বুড়ো বিজ্ঞানীদের গপ্পো

সুকুমার রায়ের প্রফেসর হেশোরাম হুশিয়ার
সুকুমার রায়ের প্রফেসর হেশোরাম হুশিয়ার

চায়ে ভিজিয়ে বিস্কুট অনেকেই খায়। চায়ের সঙ্গে মুড়ি-চানাচুরও চলতে পারে। তাই বলে চায়ে ভিজিয়ে কলা!

তুমি না খেলে কী হবে, জং বাহাদুর এভাবেই কলা খায়। জং বাহাদুরকে চিনতে পারছ না? বাদ দাও। চিল্লানোসেরাসের কথা নিশ্চয়ই মনে আছে? বড় বিপদে পড়া গেল তো! জং বাহাদুরকে চেনো না, চিল্লানোসেরাস কি জানো না! তাহলে নিউটন নামের বিড়ালটার কথাও নিশ্চয়ই মনে নেই?

আচ্ছা, তাহলে গোড়া থেকেই সেই বুড়ো বিজ্ঞানীদের গল্প বলি। তাহলে সব দেখবে সুড়সুড় করে মনে পড়ে যাবে।

হ্যাঁ, বাংলার তিন বুড়ো বিজ্ঞানী—প্রফেসর হেশোরাম হুশিয়ার, ত্রিলোকেশ্বর শঙ্কু ও আমাদের বিজ্ঞানী সফদর আলী। এই তিনজনের কথা শুনলেই আমার প্রথম মনে হয়, আহারে! এদের তিন কুলে কেউ নেই!

আসলেই তাই। শঙ্কু, সফদর আলী বা হেশোরাম; এঁদের আসলে কোনো আত্মীয়স্বজনের খোঁজ পাওয়া বেজায় কষ্ট। শুধু হেশোরাম হুশিয়ারের এক ভাগনের কথা শোনা যায়। তা-ও সে সত্যি না নকল; তা নিয়ে সন্দেহ আছে। তবে মিল-বেমিল যাই থাক, একটা কথা নিশ্চিত জেনে রাখো—এই তিন বিজ্ঞানীর মতো বড় বিজ্ঞানী বাংলায় আর নেই!

অবশ্য এই তিন বিজ্ঞানীকে নিয়ে কথা বলতে গেলে আরেকটু আগে থেকে শুরু করতে হবে। বাংলা সাহিত্যে প্রথম এ রকম খ্যাপা বিজ্ঞানী আমরা দেখতে পাই সুকুমার রায়ের কাছ থেকে; তবে তিনি হেশোরাম নন; তাঁর নাম প্রফেসর নিধিরাম পাটকেল। একে নিয়ে সুকুমার খুব বেশি লেখেননি। ‘সত্যি’ নামে একটা মাত্র গল্প লিখেছেন।

এক কবিতাতেই বেশ বোঝা যায়, নিধিরাম পাটকেল লোকটা মস্ত একজন বিজ্ঞানী ছিলেন। কী আবিষ্কার করেছেন? কেউ বলে তিনি উত্তর মেরু গিয়েছিলেন, কেউ বলে তিনি বোমা আবিষ্কার করেছেন। কিন্তু সুকুমার নিজেই বলেছেন, তাঁর মহা এক আবিষ্কার ছিল ‘গন্ধবিকট তেল’। এই তেল মাখিয়ে দিলে গোঁফ বড় হয়ে যায়। এক ভদ্রলোক ভুল করে নিজের ছেলেকে এই তেল মাখিয়ে দেওয়ায় বিরাট গোঁফ বেরিয়ে গিয়েছিল!

পাটকেল বাবু বিজ্ঞানী যেমনই হোন না কেন; তাঁর যে স্বভাবচরিত্র ওই একটা গল্পে দেখা যায়; এর সঙ্গে সত্যজিতের শঙ্কু আর সুকুমারেরই হেশোরামের পরে আমরা প্রচুর মিল খুঁজে পাই। অনেকে বলেন, আসলে সুকুমারের ওই নিধিরাম পাটকেল আর হেশোরামকে মিলিয়েই সত্যজিৎ বানিয়েছেন প্রফেসর শঙ্কু।

তাহলে হেশোরামের ব্যাপারটাও জেনে নিতে হয়, কী বলো?

মুহম্মদ জাফর ইকবালের সফদর আলী
মুহম্মদ জাফর ইকবালের সফদর আলী

হেশোরাম হুশিয়ারের ডায়েরি বলে একটা বইয়ে সুকুমার আমাদের জানিয়েছেন এই বিজ্ঞানীর কথা। অবশ্য সুকুমার বলেছেন, হেশোরামের এই ডায়েরি তিনি বানিয়ে বানিয়ে লেখেননি। তাঁর ভাগনে চন্দ্রখাই এই ডায়েরির কপি নিয়ে এসেছিলেন সুকুমারের সন্দেশ পত্রিকার অফিসে!

বিজ্ঞানী বলতে আমরা যে রকম উদ্ভাবক (ইনভেন্টর) বুঝি, হেশোরামের কাজ ছিল আসলে আবিষ্কার (ডিসকভার)। এই ডায়েরি পড়ে আমরা জানতে পারি যে তিনি একবার বন্দাকুশ পর্বতমালার কোনো এক দুর্গম এলাকায় অভিযানে গিয়েছিলেন ওই ভাগনেকে নিয়ে। উদ্দেশ্য ছিল বিরল সব প্রাণী আর উদ্ভিদের নমুনা সংগ্রহ করা।

অভিযানে বের হওয়ার পর প্রফেসর হেশোরাম হুশিয়ার যেসব প্রাণীর দেখা পেলেন, তা কল্পনাও করা কঠিন। পর্বতমালার কোনো এক উপত্যকায় তিনি খুঁজে পেলেন আজব সব প্রাণীকে—কেউ শুধু চিৎকার করে, কেউ ল্যাগব্যাগ করে হাঁটে, কেউ মানুষ দেখলেই কান্না করে, কেউ শুধু গোমড়া মুখে বসে থাকে। হেশোরাম এসব প্রাণীর নাম দিলেন—চিল্লানোসেরাস, ল্যাগব্যাগার্নিকাস, গোমড়াথেরিয়াম!

শুধু কী এসব প্রাণী? বিভিন্ন গাছপালাও খুঁজে পেলেন হেশোরাম। কিন্তু মুশকিলটা হলো, চন্দ্রখাইকে যখন এসবের প্রমাণ দেখাতে বলা হলো; তিনি বললেন, সব প্রমাণ ছিল, ছবি ছিল। কিন্তু এক ঝড়ে নাকি সব উড়ে গেছে। তার মামা হেশোরামেরও নাকি এখন কোনো খোঁজ নেই।

এসব শুনে সন্দেশ পত্রিকার লোকেরা গেল খেপে। তারা বলল, চন্দ্রখাই নিশ্চয়ই হেশোরামের জাল ভাগনে। তাই চন্দ্রখাইয়ের নাম দেওয়া হলো—গপ্পোথেরিয়াম!

হেশোরামের মতো শঙ্কুর কাজকারবার মোটেও ‘গপ্পোবাজি’ নয়। প্রফেসর ত্রিলোকেশ্বর শঙ্কুকে নিয়ে সত্যজিৎ রায় ৩৮টি পূর্ণাঙ্গ গল্প লিখেছেন; এ ছাড়া দুটি গল্প শেষও করে যেতে পারেননি। এগুলো একটার পর একটা বই আকারে বেরিয়েছে। তোমরা তো জানোই, শঙ্কুর সব কাহিনি লেখা হয়েছে ডায়েরির আকারে।

প্রফেসর শঙ্কু থাকতেন গিরিডি বলে একটা শহরে। সেখানেই তাঁর গবেষণাগার। আর বাড়িতে তাঁর সঙ্গী সেই নিউটন নামের বিড়ালটা আর চাকর প্রহ্লাদ। এ ছাড়া দুজন সঙ্গী বিভিন্ন সময় ছিলেন শঙ্কুর সঙ্গে—অবিনাশ বাবু ও নকুড় বাবু। শঙ্কুর খ্যাতি বিশ্বজোড়া। তাঁর লেখা বের হয় বিশ্বের নামকরা সব বিজ্ঞান পত্রিকায়। তাঁকে সম্মান দেয় আন্তর্জাতিক সায়েন্স কংগ্রেস। তাঁর বিদেশি বন্ধুরাও সব নামকরা বিজ্ঞানী। সমস্যার সমাধান করতে শঙ্কু জলের তলে, মঙ্গল গ্রহে, পাহাড়ের চূড়ায় ঘুরে বেড়ান। শঙ্কুর আবিষ্কারগুলোও সব জবরদস্ত—অ্যানাইহিলিন বন্দুক, মিরাকিউরল, নার্ভিগার, অম্নিস্কোপ, স্নাফগান, ম্যাঙ্গোরেঞ্জ, ক্যামেরাপিড, লিঙ্গুয়াগ্রাফ! তাঁর আবিষ্কার করা রোবুকে নিয়ে বিশ্বজুড়ে তোলপাড়।

এমন নামকরা বিজ্ঞানী শঙ্কুর শুরুটাই হয়েছিল শেষ দিয়ে। প্রথম ডায়েরিতেই দেখা যায় শঙ্কু পৃথিবী ছেড়ে মঙ্গল অভিযানে বের হচ্ছেন। এরপর গিরিডিতে তাঁর গবেষণাগারে অভিযান চালিয়ে পুরোনো ডায়েরিগুলো নাকি পাওয়া যায়।

সত্যজিৎ রায়ের ত্রিলোকেশ্বর শঙ্কু
সত্যজিৎ রায়ের ত্রিলোকেশ্বর শঙ্কু

শঙ্কুর তুলনায় আমাদের বিজ্ঞানী সফদর আলী একেবারে সাদামাটা মানুষ। তাঁকে বিজ্ঞানী বলে তেমন কেউ চেনেই না। বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরা কোনো ডিগ্রি আছে বলেও শোনা যায় না; আন্তর্জাতিক খ্যাতি তো দূরে থাক। কিন্তু এসবের মধ্যেও সফদর আলী বাকি সবার চেয়ে অনেক এগিয়ে। কারণ, তিনি বিজ্ঞানকে মানুষের কাজে লাগানোর চেষ্টা করেন, বিজ্ঞান দিয়ে কুসংস্কার দূর করার চেষ্টা করেন।

সফদর আলীর গল্পগুলো আমরা জানতে পারব মুহম্মদ জাফর ইকবালের লেখা বিজ্ঞানী সফদর আলীর মহা মহা আবিষ্কার বই থেকে।

সফদর আলী থাকেন ঢাকার শ্যামলীর ওদিকে কোথায় জানি! পরিষ্কার বাসার ঠিকানা জাফর ইকবালও জানতেন না। পরে অবশ্য একবার ঠিকানা জেনে গিয়েছিলেন সেই বাসায়। জাফর ইকবালের সঙ্গে সফদর আলীর পরিচয় জিলাপি খেতে গিয়ে। সেখানেই স্যার দেখলেন সফদর আলী জিলাপি ঠান্ডা করার একটা যন্ত্র আবিষ্কার করেছেন। এ ছাড়া বৃষ্টিতে ভিজে গেলে কাপড় ভেতরে ভেতরে শুকিয়ে ফেলারও উপায় আবিষ্কার করে ফেলেছেন।

এরপর একটার পর একটা গল্পে আমরা দেখি সফদর আলী স্টেনগান বানান, গিনিপিগ দিয়ে বিরিয়ানি রান্না করান, বান্দর জং বাহাদুরকে ট্রেনিং দিয়ে সহকারী বানিয়ে ফেলেন; সেই জং বাহাদুর আবার হিন্দি সিনেমা দেখে আর চায়ে ভিজিয়ে কলা খায়।

সফদর আলীর একটা বড় সমস্যা। স্বাভাবিক কোনো চিঠি তিনি লিখতে পারেন না। সব সময় টেলিগ্রামের মতো করে চিঠি লেখেন। আর সেই সব টেলিগ্রামের চিঠি পেয়ে জাফর ইকবাল স্যারের বাসায় সে কী সব ভীষণ কাণ্ড!

সফদর আলীর গল্পগুলোর কোনোটাকে তোমরা সায়েন্স ফিকশনের কাছাকাছি দেখবে, কোনোটা আবার পুরো গোয়েন্দা গল্প। কক্সবাজারে চোরাকারবারিদের ধরে ফেলেন বা ভণ্ডপীরের জালিয়াতি উদ্ধার করেন তিনি রীতিমতো শার্লক হোমসের মতো করে। আবার মুরগি নিয়ে গবেষণা করে তাদের বিকট আকৃতি দেন, গাছদের দিয়ে গাড়ি চালান বা বাঁদরকে বুদ্ধিমান করে তোলেন।

এই সফদর আলীকেই আবার আমাদের গল্পের বিজ্ঞানীদের মতো দুনিয়া সম্পর্কে বেখবর মনে হবে, যখন জানবে তিনি রমনা পার্কে গাছপালা থাকে এটাই জানেন না। এমনকি গাছের পাতা যে সবুজ হয়, ফুল হয় নানা রঙের, সে খবরও রাখেন না সফদর আলী!

তবে এসব না জানলে কী হবে, জং বাহাদুর মানে ‘বান্দর আলী’র ব্যাপারস্যাপার সফদর আলীর চেয়ে ভালো কেউ জানে না। বাঁদর কীভাবে খায়, বাঁদর কীভাবে চলে—এসব নিয়ে রীতিমতো গবেষণা করে ফেলেছিলেন তিনি। আর এই গবেষণা করতে গিয়েই সফদর আলীর স্বভাবও একসময় জং বাহাদুরের মতো হয়ে গেল। রাস্তাঘাটে চলতে চলতে তিনিও একসময় বলে উঠতেন—গুলু গুলু গুলু, মুচি মুচি মুচি!

তোমরা জং বাহাদুরের মতো চায়ে ভিজিয়ে কলা খেতে পারো, সমস্যা নেই। কিন্তু রাস্তাঘাটে আবার এমন ‘গুলু গুলু, মুচি মুচি’ বলে ফেলো না। তাহলে কিন্তু শঙ্কু, হেশোরাম আর সফদর আলী মিলেও তোমাকে বাঁচাতে পারবেন না; বন্ধুরা ‘বান্দর আলী’ বলে ডাকবেই ডাকবে!