বিদেশ থেকে আসা শব্দগুলো

কথায় আছে ‘বেনোজল ঢুকিয়ে ঘোরোজল বের করা’। এর মর্মার্থ হলো অবাঞ্ছিত কিছু বাইরে থেকে এনে ঘরের ভালো জিনিস নষ্ট করা। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কিন্তু তা-ই হয়েছে। বিশ্বায়নের বেনোজল এসে বাংলা ভাষার অনেক সুন্দর সুন্দর শব্দ ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। শিক্ষিত কিংবা অর্ধশিক্ষিত বাঙালি এখন কথা বলতে গিয়ে খানিক বলেন বাংলাতে, খানিক ইংরেজিতে। জায়গাটা এখনো সীমাবদ্ধ মুখের কথায়। তবে কখন যে লেখার ভাষায় তা ঢুকে পড়ে কে জানে।

বাংলা ভাষায় ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করা যাবে না, এমন দিব্যি কেউ কোনো দিন দেয়নি। যেসব বিষয় বা বস্তু বাইরে থেকে এসেছে, সেগুলোর অনেক কিছুই বাংলা শব্দে প্রকাশ করা সম্ভব হয় না। সেখানে ইংরেজি বা অন্য ভাষার শব্দের শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। এতকাল এভাবেই চলে এসেছে। বিশ্বের সব উন্নত ভাষায়ই এভাবে চলে।

বাংলা ভাষায় ইংরেজি শব্দের সংখ্যা কম নয়। সবই অবশ্য এসেছে প্রয়োজনের তাগিদে। এখনো আসছে। কিছু শব্দ ইতিমধ্যেই বাংলা হয়ে গেছে। কিছু শব্দ সম্ভাব্য বা ভবিষ্যতে বাংলা শব্দে পরিণত হওয়ার প্রতীক্ষায় রয়েছে। এসব শব্দের অনেকগুলোরই মজার গল্প রয়েছে। আজকের অভিধানের গল্পতে তারই কিছু কথা।

অলংকরণ: সাদমান মুন্তাসির

স্যান্ডেল

ভদ্র বাঙালি আগে পরত চটি বা চটিজুতা। সাধারণ বাঙালি সারা দিন খালি পায়ে ঘুরে ঘরে ঢোকার আগে পা ধুয়ে পরত কাঠের তৈরি খড়ম। খড়ম ছিল দুই ধরনের। একটা ছিল আগার দিকে কাঠের ওপর রাবারের চওড়া ফিতা লাগানো। আরেকটা ছিল একটু অদ্ভুত ধরনের—পায়ের বুড়ো আঙুল ও তার পাশের আঙুলের মাঝখানে সামান্য উঁচু, ওপরের দিকটা ছাতার মতো গোল কাঠের টুকরা লাগানো, যাতে হাঁটতে অসুবিধা না হয়। সাধারণত, এ ধরনের খড়ম পরতেন সম্ভ্রান্ত হিন্দুরা। ভারতের প্রাচীন মুনিঋষিরা নাকি এ ধরনের খড়মই পরতেন। তাঁদের খড়ম হতো চন্দন কাঠের।

ইংরেজ আমলে এল স্যান্ডেল। প্রথম দিকে স্যান্ডেলকে চটিই বলা হতো। কখনোবা চপ্পল। তারপর স্যান্ডেলের নানা রকমফের দেখে চটিতে তা আর বোঝানো গেল না। স্যান্ডেলই চালু হয়ে গেল। বাঙালি এখনো জুতো স্যান্ডেলই বলে।

স্যান্ডেল শব্দটা ইংরেজি নয়, ল্যাটিন। ল্যাটিন ভাষা শব্দটা ধার করেছে গ্রিক ভাষা থেকে। গ্রিক ভাষায় শব্দটির অর্থ কাঠের জুতা। শব্দার্থবিজ্ঞানী, অর্থাৎ যাঁরা শব্দের ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করেন, তাঁদের ধারণা, গ্রিকরা শব্দটা পেয়েছে ভারতের কাছ থেকে অথবা পশ্চিম এশিয়ার কোনো ভাষা থেকে।

তবে স্যান্ডেল শব্দটা ইংরেজি ভাষায় চালু হয় ১৪ শতকের দিকে। তবে তা কাঠের জুতা বা বাঙালি খড়ম হিসেবে নয়, রীতিমতো স্যান্ডেল হিসেবেই।

অলংকরণ: সাদমান মুন্তাসির

ফি

এই শব্দটা আগে লেখা হতো দীর্ঘ ঈ-কার দিয়ে। বিদেশি শব্দ বলে এখন লেখা হয় হ্রস্ব ই-কার দিয়ে।

বাংলা ভাষায় ফি শব্দটা এসেছে দুই দিক থেকে। এক হলো আরবি ফি, আরেকটা হলো ইংরেজি ফি। ফি হপ্তা, ফি বার, ফি রোজ-এর ফি হলো আরফি ফি। আর টিউশন ফি, পরীক্ষার ফি, কলেজ ফি ইত্যাদি হলো ইংরেজি ফি।

আরবি ফি শব্দের অর্থ হলো প্রত্যেক। অন্যদিকে, ইংরেজি ফি শব্দের অর্থ বিশেষ কাজের জন্য অথবা পেশাজীবীর কর্মের জন্য প্রদেয় অর্থ। বাংলা ভাষায় ইংরেজি ফি শব্দটা বহু ক্ষেত্রে ব্যবহার করতে হয়। অভিধানের গল্প ইরেজি ফি শব্দ নিয়ে।

ইতিহাসের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে ইংরেজিতে fee শব্দের প্রবেশ ১৪ শতকে। ভাষার শিকড় খুঁজতে গিয়ে ভাষার ইতিবৃত্তে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাবর্গের কথা বলা হয়। এই ভাষাবর্গের মধ্যের পড়ে ভারত, ইরান ও ইউরোপীয় প্রাচীন ভাষাসমূহ। একই শব্দ নানান চেহারায় খুঁজে পাওয়া যায় এসব প্রাচীন ভাষার মধ্যে।

সুপ্রাচীনকালে যখন মুদ্রার প্রচলন হয়নি, তখন দ্রব্যমূল্যের লেনদেন হতো গৃহপালিত পশুবিনিময়ের মাধ্যমে। পশু সংস্কৃত শব্দ। ল্যাটিনে তা peca, আবার টিউটোনিক ভাষাতে তা feha। প্রাচীন ইংরেজিতে তা হলো Feoh। এই শব্দটাই ১৪ শতকে fee-তে পরিণত হয়। ইংরেজি fee এবং বাংলা ফি এখন একই রকম অর্থ বহন করে। তবে ইংরেজি fee শব্দের প্রাচীন অর্থ হলো পশু।

অলংকরণ: সাদমান মুন্তাসির

ডিভান

বাঙালির বসার ঘর কিংবা বৈঠকখানা অনেক আগেই ড্রয়িংরুম হয়ে গেছে। গ্রামে এখনো বৈঠকখানা থাকলেও তা মূল বাড়ির বাইরে। শহরে বাড়ি বা ফ্ল্যাটবাড়িতে ড্রয়িংরুম মূল বাড়ির অংশ। শহরের লোক তাকে আর বৈঠকখানা বলে না, ড্রয়িংরুম বলে। তাই ড্রয়িংরুম শব্দটাকে আর বাংলা ভাষার বাইরে রাখা যাবে না।

ড্রয়িংরুমে সাধারণত থাকে বসার জন্য সোফাসেট। বাংলায় যাকে বলা যেতে পারত সুখমঞ্জিল। কিন্তু তা বলা হয় না। অনেকের ড্রয়িংরুমে নিচু চৌকির মতো দেখতে আয়েশ করে বসার একটি লম্বা আসন থাকে—যার ইংরেজি নাম ডিভান। বাংলাতেও তা-ই।

বিদেশি শব্দ শুধু বাঙালিরাই ধার করে না, ইংরেজরাও করে। ধারের ব্যাপারে ইংরেজদের বাছবিচার নেই। সব ভাষা থেকেই তারা শব্দ ধার করে।

ডিভান ইংরেজি ভাষায় ধার করা একটি শব্দ। ডিভান শব্দের আভিধানিক অর্থ হেলান দেওয়ার ব্যবস্থাবিহীন লম্বা, নিচু ও নরম আসন।

ডিভান শব্দের ইতিহাস বেশ দীর্ঘ। এর শুরু প্রাচীন ফারসি ভাষা থেকে। প্রাচীন ফারসিতে শব্দটি ছিল দিওয়ান, যার অর্থ ছিল ছোট বই। পরে এর অর্থ দাঁড়ায় হিসাব বই। আরও পরে হিসাবরক্ষকের দপ্তর। শব্দটির ইতিহাসের এখানেই শেষ নয়। হিসাবরক্ষকের দপ্তরের সঙ্গে যুক্ত হয় কর দপ্তর, শুল্ক দপ্তর এবং এমনকি আদালতও। সবশেষে তা পরিণত হয় রাজসভায়, যেমন দেওয়ানি আম, দেওয়ানি খাস ইত্যাদি নামে।

শব্দের অর্থের উন্নতি ঘটে, আবার অবনতিও হয়। ফারসি দিওয়ান শব্দের প্রথমে উন্নতি শুরু হয়, তারপর শুরু হয় অবনতি। অর্থের অবনতির ফলে দিওয়ান শব্দের অর্থ দাঁড়ায় বিভিন্ন কারবারি প্রতিষ্ঠানের দেয়ালের সঙ্গে সংলগ² লম্বা নিচু বেঞ্চি—কাজে আসা মানুষের বসার জন্য।

ফারসি দিওয়ান ১৬ শতকে ইংরেজি ভাষায় ঢোকে ডিভান হয়ে। তবে তা প্রথমেই ড্রয়িংরুমে না। ১৯ শতক পর্যন্ত ইংরেজিতে ডিভান শব্দের অর্থ ছিল ধূমপানের জন্য নির্দিষ্ট কক্ষ। ধূমপান একজনে করত না, কয়েকজন মিলে করত। তাদের জন্য বসার জায়গাও ছিল। এই বসার জায়গাটাই পরে ড্রয়িংরুমের ডিভানে পরিণত হয়।

অলংকরণ: সাদমান মুন্তাসির

ব্যাডমিন্টন

ব্যাডমিন্টন পেশাদারি একটা আন্তর্জাতিক খেলা। খেলাটা বাংলাদেশেও বেশ জনপ্রিয়। বাংলাদেশে খেলাটার পেশাদারি ও অপেশাদারি—দুটো দিকই রয়েছে। শীতকাল পড়লে ব্যাপারটা ধরা পড়ে। শহরের পাড়া-মহল্লায় এমনকি গ্রামেও ব্যাডমিন্টন কোর্ট কাটার ধুম পড়ে যায়। শহরে রাতের বেলায় ইলেকট্রিক বাতি জ্বালিয়ে ব্যাডমিন্টন খেলা জমে ওঠে।

ফুটবল, ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টন, হ্যান্ডবল, হকি ইত্যাদি বিদেশি খেলা। এসব খেলার নামের বাংলা করা সম্ভব নয়। সে চেষ্টাও কেউ করেননি।

শব্দ হিসেবে ব্যাডমিন্টন ইংরেজি শব্দ। খেলাটার আনুমানিক শুরুও ইংরেজদের হাতে। এর আগে খেলাটার একটা ছেলেমানুষি সংস্করণ ছিল। নাম ছিল ব্যাটেলডোর। শব্দটা পর্তুগিজ ব্যাটেডর থেকে পাওয়া। অর্থটা একটু বিচিত্র। ধোপারা বারবার আছাড় দিয়ে যেভাবে কাপড় কাচে, সেই ব্যাপারটাই এক কথায় প্রকাশ ছিল পতুর্গিজ ব্যাটেডর। দুদিকের র্যাকেটের আঘাতের মাঝে শাটলককের বারবার আসা-যাওয়ার সঙ্গে দৃশ্যটা বেশ মিলে যায়।

আনুষ্ঠানিকভাবে ব্যাডমিন্টন খেলার শুরু ১৮৯০ অথবা ১৮৭০ দশকে। ইংল্যান্ডের ডিউক অব বিউফোর্টের গ্রামীণ প্রাসাদ অঙ্গনে ব্যাডমিন্টন হাউসে খেলাটা শুরু করেন ইংরেজ রাজপুরুষেরা। কালক্রমে তা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে।

বাকসো

ইংরেজি বক্স বাংলায় হয়েছে বাকসো বা বাক্স। বাক্স-পেটরা বললে এর মধ্যে বাক্সের শব্দটাকে ইংরেজি বলে চেনা যায় না।

ইংরেজি Box কথাটা এসেছে ল্যাটিন Buxis থেকে। আর ল্যাটিন এই শব্দটি তৈরি হয়েছে গ্রিক Puxis কিংবা Pyxos থেকে। গ্রিক ভাষায় এটি একটি গাছের নাম। এই গাছের কাঠ থেকেই তৈরি হতো সে কালের Box-বাক্স—যা এখন কাঠ, টিন, চামড়া, র‌্যাক্সিন—সবকিছুরই হয়। তবু Box বাক্সের পরিচয় গাছেরই নামেই।