকায় রুমে উঁকি দিতেই শিশুদের দলটি দেখে, পাইপ হাতে কোলবালিশে হেলান দিয়ে আধা শোয়া অবস্থায় আছেন বঙ্গবন্ধু। শিশুদের দেখে তিনি বললেন, ‘তোমরা কী চাও?’

শিশুরা জানায়, তারা বঙ্গবন্ধুকে দেখতে এসেছে। বঙ্গবন্ধু রুমে উপস্থিত নেতা–কর্মীদের বলেন, ‘এই দেখো তো বঙ্গবন্ধু কে। ওরা দেখতে এসেছে।’

তখন শিশুরা বলে, ‘আপনিই তো বঙ্গবন্ধু।’

এরপর তিনি জিজ্ঞাসা করেন, ‘তোমরা কে কোন ক্লাসে পড়ো? কী চাও বলো?’

তারা বলে, ‘আমরা আপনার অটোগ্রাফ নেব।’

তিনি মশকরা করে বলেন, ‘অটোগ্রাফ কী?’ তারা বলে, ‘আপনি আমাদের স্বাক্ষর দেবেন।’

এরপর বঙ্গবন্ধু এলির কাছে খাতা–কাগজ চাইলেন অটোগ্রাফ দেওয়ার জন্য। কিন্তু তারা কেউ দিতে পারল না। নানা প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে, স্কুলে বই–খাতা রেখে, দেয়াল টপকে সার্কিট হাউসে প্রবেশেরে জন্য খাতা–পেনসিল রেখে বঙ্গবন্ধুর কক্ষে এসেছে তারা। ফলে কারও কাছে খাতা–কাগজ নেই।

কিছু না পেয়ে জেনিফার আলী এলির ডান হাত টেনে হাতেই স্বাক্ষর দিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। রুমে উপস্থতিরা বলতে শুরু করলেন, এখন তোমরা বাইরে যাও। বঙ্গবন্ধু অনেক দূরে যাবেন, সময় খুব কম। রুমের বাইরে এসে আবারও অপেক্ষা, আবারও যদি কাছ থেকে দেখা করা যায়!

প্রায় আধা ঘণ্টা পর সাদা পাঞ্জাবি–পায়জামা পরে দলেবলে ফুল হাতে বেরিয়ে এলেন বঙ্গবন্ধু। আবারও বাচ্চাদের দেখে ফুলের তোড়াটি ছুড়ে দিলেন। এরপর বারান্দায় রেলিংয়ের পাশে নেতা–কর্মী ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের শুভেচ্ছার জবাব দিতে লাগলেন। বারান্দা একটু উঁচুতে হওয়ায় সহজে কেউ কাছে যেতে না পারলেও এলি বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষার্থীদের রেখে, রেলিংয়ে কসরত করে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধুর হাতের কাছে চলে এসে বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকে। বঙ্গবন্ধু উপস্থিত জিলা স্কুলের ছাত্রদের এলিকে দেখিয়ে বলেন, ‘তোরা ছেলেরা ওর সঙ্গে তো পারলি না।’

স্লোগানরত শিক্ষার্থীদের থামিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘এখন তোরা বাড়ি গিয়ে ঠিকমতো লেখাপড়া করবি।’

ছোট্ট এলিকে আদর করছেন বঙ্গবন্ধু

কাছে থাকা এলি একটার পর একটা স্লোগান দিয়ে যাচ্ছিল। এলির মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে বলেন, ‘এখন থাম, তুই তো ঘেমে গেছিস।’

কাকে যেন বললেন, ‘এই একটা ছবি নিয়ো আমার, ঢাকায় গিয়ে দেখাব।’

উত্তেজনায় এলি বাসায় ফিরে ডান হাতে দেওয়া অটোগ্রাফটি যেন মুছে না যায়, সে জন্য ভাতও খেলো না। হাত ধোয়া বন্ধ রেখে, নিজের হাতে ভাত না খেয়ে, মায়ের কাছে খেয়ে নেওয়াসহ নানান চেষ্টায় দুদিনের বেশি রাখতে পারল না অটোগ্রাফটি।

পরদিন বিভিন্ন পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় ছবিটি দেখেই সবাই বলে, ‘ইশ্‌! আমিও যদি কাছে যেতে পারতাম।’

জেনিফার আলী এলি

এলি স্মৃতিচারণায় আফসোস করে বলেন, ‘একটা কাগজ থাকলে আজও সযত্নে রেখে দিতাম অটোগ্রাফটি। বঙ্গবন্ধুর সেই হাসি, ভরাট কণ্ঠে কথাগুলো এখনো স্মৃতিতে ভাসে।’

ঢাকার বঙ্গবন্ধু জাদুঘরে সেই ছবিটির সামনে জেনিফার আলী এলি

১৯৭৫ সালের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের এত বছর পর সেই কথাগুলো এখনো কি মনে পড়ে? জানতে চাইলে এলি জানান, ১৯৭৫ সালের আগস্টে তিনি ঢাকায় বেড়াতে গিয়েছিলেন। এক মামাতো বোন তাঁকে জানায়, বঙ্গবন্ধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসছেন। এলি জীবনে প্রথম শাড়ি পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিলেন। কিন্তু ১৫ আগস্ট সকালে জানলেন সেই ঘৃণ্যতম হত্যাকাণ্ডের খবর। দীর্ঘ সময় ঢাকায় আটকে থাকার পর তিনি রংপুরে ফিরে আসেন।

বঙ্গবন্ধু হত্যার পর হতে একটি প্রশ্ন ঘুরেফিরে আসে, কী করে খুনিরা এই হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে? সব সময় মনে পড়ে বঙ্গবন্ধুর হাত বুলিয়ে সেই দেওয়া আদরের কথা।

রংপুররের অসুস্থ সাংবাদিক মুক্তিযোদ্ধা আলী আশরাফের সহধর্মিণী, দুই কন্যাসন্তানের মা জেনিফার আলী এলির শেষ ইচ্ছা বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ছুঁয়ে দেখা।

লেখক : ফটোসাংবাদিক