বানজি

ক্যান ইউ হিয়ার মি? তিনবার প্রশ্নটা কানে এল। কিন্তু আমার মুখে কথা ফোটে না। মাটি থেকে শখানেক ফুট ওপরে উল্টো হয়ে পেন্ডুলামের মতো ঝুলন্ত আমি কী আর আমি আছি? মাত্র কয় সেকেন্ডেই আপাদমস্তক পাল্টে গেছে আমার পৃথিবী। ভয়, অবিশ্বাস আর বিস্ময় মেশানো অনাস্বাদিত এক বিকার। নিচ থেকে ছুড়ে দেওয়া প্রশ্নকে অপেক্ষায় রেখে নিজেকেই জিজ্ঞেস করলাম, ভয়কে জয় করার অনুভূতিটা কি এমনই?

ইয়েস স্যার, আই ক্যান হিয়ার ইউ।

আমার সাড়া পেয়ে কিছু নির্দেশনা এল। মিনিটখানেকের কসরতে পায়ের তলায় কিছু একটা পেলাম, ডিঙি। আমার জীবনটাই যেন পাল্টে দিয়ে বানজি কেইবল ফিরে গেল ঝাঁপ দেওয়ার টাওয়ারে। কানে তখনো বেজে চলেছে, ‘ফাইভ ফোর থ্রি টু ওয়ান...বানজি।’

অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় অনেকের ‘বাকেট লিস্টেই’ থাকে এই স্পোর্ট। গায়ে নিরাপত্তা দড়ি বেঁধে দু-তিন শ ফুট উঁচু থেকে শূন্যে ঝাঁপ দেওয়া। অনেকটা আত্মহত্যার ইচ্ছাপূরণেরই শামিল। তবে এই অজানাতে ঝাঁপ দেওয়ায় জান যাওয়ার ভয় নেই। অগুনতি সূক্ষ্ম ইলাস্টিক সুতা দিয়ে তৈরি বানজি কর্ড নামের নিরাপত্তা দড়ি আটকানো থাকে ঝাঁপ দেওয়ার টাওয়ারে। ওটাই বাঁচিয়ে দেয় মাটিতে প্রাণপাত আছাড় খাওয়া থেকে। আকাশ থেকে পড়ার পর দড়িতে টান লাগতেই শূন্যে কটা ঝাঁকুনি, তারপর পেন্ডুলামের মতো দুলতে থাকা।

জানবাজি রাখার মতো বানজি জাম্পে আনন্দ আছে, আছে বিপত্তিও। কিছু প্রাণঘাতী, কিছু অঙ্গহানি আবার ছোটখাটো ছেঁড়াফাটা। দুর্ঘটনার হার লাখ পাঁচেক জাম্পে একটা। এটা অবশ্য অনেকটা না হওয়ার মতোই। ১৯৮৬ থেকে ১৬ বছরে ১৮টা মৃত্যুর ঘটনা রেকর্ড করেছে মায়ামির আইনজীবী মার্ক কের অফিস। দুর্ঘটনার শঙ্কা থাকে দুই কারণে, বানজি কর্ড ঠিকমতো বাঁধা না হলে আর আকাশ থেকে মাটির দূরত্বের সঙ্গে কর্ডের দৈর্ঘ্যের গরমিল থাকলে। পড়ার সময় জাম্পারের শরীরের গোটা চাপ এসে পড়ে নিম্নমুখী ঊর্ধ্বাঙ্গে। জখম হতে পারে মেরুদণ্ড আর চোখ। রেকর্ড আছে রেটিনায় রক্তক্ষরণে দৃষ্টিশক্তি হারানোরও।

প্রথম সফল বানজি জাম্পের ঘটনা ব্রিটেনে, ১৯৭৯ সালের ১ এপ্রিল। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির চার দুঃসাহসী ছাত্রের কীর্তি। রাবার শক কর্ড বেঁধে ব্রিস্টলের ক্লিফটন সাসপেনশন ব্রিজ থেকে ওরা ঝাঁপ দেয়। আড়াই শ ফুটি অমন ঝাঁপে বিশ্বজোড়া রোমাঞ্চপ্রিয় মানুষের চোখ ছানাবড়া। প্রাণের ঝুঁকি নেওয়ায় ব্রিটিশ পুলিশ অবশ্য গ্রেপ্তার করেছিল ওদের। তবে ভয়ডর ছাড়াই যারা পায়ে কর্ড বেঁধে অত লম্বা ঝাঁপ দিতে পারে, তাদের কি আর দমিয়ে রাখা যায়? পরের তিন বছর আমেরিকার নানা জায়গায় ওরা বানজি করে বেড়িয়েছে। লক্ষ্য ছিল নতুন এই অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টের ধারণা তামাম দুনিয়ায় ছড়িয়ে দেওয়া। খেলাটা বাণিজ্য হয়ে ওঠে কয়েক বছর পর। নিউজিল্যান্ডের এ জে হ্যাকেট ১৯৮৬ সালে শুরু করেন সুসংগঠিত বানজি জাম্পিং। পৃথিবীর প্রথম কমার্শিয়াল বানজি সাইট স্থাপন করেন কুইন্সল্যান্ডের কাছে কাওয়ারাউ সাসপেনশন ব্রিজে। এখন অনেক দেশেই বানজি করা যায়। বাংলাদেশের কাছাকাছি এই সুযোগ আছে নেপালে। কাঠমান্ডু থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরের ১৬০ মিটার উচ্চতার দ্য লাস্ট রিসোর্ট আর পোখারায় হাইগ্রাউন্ড অ্যাডভেঞ্চারের ৭০ মিটার উঁচু টাওয়ার। ৩২১ মিটারের টাওয়ার নিয়ে উচ্চতার দিক থেকে সবার ওপরে এখন আমেরিকার কলোরাডোর রয়াল জর্জ ব্রিজ বানজি, যা ১০০ তলা দালানের চেয়েও উঁচু।

নেপালে যাচ্ছি। ঠিক করে রেখেছিলাম বানজি করবই। নেটে সার্ফ করেছি, প্রচুর ভিডিও দেখেছি। যত ঘেঁটেছি আত্মবিশ্বাস ততই বেড়েছে। তাই, নিরাপত্তা দড়ি বা হার্নেস পরানোর সময় মনে ভয়ডরের লেশমাত্র ছিল না। কিন্তু এখন কেউ জিজ্ঞেস করলে ঝটপট উত্তর দেব—ভয় পেয়েছিলাম। মনে হয় অন্য দশজনের চেয়ে বেশিই। তবে ভয়টা ঝাঁপ-টাওয়ারের প্ল্যাটফর্মের কিনার পর্যন্ত। যখনই ঝাঁপিয়ে পড়লাম, কী প্রশান্তি—আমি স্বাধীন, আমি মুক্ত।

আসলে ভয় পাওয়াটা খুব স্বাভাবিক। তুমি জানো দুই স্তরের হার্নেস তোমাকে ধরে রাখছে, ডাবল চেক করে দেখা হয়েছে দড়ির মাপ। খাদ নেই নিরাপত্তার সব ব্যবস্থায়। তবু ভেতরের ভয়কে দমাতে না পেরে ফিরে আসে অনেকেই। অথচ ভেতরের ভিতু সত্তাটাকে হারিয়ে লাফ দিয়ে ফেললেই দেখবে অদ্ভুত এক ঘোর গ্রাস করছে তোমাকে। যে ঘোর সহসা কাটে না, ঘিরে থাকে অনেকক্ষণ। নিজের মধ্যে কিছু অদ্ভুত পরিবর্তন আঁচ করা যায়। ফুরফুরে, নির্ভার লাগে। হাসিটা চওড়া হতে থাকে। পৃথিবীটাকে দেখা যায় নতুন মুগ্ধতায়। এ এমন এক খেলা, যেখানে তুমি আক্ষরিক অর্থেই জীবন নিয়ে বাজি ধরছ। প্ল্যাটফর্ম থেকে ঘুরে আসবে না লাফিয়ে পড়বে, সে বোঝাপড়া তোমার সঙ্গে তোমারই।

ছবিতে ছবিতে বানজি জাম্প :