বাংলাদেশ 'ঝুড়ি'র এখন তলা আছে

সুইজারল্যান্ডে দাভোস নামে সুন্দর একটা শহর আছে। সেখানে প্রতিবছর অনেক বড় একটা সম্মেলন হয়। নাম ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের বৈঠক। অর্থনীতি আর ব্যবসা-বাণিজ্য জগতের বাইরে বিশ্বের বড় বড় নীতিনির্ধারক সেখানে ভিড় করেন। সাংবাদিক হিসেবে সেখানে যাই ২০০৮ সালে। অভিজ্ঞতাটি বলি। মাত্রই সম্মেলন কেন্দ্রে পৌঁছেছি, ঢুকেই দেখি দাঁড়িয়ে চেরি ব্লেয়ার, সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের স্ত্রী। তখন তো আর সেলফি ছিল না, তাই রীতিমতো আয়োজন করে অন্যকে দিয়ে ছবি তোলায় ব্যস্ত ছিলাম। হঠাত্ দেখি বার্তা সংস্থা ইউএনবির শামীম আহমেদ ছবি তোলা বাদ দিয়ে উল্টো দিকে যাচ্ছেন। তাকিয়ে দেখলাম লিফটের সামনে হেনরি কিসিঞ্জার। বিশ্বরাজনীতির অন্যতম আলোচিত ও বিতর্কিত চরিত্র। অনেকেই হয়তো জানবে হেনরি কিসিঞ্জারকে। এই মানুষটি একসময় মার্কিন সরকারের নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী তো আরও অনেকেই ছিলেন, কিন্তু হেনরি কিসিঞ্জার নিয়ে এত আলোচনা বা বিতর্ক কেন? সেটি লিখতে গেলে পুরো একটা বই লিখতে হবে।

অবশ্য এ কাজটি করাও হয়েছে। আমি বরং আবার দাভোসেই ফিরে যাই।

একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় হোয়াইট হাউজের তত্কালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের সঙ্গে আলোচনায় হেনরি কিসিঞ্জার
একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় হোয়াইট হাউজের তত্কালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের সঙ্গে আলোচনায় হেনরি কিসিঞ্জার

লিফটে ওঠার আগেই শামীম ভাই কিন্তু হেনরি কিসিঞ্জারের সঙ্গে সেদিন কথা বলতে পেরেছিলেন। হেনরি কিসিঞ্জারকে তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘বাংলাদেশকে মনে আছে তো? সেই যে আপনি বাস্কেট কেস বলেছিলেন’। প্রশ্নটি শুনে বেশ গম্ভীর হয়ে কিসিঞ্জার উত্তর দিয়েছিলেন, ‘বিশেষ এক সময়ের পরিস্থিতিতে এ কথা বলেছিলাম। এখন আর সে বিষয়ে কোনো কিছু বলতে চাই না।’

বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের ইতিহাসের সঙ্গে এই হেনরি কিসিঞ্জারের নামটি বেশ ভালোভাবেই জড়িয়ে আছে। তবে তা মোটেই কোনো সুখস্মৃতি নয়। মানুষটি বাংলাদেশের বিরোধিতা করেছিলেন। তবে তাঁকে নিয়ে সবচেয়ে বেশি যা প্রচারিত তা হচ্ছে হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি বলেছিলেন। এর অর্থ হচ্ছে বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও এমন একটি দেশ, যে দেশকে যাই দেওয়া হোক না কেন, তা থাকবে না। কোনো ঝুড়ির তলা না থাকলে যা হয় আরকি। সেই ঝুড়িতে কোনো কিছুই রাখা যায় না, রাখলেই তলা দিয়ে পড়ে যায়। বিদেশি সাহায্য দেওয়ার দৃষ্টিকোণ থেকে এ কথাটি বলা হতো বাংলাদেশকে। অর্থাত্ বাংলাদেশকে যতই সাহায্য দেওয়া হবে, তা কোনো কাজে আসবে না। তারপরও সাহায্য দিয়ে বাংলাদেশকে টিকিয়ে রাখতে হবে।

সব দোষ হেনরি কিসিঞ্জারের ওপর চাপালেও কথাটি কিন্তু প্রথমে তিনি বলেননি। তারপরও তাঁর সঙ্গেই কথাটি চালু হয়ে যায়। আর তিনিও সম্ভবত বাংলাদেশকে ‘বাস্কেট কেস’ বলতে পছন্দ করতেন। যদিও ‘বাস্কেট কেস’ কথাটির অর্থ কিন্তু অন্য। আগেই এর ব্যবহার ছিল।

‘বাস্কেট কেস’ শব্দ দুটি প্রথম ব্যবহূত হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়। আহত যে সৈনিকের পা কাটা গিয়েছিল, ছিল না হাত, অপরের কাঁধে ছাড়া চলার শক্তি ছিল না, তাদের বলা হতো বাস্কেট কেস। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আবার শব্দটির ব্যবহার শুরু হয়। তারও পরে আহত সৈন্য বাদ দিয়ে ব্যর্থ প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে বলা শুরু হলো।

বিশ্ব রাজনীতির অন্যতম আলোচিত ও বিতর্কিত চরিত্র হেনরি কিসিঞ্জার
বিশ্ব রাজনীতির অন্যতম আলোচিত ও বিতর্কিত চরিত্র হেনরি কিসিঞ্জার

বাংলাদেশ প্রসঙ্গে ঘটনাটি কীভাবে ঘটেছিল সেটা বলি। ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর। বোঝা যাচ্ছিল স্বাধীন হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। ওয়াশিংটনে দক্ষিণ এশিয়া পরিস্থিতি নিয়ে নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জারের সভাপতিত্বে সেই দিন বসল ওয়াশিংটন স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপের সভা। সেখানে আলোচনা হচ্ছিল বাংলাদেশ নিয়ে। বলা হলো, পরের মার্চেই বাংলাদেশে বড় ধরনের খাদ্যসংকট হবে, দুর্ভিক্ষও হবে। শেষ তিনটি কথা এ রকম:

মরিস জে. উইলিয়ামস (ইউএসএআইডির উপ-প্রশাসক): মার্চের মধ্যে বাংলাদেশের সব ধরনের সহায়তা লাগবে।

উরাল এলেক্সিস জনসন (আন্ডার-সেক্রেটারি অব স্টেট): তারা হবে একটি আন্তর্জাতিক বাস্কেট কেস।

হেনরি কিসিঞ্জার: কিন্তু অবশ্যই আমাদের বাস্কেট কেস না।

ওই বৈঠক থেকেই বাংলাদেশের সঙ্গে তলাবিহীন ঝুড়ির কথাটি জুড়ে দেওয়া হয়। অনেক বছর বাংলাদেশ সে রকমই ছিল। কারণ দেশটির আয় ছিল কম, খরচ ছিল বেশি। ফলে নির্ভর করে থাকতে হতো বিদেশি সাহায্যের ওপর। যত দিন গেছে পরিস্থিতি ততই খারাপ হয়েছে। একটা সময় তো প্রায় পুরো উন্নয়ন বাজেটের বড় অংশই এসেছে বৈদেশিক ঋণ থেকে। সময়টা ছিল এরশাদের আমল। অধ্যাপক রেহমান সোবহান একজন খুব বড় অর্থনীতিবিদ। ১৯৮২ সালে তিনি লিখেছিলেন, ‘বাংলাদেশ আজ চরম অনিশ্চয়তার সম্মুখীন। তার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা দুর্যোগের মুখোমুখি। মনে হয়, সমাজ যেন আজ ঋণের টাকায় এবং ধার করা সময়ের ওপর বেঁচে আছে।’

অমর্ত্য সেনের ভাষায় সামাজিক সূচকে ভারতের চেয়েও এগিয়ে আছে বাংলাদেশ
অমর্ত্য সেনের ভাষায় সামাজিক সূচকে ভারতের চেয়েও এগিয়ে আছে বাংলাদেশ

এটাও ঠিক যে স্বাধীনতার পর যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটে। আবার আন্তর্জাতিক অর্থনীতির সংকটও ছিল প্রকট। যেমন ১৯৭২ ও ১৯৭৩ সালে খরা এবং ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশে বড় বন্যা হয়। এর মাঝে ১৯৭৩ সালে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম দ্রুতগতিতে বেড়ে গিয়েছিল। বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য ছিল পাট। কিন্তু সিনথেটিক পণ্যের প্রসার বাড়লে পাট রপ্তানিও ধাক্কা খায়। এসব কারণে সাহায্যনির্ভর হয়েই থাকতে হয়েছিল বাংলাদেশকে। ১০ বছর আগেও বাংলাদেশকে সাহায্য দেওয়ার জন্য প্যারিসে দাতাদের বিশেষ বৈঠক হতো। সেখানে বাংলাদেশকে হাত পাততে হতো, আর দাতারা ঘোষণা দিত কে কত অর্থ দেবে। কোন সরকার কতখানি সফল তা মাপা হতো বৈদেশিক সাহায্য পাওয়ার পরিমাণের ওপর। তবে শেষ বিচারে হেনরি কিসিঞ্জার কিন্তু ভুল প্রমাণিত হয়েছেন। বাংলাদেশকে এখন আর কেউ তলাবিহীন ঝুড়ি বলে না। আমরা এখন আর মোটেই সাহায্যনির্ভর দেশ নই। আমরা এখন বাণিজ্যনির্ভর। আমরা সাহায্য চাই না, বাণিজ্য করতে চাই। এই বাংলাদেশ এখন অনেক দেশের জন্য উদাহরণ। অর্থনীতিতে নোবেল বিজয়ী বাঙালি অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক অমর্ত্য সেন বারবার বলেন, অনেক সামাজিক সূচকে ভারতের চেয়েও এগিয়ে থাকার কথা। এখন আর প্যারিস বৈঠক হয় না। বরং বাংলাদেশই এখন সাহায্য নেওয়া না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারে। পরিস্থিতি কিন্তু পাল্টেছে ৯০-এর পর। এরপর থেকে অর্থনীতি অনেক সংহত হয়েছে। এই বাংলাদেশে এখন গড়ে ৬ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। আমরা এখন নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ। আপাতত  লক্ষ্য আরেক ধাপ উঠে মধ্যম আয়ের দেশ হওয়া। বাংলাদেশকে নিয়ে এখন বিদেশি গণমাধ্যমে লেখা হয়, ‘বাংলাদেশ, বাস্কেট কেস নো মোর।’