‘বাংলাদেশ ইজ আ ল্যান্ড অব হ্যাপিনেস!’

ওরা পাঁচজন। ম্যারিক ডি ইয়ং, ক্রিস্টি পিইজি, মালি ম্যাখলোস্কি, সিনেইজ গ্যালাহার আর শন মুলিন্স। গুলশানের একটি অফিসে বসে তাদের সঙ্গে আড্ডা দিতে গিয়ে হঠাৎই একটা ব্যাপার আবিষ্কার করলাম। পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে, যে এলাকার মানুষই হোক না কেন, একটা ভাষা সব দেশেই এক। হাসি। আয়ারল্যান্ডের পাঁচ কিশোর-কিশোরীর সঙ্গে গল্প করতে বসে এই ‘কমন’ ভাষাটার ব্যবহারই হলো সবচেয়ে বেশি।

কী এত হাসির কাণ্ড ঘটল, সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। আগে বলি, আয়ারল্যান্ডের লার্গি কলেজের পাঁচ শিক্ষার্থী কেমন করে বাংলাদেশে এল। কনসার্ন ওয়ার্ল্ডওয়াইড একটি আন্তর্জাতিক দাতব্য প্রতিষ্ঠান, যার প্রধান শাখা আয়ারল্যান্ডে। কনসার্নের আয়োজনে প্রতিবছর সে দেশে একটি বিতর্ক প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। প্রতিযোগিতায় যারা জয়ী হয়, পুরস্কার হিসেবে তাদের যেকোনো একটি দেশে কনসার্নের কার্যক্রম ঘুরে দেখানো হয়। গত বছরের বিজয়ীরা ঘুরে এসেছে ইথিওপিয়া। এবারের বিজয়ীদের গন্তব্য ছিল বাংলাদেশ।

ম্যান ভার্সেস ওয়াইল্ড!

ভাবছ, বাংলাদেশ ভ্রমণের কথা শুনেই বিজয়ীরা ‘হুররে’ বলে ব্যাগ গোছানো শুরু করেছিল; ব্যাপারটা তা নয়। উল্টো দু-একজন বেঁকে বসেছিল, এমন দেশে তারা যেতেই চায় না! কেমন দেশ? লাজুক ভঙ্গিতে হেসে অতিথিরা জানাল, ‘আমরা ভেবেছিলাম, এটা যুদ্ধ আর প্রাকৃতিক দুর্যোগের দেশ। এখানে বোধ হয় বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট-ট্যাকেট পরে রাস্তায় নামতে হয়!’ ম্যারিক ডি ইয়ং সঙ্গে যোগ করল, ‘আমার ভয় ছিল এত্ত বড় বড় মশা আমাকে কামড়াবে আর আমার ম্যালেরিয়া হবে!’ ‘এত্ত বড়’ বলতে গিয়ে ম্যারিক দুই হাতে যে আকৃতি দেখাল, এত বড় কাকও বাংলাদেশে নেই! এ নিয়েও এক দফা হাসাহাসি হয়ে গেল।

এই ফাঁকে একটা তথ্য জানিয়ে দিই। আয়ারল্যান্ড থেকে এলেও অতিথিদের সবার জন্মভূমি আয়ারল্যান্ড নয়। ম্যারিক জন্মেছে হল্যান্ডে আর ক্রিস্টি পিইজি মূলত একজন ভারতীয়।

ক্রিকেট-ফুটবল

বাংলাদেশে পা রেখে প্রথম কোন ব্যাপারটা চোখে পড়ল? অতিথিদের জবাব রং! চারপাশ কী ভীষণ রঙিন! তারা এ দেশে পা রেখেছিল ১২ জুলাই। বিশ্বকাপ ফুটবলের ফাইনালের আগের দিন। যে পথেই ওরা গেছে, চোখে পড়েছে নানান রঙের পতাকা। একটা প্রশ্ন শুনতে হবে বলে প্রস্তুতি নিয়েই রেখেছিলাম। ‘তোমাদের দেশে ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনার এত ভক্ত কেন?’ এই জটিল প্রশ্নেরও একটা কিছু উত্তর দেওয়া গেল।

এরপর ক্রিকেট প্রসঙ্গ। ‘গত বিশ্বকাপে তোমাদের বিপক্ষে আমাদের একটা ম্যাচ ছিল। আশা করি খেলার ফলাফলটা তোমাদের মনে আছে!’ বলে শার্টের কলার নাচালাম। শুনে অতিথিদের মুখে দুষ্টুমির হাসি, ‘কই, আমাদের তো মনে নেই! আশা করি তোমরাও ভুলে গেছ।’ জানা হলো, ওদের দেশে ক্রিকেটের খোঁজ লোকে খুব একটা রাখে না।

পাঁচজনে মিলে একটিমাত্র কিশোর আলো পেয়েও অনেক খুশি
ছবি: সুমন ইউসুফ

নারকেলগাছ এবং স্পাইডারম্যান!

আটজনের দলের সফরটাও ছিল আট দিনের। এরই মধ্যে তারা বাংলাদেশের চর, হাওর অঞ্চলসহ ঢাকার কিছু কিছু এলাকা ঘুরে দেখেছে। ‘কোন ব্যাপারটা তোমাদের সবচেয়ে মুগ্ধ করেছে?’ প্রশ্নের উত্তরটা অনুমেয়ই ছিল। ‘মানুষের আন্তরিকতা! যেখানেই গিয়েছি, এমনভাবে হেসে স্বাগত জানিয়েছে, যেন কত পরিচিত!’ শন মুলিন্স অবশ্য একটা মজার তথ্য দিল। বলল, ‘আমাকে সবচেয়ে মুগ্ধ করেছে নারকেল। খেতে খুবই মজা। আর যে বাচ্চা ছেলেটা তড়তড় করে গাছ বেয়ে উঠে গেল, সত্যিই অ্যামেজিং!’

‘শুধু অ্যামেজিং? নাকি রীতিমতো অ্যামেজিং স্পাইডারম্যান?’

এবার অতিথিদের কাছে একটা কঠিন প্রশ্ন, ‘দেশে ফিরে যাওয়ার পর যদি তোমাদের বন্ধুরা জানতে চায়, বাংলাদেশে গেলে কোন পাঁচটা কাজ অবশ্যই করা উচিত? তোমরা তাদের কী পরামর্শ দেবে?’

সবাই মিলে যে তালিকা তৈরি করল—

শন মুলিন্স: সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলো।
মালি ম্যাখলোস্কি: কনসার্ন ওয়ার্ল্ডওয়াইডের কার্যক্রম ঘুরে দেখো।
সিনেইজ গ্যালাহার: উপকূলীয় অঞ্চলে যাও।
ম্যারিক ডি ইয়ং: যদি রমজান মাস হয়, তাহলে বিভিন্ন রেস্টুরেন্টের ইফতারের আইটেমগুলো চেখে দেখো।
ক্রিস্টি পিইজি: রিকশায় চড়তে ভুলো না!

আইরিশ গান

‘আয়ারল্যান্ডের সবচেয়ে জনপ্রিয় গান কোনটা?’ জিজ্ঞেস করতেই এর-ওর মুখের দিকে তাকায়, নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা হলো। হঠাৎই একজন বলে উঠল, ‘মাই লাভলি হর্স’।

হা হা হা...শুরু হলো হাসি। আইরিশ দলটার হাসি আর থামতেই চায় না।

‘আমি কি কিশোর আলোর পাঠকদের গানটা শোনার পরামর্শ দিতে পারি?’

‘পারো’ বলেই ওরা সঙ্গে যোগ করল, ‘বাট মেইক শিওর, দে নো, ইটস আ জোক!’

অতএব আইরিশ বন্ধুদের পরামর্শ, খানিকটা মজা পেতে চাইলে তোমরা ইউটিউবে এই গানটা শুনে দেখতে পারো: http://goo.gl/5kOCEV

ঢন্যব্যাড!

এ কয়দিন থেকে আইরিশ কিশোরের দল একটা বাংলা শব্দ শিখেছে। ঢন্যব্যাড! (ধন্যবাদ) বললাম, ‘তোমরা কি আর কোনো বাংলা শব্দ শিখতে চাও? বলো। যেকোনো একটা বাংলা শব্দ তোমাদের শিখিয়ে দেব।’

লার্গি কলেজের পাঁচ শিক্ষার্থী যে শব্দটার বাংলা জানতে চাইল, সেটা হলো হ্যাপিনেস। বললাম, ‘সুখ’। ‘সুক...শুক...ষ্যুখ...’ অতিথিরা বেশ কয়েকবার উচ্চারণ করে নিল।

সব শেষে পাঁচ কিশোরের কাছে আরও একটা প্রশ্ন, ‘তোমরা ভেবেছিলে বাংলাদেশ যুদ্ধ, প্রাকৃতিক দুর্যোগের দেশ। এখন কী মনে হয়? বাংলাদেশ আসলে কিসের দেশ?’ আইরিশদের হয়ে মাত্রই শেখা বাংলা শব্দটা দিয়ে বলল উত্তর দিল ম্যারিক ডি ইয়ং, ‘সুখ! বাংলাদেশ ইজ আ ল্যান্ড অব হ্যাপিনেস!’ ম্যারিক আরেকটু ভেঙে বলল, ‘বাংলাদেশে এসে আমরা অনেক দরিদ্র মানুষের সঙ্গে দেখা করেছি। তাদের কিছু নেই, কিন্তু মুখে হাসি আছে। এটা খুব অবাক করা। আমাদের অনেক কিছু আছে, কিন্তু আমরা তাতেও সন্তুষ্ট না।’

গল্প করতে করতে ততক্ষণে অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে। সেদিন রাতেই অতিথিদের ফিরে যাওয়ার কথা। স্যুভেনির হিসেবে তাদের হাতে কিশোর আলোর ঈদসংখ্যার একটা কপি দেওয়া হলো। উপহার পেয়ে তারাও ‘ঢন্যব্যাড’ জানাতে ভোলেনি।

ফেরার সময় টুকটাক উপহারের সঙ্গে কিশোর-কিশোরীর ছোট দলটা আরও একটা জিনিস নিয়ে গেল। সুখ!

(কিশোর আলোর আগস্ট ২০১৪ সংখ্যায় প্রকাশিত)