বিজ্ঞানীদের মজার গল্প
অদ্ভুত কাণ্ড করতে বিজ্ঞানীদের জুড়ি মেলা ভার। পিছিয়ে ছিলেন না বাঙালি বিজ্ঞানীরাও। স্যার জগদীশচন্দ্র বসুর হাত ধরেই ভারতীয় উপমহাদেশে সত্যিকারের বিজ্ঞানচর্চার শুরু। তিনিই প্রথম বেতারযন্ত্র আবিষ্কার করেছিলেন। যদিও কৃতিত্বটা দেওয়া হয় ইতালির বিজ্ঞানী মার্কনিকে। জগদীশচন্দ্রই প্রথম বলেছিলেন, মানুষের মতো উদ্ভিদেরও অনুভূতি আছে, আঘাত করলে ওরা ব্যথা পায়। তার এই আবিষ্কার সারা পৃথিবীতে হইচই ফেলে দেয়। অত বড় একজন বিজ্ঞানী, অথচ মাঝে মাঝে একেবারে ছেলেমানুষের মতো কাজ করতেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছেলেমেয়েদের নিয়ে বালুর গর্তে শুয়ে থাকতেন জগদীশচন্দ্র বসু
রবীন্দ্রনাথ তখন কুষ্টিয়ার শিলাইদহে থাকেন। কবিকে দেখতে বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু মাঝে মাঝেই কলকাতা থেকে পাড়ি দিতেন শিলাইদহে। থাকতেন অনেক দিন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পারিবারিক বোটে চেপে সপরিবারে বেরিয়ে পড়তেন পদ্মার কোনো চরে। নির্জন চরে কিছুদিন সন্তানদের নিয়ে বাস করতেন বেদে-বেদেনীদের মতো। সঙ্গে থাকতেন জগদীশ বসুও।
জগদীশ বসুর ভাব শুধু রবীন্দ্রনাথের সঙ্গেই ছিল না। তাঁর ছেলেমেয়েদের, বিশেষ করে বড় ছেলে রথীন্দ্রনাথের বন্ধু ছিলেন তিনি। জগদীশ বসুর সঙ্গে তিনি এখানে-সেখানে ঘুরে বেড়াতেন। কচ্ছপের ডিম খুঁজতেন চরের বালুতে। কখনো কখনো কচ্ছপ ধরে তার মাংসও খেতেন। এসব কাজে তাঁর গুরু বিজ্ঞানী বসু।
জগদীশচন্দ্র বসু শিলাইদহে আসতেন শীতকালে। শীতে রোদ পোহাতে কার না ভালো লাগে? তবে ভয় লাগে গোসল করতে গেলে। আমাদের যেমন লাগে, বিজ্ঞানীদেরও লাগে। তার ওপর পদ্মার পানি এ সময় একেবারে বরফশীতল। কিন্তু গোসল তো করতে হবে। তাই একটা অদ্ভুত ফন্দি আঁটেন বিজ্ঞানী মশাই।
শীতকালে পদ্মার পানি কমে যায়। দুপাশে বালুচর। নরম বালুতে কবরের মতো গর্ত খুঁড়তেন জগদীশচন্দ্র বসু। অনেকগুলো গর্ত। সেই গর্তের একটাতে তিনি শুয়ে পড়তেন। আর অন্যগুলোতে রবীন্দ্রনাথের ছেলেমেয়েরা। মাথায় তিনি একটা ভেজা গামছা জড়িয়ে নিতেন। তারপর গর্তের ভেতর শুয়ে শরীরে রোদ লাগাতেন। বেশ কিছুক্ষণ এভাবে থাকার পর শরীর গরম হয়ে উঠত। আর রোদ সহ্য করতে পারতেন না। তখন রবীন্দ্রনাথের ছেলেমেয়েদের নিয়ে দৌড়ে ঝাঁপ দিতেন পদ্মার বুকে। উত্তপ্ত শরীরের পদ্মার শীতল জলের ছোঁয়ায় ভেসে যেতেন প্রশান্তির সাগরে। এ ঘটনা রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন তাঁর বিখ্যাত ইংরেজি বই অন দ্য এজেজস অব টাইম-এ।
জীবাণুর ভয়ে কারও সঙ্গে হ্যান্ডশেক করতে চাইতেন না লুই পাস্তুর
চিকিৎসাবিজ্ঞানে ‘ফোবিয়া’ বলে কথা আছে। বাংলায় ‘আতঙ্ক’ বললে বোধ হয় আরও ভালো শোনায় কথাটা। আতঙ্কের ব্যাপারটা বিজ্ঞানীদের ভেতরেও কাজ করে। অথচ বিজ্ঞানীদের কাজই হলো মানুষের জীবনকে কীভাবে নিরাপদ ও আরও উন্নত করা যায় সে পথ খোঁজা। বিখ্যাত বিজ্ঞানী লুই পাস্তুর। জলাতঙ্ক রোগের টিকা আবিষ্কার করে তিনি সারা বিশ্বে হইচই ফেলে দিয়েছিলেন। জলাতঙ্ক নির্মূল করার ওষুধ আবিষ্কার যিনি করেছেন, তিনিই কি না আতঙ্কে ভুগতেন! তা-ও আবার জীবাণুর আতঙ্ক। জীবাণু নিয়ে তাঁর কারবার। তাই ভালো করেই জানতেন কোথায় কোথায় সবচেয়ে বেশি জীবাণু থাকে। সেই জানাটাই তাঁর জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। মনের চোখে দেখতেন চারদিকে ‘জীবাণুরা করে হাউ হাউ’। তাই সব সময় সতর্ক হয়ে চলতেন। কারও সঙ্গে হ্যান্ডশেক করতে চাইতেন না। পাস্তুর জানতেন মানুষের হাত হলো জীবাণুর ডিপো।
একদিন এক অভাবনীয় কাণ্ড করে বসলেন পাস্তুর। তিনি তখন বিখ্যাত। প্রায়ই সমাজের বড় বড় মানুষের পায়ের ধুলো পড়ে তাঁর বাড়িতে। সেদিনও একজন এসেছিলেন। সরকারের বড় কোনো কর্মকর্তা। পাস্তুর তাঁকে দেখে বেজায় খুশি। বেমালুম ভুলে বসেছেন জীবাণুর কথা। হাসিমুখে হাত বাড়িয়ে দিলেন গণ্যমান্য লোকটার দিকে। হ্যান্ডশেক করার পরেই মনে পড়ল আতঙ্কের কথা! সবর্নাশ। এক দৌড়ে চলে গেলেন সাবান দিয়ে হাত ধুতে। গণ্যমান্য ব্যক্তিটা তো একেবারে থ!
ওয়াটসন-ক্রিক নামের ক্রম ঠিক করা হয়েছিল টস করে
ওয়াটসন ও ক্রিকের নাম শুনেছ তো। জীবের জীবনরহস্য লুকিয়ে থাকে ডিএনএর মধ্যে। সেই ডিএনএ কেমন? প্যাঁচানো মইয়ের মতো। কিন্তু মানুষ সেটা জানল কী করে? ডিএনএ চোখে দেখা যায় না। অতি শক্তিশালী মাইক্রোস্কোপ দিয়ে দেখতে হয়। তাই প্যাঁচানো মইয়ের মতো দেখতে নকশাটা দেখা চাট্টিখানি কথা নয়। প্রথম যাঁরা এ বিষয়টা দেখেছিলেন তাঁরা কিন্তু নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। অনেকেই হয়তো এতক্ষণে বুঝে গেছো কাদের কথা বলছি। ওয়াটসন ও ক্রিক। জিন গবেষণার দিকপাল বিজ্ঞানী। ক্রিক ছিলেন ওয়াটসনের ১২ বছরের বড়। তবু নাম উচ্চারণ করতে গেলেই আগে ওয়াটসনের নাম চলে আসে। অনেকে ভাবে, ‘ওয়াটসন-ক্রিক’ এভাবে বললে কথাটা ভালো শোনায়। আসল ঘটনা কিন্তু আলাদা। বেশ মজারও। ‘ওয়াটসন-ক্রিক’ শব্দজোড়া প্রতিষ্ঠা করতে টস করা হয়েছিল! অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে? কথা কিন্তু সত্যি।
১৯৫৩ সাল। ওয়াটসন ও ক্রিক আবিষ্কার করলেন ডিএনএর নকশা। এরপর তাঁরা একটা বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ লিখলেন। পাঠিয়ে দিলেন বিখ্যাত নেচার পত্রিকায়। নেচার পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলীই ঘটালেন অকাণ্ডটা। কেন জানি তাঁরা ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলেন না লেখক হিসেবে কার নাম আগে বসাবেন। শেষমেশ টসের আয়োজন করলেন। টসে ওয়াটসনের নাম উঠল। সুতরাং ওয়াটসনের নামটাই আগে বসানো হলো প্রবন্ধে। ফুটবল ও ক্রিকেট খেলা টস ছাড়া হয় না। কিন্তু বিজ্ঞান জগতে টস করার ঘটনা এটাই প্রথম এবং একমাত্র।