বিশে বিশ্বজয়

সাইক্লিস্টদের জন্য শীতকাল আসে উৎসবের মতো। বড় বড় সাইকেল রাইড দেওয়ার মোক্ষম সুযোগ ঘটে এই শীতকালে। আরাম করে সাইকেল চালানো যায় এ মৌসুমে। টানা অনেকটা পথ খুব সহজেই পাড়ি দেওয়া যায় এ সময়। দলবল নিয়ে সাইকেল চালিয়ে অনেকে চলে যায় এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায়। কেউ আবার একা একাই সাইকেল চালিয়ে চলে যায় দূরদূরান্তে। কিছু সাইক্লিস্ট এ সময় সাইকেলটা চালিয়ে পুরো দেশ ঘুরে বেড়ানোর পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বেরিয়ে পড়ে। সাইকেলে করে পুরো দেশ, চাট্টিখানি কথা?

তবে আজ এমন একজনের গল্প বলব, যার কাছে এটা সত্যিই চাট্টিখানি কথা। কারণ, তিনি সাইকেল চালিয়ে চক্রাকারভাবে পুরো পৃথিবী ঘুরে এসেছেন! ২০ বছর বয়সী ভেদানগি কুলকার্নি সবচেয়ে কম বয়সী নারী ও দ্রুততম এশিয়ান হিসেবে সাইকেল চালিয়ে পুরো পৃথিবী ঘোরার রেকর্ড গড়েছেন। যুক্তরাজ্যের বোর্নমাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে স্পোর্টস ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে পড়াশোনা করছেন ভারতীয় এই শিক্ষার্থী।

ভেদানগির জার্নিটা খুব একটা সহজ ছিল না। পুরো পৃথিবী ঘুরে আসতে তাকে পাড়ি দিতে হয়েছে প্রায় ২৯ হাজার কিলোমিটার! প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১৮০ মাইল! সময় লেগেছে ১৫৯ দিন, পাড়ি দিতে হয়েছে ৪টি মহাদেশ, ১৫টি দেশ। দীর্ঘ এ যাত্রায় সর্বনিম্ন -২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ও সর্বোচ্চ ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সাইকেল চালিয়েছেন তিনি।

ভেদানগি তাঁর রাইডের শুরুতে প্রতিদিন ৪০০ কিলোমিটার সাইকেল চালাবেন বলে ঠিক করেন। এভাবে ২১ দিনে শেষ হয় যুক্তরাজ্যের অংশ। অন্য দেশে ঢোকার পর বেড়ে যায় তাঁর সাহস ও আত্মবিশ্বাস। তিনি বলেন, ‘আমি যখন টের পেলাম আমি একা এক দেশ থেকে অন্য দেশে যেতে পেরেছি, তখনই আমার মনে হয়েছে, কিছু করতে চাইলে এখন আর আমার কাউকে প্রয়োজন নেই। আমার জন্য পুরো যাত্রাটা ছিল সাইকেলের সঙ্গে নতুনভাবে পৃথিবীটাকে আবিষ্কার করা।’

বিশ্ব রেকর্ড, এত বড় রাইড—শুনতে মজার শোনালেও পুরো অভিযানে কঠিন সব পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছেন ভেদানগি। এক দেশ থেকে আরেক দেশে যেতে প্রতিবার প্রয়োজন হয়েছে ভিসার। ভিসা–জটিলতা বারবার সমস্যায় ফেলেছে তাঁকে। সাইকেল, ব্যাগ, অন্যান্য জিনিসসহ ৩০-৩৫ কেজি ওজন বহন করতে হয়েছে তাঁকে। ভেদানগি সাধারণত গ্যাসস্টেশনগুলোতে বিরতি নিতেন। তাঁর ছিল না কোনো নির্দিষ্ট খাদ্যাভ্যাস। গ্যাসস্টেশনগুলোতে সস্তায় ক্যালরিযুক্ত যেসব খাবার পেয়েছেন, তা–ই খেয়েছেন তিনি।

ভেদানগির ইউরোপ অভিজ্ঞতা ছিল ভয়াবহ! স্পেন পাড়ি দেওয়ার সময় মুখোমুখি হন ডাকাতের। এ ঘটনায় অনেকটা ক্ষতিগ্রস্ত হন তিনি। তবে হাল ছাড়েননি। সাইকেলটা ঠিকঠাকই ছিল তাঁর। সাইকেলে ভরসা রেখেই চালিয়ে যান তাঁর অভিযান। সে সময় তাঁর এমনও দিন কেটেছে, যেদিন হাঁটার চেয়ে ধীরগতিতে সাইকেল চালিয়েছেন। কখনো ৪–৫ ঘণ্টা পথ শেষ করতে সময় লেগে যেত প্রায় ১০ ঘণ্টা।

ভেদানগির স্বাভাবিক রুটিন ছিল ৪ ঘণ্টা রাইড, ২৫ মিনিট বিরতি, আবার ৪ ঘণ্টা রাইড এবং এরপর ৪-৫ ঘণ্টা বিরতি। ঘুমানোর জন্য নিরাপদ জায়গা পেলেই কেবল তাঁবু টাঙাতেন এই অভিযাত্রী।

রাশিয়ায় বেধেছিল আরেক বিপত্তি। একা একা ক্যাম্পিং করতে গিয়ে শূন্য ডিগ্রিরও নিচের তাপমাত্রায় তুষারপাতের কবলে পড়তে হয়েছিল ভেদানগিকে। তবে রাশিয়ার মানুষকে খুব উদার মনে হয়েছে তাঁর। তীব্র সেই শীতে গাড়ির হিটার ব্যবহার করতে দিয়েছিল রাশিয়ানরা। সেখানে প্যানকেক ও চায়ের দাওয়াতও পেয়েছেন তিনি।

ভারতে এসে শেষ হয় ভেদানগির যাত্রা। রেকর্ড গড়ার পর তিনি ভেসেছেন মানুষের শুভেচ্ছাবার্তায়। ভারতের রাজনীতিবিদ রাহুল গান্ধীও অভিনন্দন জানান ভেদানগিকে।

এতটা পথ ভেদানগি পাড়ি দিতে পেরেছেন তাঁর সাহস, মনের জোর ও আত্মবিশ্বাস থেকে। তুমি চাইলে সাইকেল চালিয়ে বিশ্বভ্রমণের স্বপ্ন দেখতে পারো। তবে সে স্বপ্ন পূরণ করতে হলে তোমাকে সবার আগে হতে হবে দক্ষ একজন সাইক্লিস্ট। সে জন্য তোমাকে যেতে হবে বিভিন্ন ছোট-বড় সাইকেল রাইডে। তাহলে তোমার সাইকেল নিয়ে এই শীতেই বেরিয়ে পড়ো সাইকেল রাইডে!

তথ্যসূত্র: দ্য হিন্দু, বোর্নমাউথ ইউনিভার্সিটি