বাড়ি ফেরেননি যাঁরা

অভিযান মানেই রহস্য আর গা শিউরানো রোমাঞ্চের হাতছানি। কখনো কখনো তা মৃত্যুর হাতছানিও বটে। কারণ, দুঃসাহসিক অভিযানে বেরিয়ে অনেকেই চলে যান না-ফেরার দেশে। তাঁদের কেউ কেউ হয়ে ওঠেন অমর। তাঁরা অমর বলেই অনেকের নামের পাশে মৃত্যুর সাল-তারিখ লেখা হয় না। যাঁর মৃত্যুই নেই, তিনিই তো অমর। এমনই আলোচিত কয়েকজন মানুষের গল্প শোনানো হচ্ছে।

আমাজনের কর্নেল

আমাজনের উপকথা বলে, ‘তুমি যদি আমাজন বনে যাও, তাহলে কর্নেল সাহেবকে দেখতে পাবে। তিনি তোমার জন্য অপেক্ষা করছেন, দুজনে মিলে এল ডোরাডো শহরে প্রবেশ করবে তোমরা।’ উপকথার সেই কর্নেলের নাম পার্সে ফসেট। বয়স ৫০ বছর হয়ে গেলে মানুষ সাধারণত অবসরজীবনের পরিকল্পনা করেন। কিন্তু ৫৭ বছরে পা রেখে আমাজনের রহস্যঘেরা শহর খুঁজে বের করার সিদ্ধান্ত নেন কর্নেল ফসেট। ১৯০৬ সালে ৩৯ বছর বয়সে দক্ষিণ আমেরিকা অভিযানে তিনি ব্রাজিল আর বলিভিয়ার বিস্তীর্ণ বন ভ্রমণ করেন। ১৯০৮ সালে ব্রাজিলের রিও ভার্দে নদীর উত্স সন্ধান করেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর তাঁর মাথায় চেপে বসে স্বর্ণনগর এল ডোরাডো। এল ডোরাডোর হারানো শহর জেড অনুসন্ধানে বের হন। বড় ছেলে জ্যাক আর এক সহচরকে নিয়ে ব্রাজিলের আমাজনে ঢোকেন তাঁরা। মাতো গ্রাসো থেকে বন্ধুদের সর্বশেষ চিঠি লেখেন তিনি। এরপরে আর হদিশ মেলেনি কর্নেলের। অনেকের দাবি, ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে তাঁদের মৃত্যু হয়। হারিয়ে যাওয়ার পরে কর্নেলকে উদ্ধারে কয়েক শবার তল্লাশি চালানো হয়। কিন্তু সবই শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়। খুঁজে পাওয়া যায়নি কর্নেল ফসেট আর তাঁর দুই সঙ্গীকে। শার্লক হোমসের স্রষ্টা আর্থার কোনান ডয়েলের সৃষ্ট আরেক জনপ্রিয় চরিত্র ডক্টর চ্যালেঞ্জার। এ চরিত্রটি আসলে এই কর্নেল ফসেটকে মাথায় রেখে সৃষ্টি করেছিলেন ডয়েল। অন্য দিকে হলিউডের বিখ্যাত ইন্ডিয়ানা জোন্স চরিত্রটিও আসলে কর্নেল ফসেটের আদলে বানানো হয়েছে।

একক থেকে শূন্যে নাওমির অভিযাত্রা

প্রথম মানুষ হিসেবে এককভাবে উত্তর মেরু জয়, এককভাবে আমাজন ভ্রমণ, এককভাবে উত্তর আমেরিকার সর্বোচ্চ চূড়া ম্যাককিনলে (বর্তমানে ডেনালি নামে পরিচিত) জয়ের রেকর্ডধারী অভিযাত্রী নাওমি উয়েমুরা। বয়স বিশের আগেই কৈশোরে এককভাবে কিলিমাঞ্জেরো, অ্যাকোনকাগুয়া ও ম্য ব্ল জয়ের কৃতিত্ব ঝুলিতে জমা করেন। ১৯৭০ সালে মাত্র আট দিনে ডেনালি জয় করেন তিনি। ১৯৭৬ সালে গ্রিনল্যান্ড থেকে আলাস্কা একাই কুকুরটানা স্লেজ গাড়িতে ১২ হাজার কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে রেকর্ড গড়েন। ১৯৭৮ সালে দক্ষিণ মেরু বিন্দু এককভাবে স্পর্শ করেন নাওমি। সেবার মেরু ভালুকের আক্রমণে মৃত্যুর মুখ থেকে অল্পের জন্য বেঁচে ফেরেন তিনি। ১৯৮৪ সালে পুনরায় ডেনালি জয়ের অভিযানে নামেন নাওমি। ১৩ ফেব্রুয়ারি সর্বশেষ এক ফটোগ্রাফারের সঙ্গে রেডিওতে কথা বলেন তিনি। ১৬ হাজার ৬০০ ফুট ওপর থেকে হারিয়ে যান নাওমি। পরে ১৪ হাজার ফুট ওপরের গুহা থেকে নাওমির লেখা ডায়েরি উদ্ধার করেন উদ্ধারকারী অভিযাত্রীরা। নাওমি আর ফিরে আসেননি, সেই উদ্ধার করা ডায়েরির শেষ লাইনে তিনি তাঁর অনন্তযাত্রার লক্ষ্যের কথা লিখে যান—‘যা-ই ঘটুক না কেন, আমি ম্যাককিনলে জয় করবই।’

উদ্ধার করতে গিয়ে হারিয়ে যাওয়া

দক্ষিণ মেরু বিন্দুতে পা রাখা মনুষ্য অভিযানের দলনেতা ছিলেন রোয়াল্ড আমুন্ডসেন। ১৯১০-১২ সালে সেই অভিযানে ১৯১১ সালের ১৪ ডিসেম্বর প্রথমবার মানুষের পা পড়ে দক্ষিণ মেরুতে। এরপর আমুন্ডসেন ১৯২৬ সালে উত্তর মেরুতে বিমান অভিযান চালান। দুই মেরু বিন্দুতে পা রাখা প্রথম মানব হিসেবে অভিযাত্রী আমুন্ডসেন যেন রূপকথার কোনো চরিত্র। জাহাজমালিকের সন্তান আমুন্ডসেন। মা চাইতেন ছেলে ডাক্তার হবেন। সেই পথেই পা বাড়াচ্ছিলেন কিশোর আমুন্ডসেন। মাত্র ২১ বছর বয়সে মাকে হারিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়কে বিদায় জানান তিনি। সমুদ্রে নাম লেখান। দুবারের প্রচেষ্টায় ১৯১১ সালে চারজন সহযোগী আর ১৬টি কুকুর নিয়ে দক্ষিণ মেরু বিন্দু স্পর্শ করেন তাঁরা। ১৯২৮ সালে উত্তর মেরুতে এয়ারশিপ ইতালিয়ার এক উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হয়। সেই উড়োজাহাজ উদ্ধারের উদ্দেশে পাঁচ সদস্য নিয়ে যাত্রা করেন আমুন্ডসেন। ব্যারেন্ট সাগরে ওড়ার সময় রেডিও সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয় তাঁদের। এরপরে অভিযাত্রী আমুন্ডসেনের সঙ্গে আর যোগাযোগ হয়নি। হারিয়ে গিয়ে অমর হয়ে যান রোয়াল্ড আমুন্ডসেন।

গ্রিক ট্র্যাজেডির সেই রাগী নায়ক

অনেকেই গ্রিক ট্র্যাজেডির নায়ক ভাবে ডোনাল্ড ক্রোহাস্টকে। গোল্ডেন গ্লোব নামের একক বৈশ্বিক ইয়ট চালানোর প্রতিযোগিতায় নেমে হারিয়ে যান ডোনাল্ড। ব্যক্তিজীবনের গোঁড়ামি, রাগী স্বভাব, ব্যবসায় ব্যর্থতার কারণে বেশ কুখ্যাতই ছিলেন ডোনাল্ড। ১৯৬৮ সালে প্রায় অর্ধেক প্রস্তুত ৪০ ফুট লম্বা নৌকা নিয়েই প্রতিযোগিতায় একাই নেমে পড়েন ডোনাল্ড। কোনোমতে ব্রিটেন থেকে দক্ষিণ আমেরিকায় চলে যান ডোনাল্ড। প্রতিযোগিতার নিয়ম ভেঙে আর্জেন্টিনায় নেমে নৌকা ঠিক করেন তিনি। জেদের বসে কি সারা পৃথিবী ঘোরা যায়? প্রায় ছয় মাস অভিযান শেষে হাল ছেড়ে দেন ডোনাল্ড। তাঁর নৌকার লগ বুকের শেষ হিসাবের তারিখ ছিল ১ জুলাই ১৯৬৯। ১০ জুলাই সমুদ্রে তাঁর নিঃসঙ্গ নৌকা পাওয়া যায়, কিন্তু পাওয়া যায়নি রাগী ডোনাল্ডকে।

সমুদ্রে হারানো অ্যামেলিয়া

আটলান্টিক পাড়ি দেওয়া নারী তিনি। নাম অ্যামেলিয়া এরহার্ট। ১৯২৮ সালে ট্রান্স-আটল্যান্টিক ফ্লাইট অভিযানে কো-পাইলট উইলমার শুলজকে নিয়ে প্রথম আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দেন। ১৯৩২ সালে এককভাবে আটলান্টিকের পেরিয়ে ইউরোপ পৌঁছান। ১৪ ঘণ্টা ৫৬ মিনিটের এ অভিযানে নিজের নামকে অমর করে রাখেন অ্যামেলিয়া। ১৯৩৭ সালে সারা বিশ্ব বিমানে ভ্রমণ শুরু করেন তিনি। সেই অভিযানের যাত্রাপথে ২ জুলাই প্রশান্ত মহাসাগরের ওপর সর্বশেষ রেডিওতে যোগাযোগ করেন অ্যামেলিয়া। এরপরে আর কোনো খোঁজ মেলেনি তাঁর।

শীর্ষে হারানো ম্যালোরি-আরভিন

অভিযানের ইতিহাসের সবচেয়ে বিস্ময়কর নাম জর্জ ম্যালোরি আর অ্যান্ড্রু আরভিন। ১৯২৪ সালে মাউন্ট এভারেস্ট অভিযানে হারিয়ে যান তাঁরা। ১৯৯৯ সালে জর্জ ম্যালোরির চিরতরুণ দেহ এভারেস্টের চূড়ার ২৪৫ মিটার নিচে পাওয়া যায়। অনেকেই বিশ্বাস করেন, ১৯২৪ সালে ম্যালোরি-আরভিন এভারেস্ট চূড়ায় পা রেখেছিলেন। কিন্তু ফিরে আসার পথে তাঁরা হারিয়ে যান। ম্যালোরির মৃতদেহ ফিরে এলেও আরভিন এখনো এভারেস্টে লুকিয়ে আছেন। সেই অভিযান দলের সদস্য নয়েল ওডেল এভারেস্টের ৮ হাজার ৬১০ মিটার উঁচুতে সেকেন্ড স্টেপ নামের জায়গা অতিক্রম করতে দেখেন দুজনকে। দুপুর ১২টা ৫০ মিনিটে সর্বশেষ তাঁদের দেখা যায়, এরপরে দুজনে হারিয়ে যান সাদা বরফের চাদরের নিচে।

সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক, উইকিপিডিয়া, এনসাইক্লোডিপিয়া ব্রিটানিকা