বুলবুলিতে ধান খায় না

বুলবুলি খেজুর খেলেও ধান খায় না
বুলবুলি খেজুর খেলেও ধান খায় না

চিলে কি কান নিয়ে যায়? চিল অত বোকা নয়, তোমার-আমার কান সে নেবে না। তবে কানের কাছে মাইক বাজালেও যারা বিশ্বাস করে না পৃথিবী গোল, কিংবা চাঁদে মানুষ গেছে কিংবা সত্যকে পাশ কাটিয়ে যারা গুজবের মিছিলে শামিল হয়, একবার নিজের কানে হাত দিয়ে দেখবে না আদৌ কান দুটো মাথার দুপাশে ঝুলছে কি না, তাদের কান যদি চিল নিয়ে যায়, খুব একটা অন্যায় বোধ হয় হবে না তাতে। তাই চিলে কান নেয় না জেনেও নিজেদের অতি চালাক ভাবা বোকাদের উদ্দেশে কবি শামসুর রাহমান লিখেছিলেন, ‘এই নিয়েছে ঐ নিল যাঃ! কান নিয়েছে চিলে/ চিলের পিছে মরছি ঘুরে আমরা সবাই মিলে।/...দিন-দুপুরে জ্যান্ত আহা, কানটা গেল উড়ে,/ কান না পেলে চার দেয়ালে মরব মাথা খুঁড়ে।/ কান গেলে আর মুখের পাড়ায় থাকল কি-হে বল?/ কানের শোকে আজকে সবাই মিটিং করি চল।’ কানের শোকে বোকার হদ্দরা সব মিটিং করে বেড়াক। আমরা এদিকে পাখিদের নিয়ে আর কত গালগল্প আছে তা দেখে আসি।

গাঁয়ের লোকেরা একে বলে কুটুম্ব পাখি। লোকালয়ে তেমন আসে না। মাঝে মাঝে উড়ে যায় মানুষের বাড়ির ওপর দিয়ে। ক্যা ক্যা করে ডাকে তখন। এই ডাক শুনে লোকে বলে বাড়িতে কুটুম্ব অর্থাত্ অতিথি আসবে আজ। কোনো কোনো দিন আসেও। তবে সেটা কাকতালীয় ঘটনা। আসলে কুটুম্ব আসার সঙ্গে এই হাঁড়িচাঁচার কোনো সম্পর্ক নেই।

তবে পাখির রাজ্যে এদের নেমন্তন্ন লাগে না, গৃহস্থ বেজার হলেও কিছু মনে করে না এরা। সুযোগ পেলে চুপিসারে নইলে জোর করেই অন্য পাখির বাসায় মেহমান হয়ে যায় লেজঝোলা পাখিটা। হাঁড়ি চেঁছে চেটেপুটে খায়। তাতে কিন্তু বড় রকমের ক্ষতি স্বীকার করতে হয় গৃহস্থদের। পাখিদের তো হাঁড়ি-পাতিল নেই, সম্পদ বলতে আছে শুধু বাসাটা। তার ভেতর ডিম আর ছানা। সেগুলোই সাবাড় করে হাঁড়িচাঁচারা। পাখির রাজ্যে এই সর্বনেশে মেহমানকে তাই কেউ ভালোবাসে না। ছোট ছোট পাখি একজোট হয়ে লড়ে যায় অযাচিত মেহমানটির বিরুদ্ধে। তাতে কখনো তাদের হার, কখনো জিত।

পাখির রাজ্যে অনাকাঙ্ক্ষিত মেহমান হাঁড়িচাঁচা
পাখির রাজ্যে অনাকাঙ্ক্ষিত মেহমান হাঁড়িচাঁচা

পুরোনো যুগের কথা। এক ব্রাহ্মণের ছিল এক রাখাল। প্রতিদিন রাখাল যেত মাঠে গরুর পাল চরাতে। সেই মাঠে ছিল ইছা নামের এক নদী। রাখাল আর গরুর পাল তৃষ্ণা মেটাত সেই নদীর পানিতে।

একদিন এক চৈত্রের দুপুর। কাঠফাটা গরম। রাখাল গরুগুলোকে মাঠে ছেড়ে দিয়ে নিজে বসে এক গাছের ছায়ায়, পড়ে থাকা কাঠের ওপরে। প্রচণ্ড খরতাপে গরুগুলোর গলা শুকিয়ে কাঠ। পানির জন্য ছোটে ইছা নদীর তীরে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়েছে, কিন্তু ফেরে না গরুর দল। এতক্ষণে মনে পড়ে রাখালের। পড়িমরি করে ছুটে যায় নদীর ঘাটে। কিন্তু হায়, নদীতে এক ফোঁটা পানি নেই! পিপাসায় কাতর হয়ে মারা গেছে সব গরু। মৃতদেহ পড়ে আছে নদীর কিনারে। কী করবে এখন রাখাল! ভয়ে কাঠ হয়ে ফিরে আসে বাড়ি। ‘একা কেন, গরুগুলি কোথায়?’ জানতে চান ব্রাহ্মণ। রাখাল ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সব ঘটনা খুলে বলে। ক্রোধে জ্বলে ওঠে ব্রাহ্মণের মেজাজ। রাখালকে অভিশাপ দেন। পিপাসায় কাতর গরুগুলোকে মেরেছিস তুই, পৃথিবীর জল তোর কপালে আর জুটবে না। পাখি হয়ে উড়ে যা তুই বহুদূরে।’

ব্রাহ্মণের অভিশাপ ফলে যায় সঙ্গে সঙ্গে। রাখাল পরিণত হয় চাতক পাখিতে। চলে যায় সে বহুদূরের দেশে। পৃথিবীর পানি সে পাবে না। তাই মেঘকে ডেকে জল নামায়। হাঁ করে পান করে ঝরে যাওয়া বৃষ্টির জল। বহুদিন যদি বৃষ্টি না হয়, তবুও চাতক মাটিতে নেমে পানি খেতে পারে না। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়। চাতক তখন বৃষ্টির জন্য করুণ স্বরে আর্তনাদ করে। তবু বৃষ্টি হয় না। একসময় চাতকের গলা দিয়ে আগুনের ফুলকি ঝরে। অন্ধকার রাতে সেই আগুনের ফুলকি নাকি আজও  দেখা যায়।

চাতক বা পাকড়া পাপিয়া প্রায়ই মাটিতে নামে
চাতক বা পাকড়া পাপিয়া প্রায়ই মাটিতে নামে

পুরোটাই গল্প। চাতক মোটেও বৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করে না। আর দশটা সাধারণ পাখির মতোই তার জীবনযাপন। মাটিতে নেমে খাবার খোঁজে, পানিও খায়। গাছের ডালে কিংবা বিদ্যুতের তারে বসে হাঁ করে ডাকে। বড্ড করুণ সে ডাক। হয়তো এভাবে ডাকতে দেখেই চাতক পাখির ওই গল্প বানিয়েছিল মানুষ।

খালের ধারে একটা খেজুরগাছ। ডাঁসা আর পাকা খেজুরে নুয়ে পড়েছে কাঁদিগুলো। কোত্থেকে একটা বাংলা বুলবুলি এসে চড়ে বসে কাঁদিতে। আধাপাকা খেজুরও খুব প্রিয় এই পাখিটার। বিচিত্র ভঙ্গিতে সেই খেজুর কুরে কুরে খায় বুলবুলি।

বুলবুলি ফল খায়। তাই ফলদ গাছের আশপাশে এদের দেখা যায় বেশি। খেজুর, ডুমুর, বট, আম, জাম, পেয়ারা, পেঁপে, তেলাকুচো এদের খুব প্রিয়। আবার পোকাও খায়। কিন্তু ধান-চাল খেতে দেখা যায় না কখনো। খেতে পারে না কোনো শস্যদানাই। শস্যদানা খাওয়ার জন্য একধরনের শক্ত ঠোঁট দরকার। চড়ুই কিংবা মুনিয়া পাখিদের এ ধরনের ঠোঁট থাকে। বুলবুলির সে রকম ঠোঁট নেই। তবে ছোট ছোট পোকা খায় বুলবুলি। গাছের ডালে ওত পেতে বসে থাকে। পোকা দেখলেই সামান্য উড়ে যায়। তারপর এক পাঁকে পোকাটাকে ধরে আবার আগের জায়গায় ফিরে আসে। শীতকালে খেজুর রসের নলিতে বসে রস খায় বুলবুলি। কিন্তু ধান-গম ছুঁয়েও দেখে না।

ধান যদি না খায় তাহলে ওই প্রবাদের কী হবে, ‘বুলবুলিতে ধান খেয়েছে, খাজনা দিব কিসে!’ সেকালের নিষ্ঠুর জমিদারের গর্দভ পাইকেরা গরিব কৃষকদের অত্যাচার করত খাজনার জন্য। তাদের উদ্দেশেই কি এই প্রবাদবাক্য আওড়াত চাষিরা? হয়তো।

এই যুগেও এমন গর্দভ বাহাদুরের অভাব নেই। হুতোম প্যাঁচার মাথায় নাকি লাখ টাকার ম্যাগনেট থাকে, টিপা পাখির পালকের দাম নাকি হাজার টাকা! হুজুগে মাতাল কিছু লোক সেসব বিশ্বাস করে। ছানাদের মাতৃহারা করে বাসা থেকে ধরে আনে পাখিদের। তারপর সেগুলো কী করে কে জানে? আজ পর্যন্ত এদের কাউকে লাখপতি হতে দেখা  যায়নি পাখির মাথা কিংবা পালক বেচে। এদের কি লজ্জা দেওয়ার মতো কোনো বুদ্ধিমান ছেলে আছে? যে ছেলে ‘পণ্ডশ্রম’ কবিতায় বলেছিল, ‘...কেন মিছে/ কানের খোঁজে মরছ ঘুরে সোনার চিলের পিছে?/ নেইকো খালে, নেইকো বিলে, নেইকো মাঠে গাছে;/ কান যেখানে ছিল আগে সেখানটাতেই আছে।’