বাংলা ভাষায় ভূত

বাংলা ভাষায় ভূত নিয়ে অনেক শব্দ, বাগ্ধারা ও প্রবাদ রয়েছে। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হলো এই ভূতগুলোর ভৌতিক পরিবেশ সৃষ্টির কোনো ক্ষমতা নেই। কোনো রকম ভুতুড়ে কাণ্ডও তারা ঘটাতে পারে না।

পঞ্চভূত, ভূতপূর্ব, অন্তর্ভূত ইত্যাদি শব্দ শুনলে বুকে ভয় ধরে না। কারণ, এই শব্দগুলোর ভূত ভৌতিক নয়। অন্যদিকে বাগ্‌ধারায় ভূতের মুখে রাম নাম শুনলে হাসি পায়। বারো ভূত চারপাশে সব সময় থাকলে মেজাজ খারাপ হয়ে ওঠে।

অদ্ভুত শব্দে কোনো ভূতই নেই। তাই অদ্ভুতের ভূতে দ্ভ-এ হ্রস্ব উ-কার থাকলেও অন্য সব ভূতে সব সময় দীর্ঘ ঊ-কার। কিম্ভূতের ভূত আসল হলেও কিম্ভূত হাস্যকর শব্দ। যা হোক, এবার বাংলা ভাষায় ঘোরাফেরা করা ভূত নিয়ে তৈরি কিছু শব্দ ও বাগ্‌ধারার কথা।

অলংকরণ: শিখা

কিম্ভূত

কিম্ভূতের মধ্যে প্রকৃত ভূত বাস করলেও কিম্ভূতের প্রকৃত অর্থ হলো অদ্ভুত। কোনো লোকের আচার-আচরণ কিংবা বেশভূষা অদ্ভুত মনে হলে সেই লোককে আমরা বলি কিম্ভূত ধরনের লোক।

কিম্ভূতের সঙ্গে কিমাকার শব্দটা জোড়া না লাগলে কিম্ভূত শব্দটা তেমন জোর পায় না। কিম্ভূতকিমাকার একসঙ্গে হলে তখন অর্থ দাঁড়ায় কুৎসিত আকারবিশিষ্ট, বিকটদর্শন ইত্যাদি।

সংস্কৃত ভাষার দুটি সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন থেকে তৈরি হয়েছে বাংলা ভাষার কিম্ভূতকিমাকার। প্রশ্ন দুটি হলো কিম ভূত? কিম আকার?

কিম ভূত প্রশ্নের বাংলা অর্থ হলো কী প্রকারের ভূত? আর কিমাকার হলো কী তার আকার?

ছাপাখানার ভূত

ছাপাখানার ভূত বাঙালি নয়। বস্তুত, ছাপাখানার ভূত কোনো ভূতই নয়।

ছাপাখানায় বই ছাপার সময় একটা শব্দের ভুল বানান ঠিকই শুধরে দেওয়া হলো কিন্তু ছাপা হওয়ার পর দেখা গেল ভুল বানানটা থেকেই গেছে। অথবা, বই ছাপার আগে একটি বাক্য পরীক্ষা করে দেখা গেল বাক্যের প্রতিটি শব্দই যথাযথভাবে রয়েছে কিন্তু ছাপার পর বাক্যের একটি শব্দকে খুঁজে পাওয়া গেল না।

অলংকরণ: শিখা

এই ঘটনাগুলো ইচ্ছাকৃতভাবে ঘটে না। ঘটে অনিচ্ছাকৃতভাবে। কিন্তু দায় তো কারও ঘাড়ে চাপাতেই হয়। এই দায় যার ঘাড়ে চাপানো হয়, তারই নাম ছাপাখানার ভূত। বইয়ের লেখক ভূমিকা লিখে দেন—ছাপাখানার ভূতের দৌরাত্ম্য এড়ানো সম্ভব হলো না বলে দুঃখিত।

বাংলায় ছাপাখানার ভূত কথাটি তৈরি হয়েছে ইংরেজি ‘প্রিন্টার্স ডেভিল’ থেকে।

অলংকরণ: শিখা

বারো ভূত

ভূতের সংখ্যা এখানে নির্দিষ্টভাবে বারোজন হলো কেন তার কোনো যুক্তি খুঁজে পাওয়া যায় না। বারো ভূত কথাটার অর্থ অবাঞ্ছিত আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধব। এরা নিষ্কর্মা। বসে বসে সংসারের অন্ন ধ্বংস করে। এদের এই আচরণ থেকেই তৈরি হয়েছে প্রবাদ—বারো ভূতে লুটেপুটে খাওয়া।

ভূতের মুখে রাম নাম

ভূত নিয়ে বাংলার যত বাগ্ধারা ও প্রবাদ সৃষ্টি হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে ভূতের মুখে রাম নাম প্রবাদটি সবচেয়ে বেশি কৌতুককর। প্রবাদটির অর্থ নিন্দুক বা সমালোচকের মুখে ভালো কথা কিংবা নিজের স্বভাববিরুদ্ধ কথা বলা।

অলংকরণ: শিখা

হিন্দু লোকবিশ্বাসমতে, ভূতে পাওয়া মানুষের সামনে রামায়ণ মহাকাব্যের নায়ক দেবতা রামচন্দ্রের নাম জপ করলে ভূত পালিয়ে যায়। ভূতের মুখে তাই রাম নাম উচ্চারণ করা অসম্ভব। একইভাবে অসম্ভব নিন্দুকের মুখে অন্যের প্রশংসা।