বড় হয়ে আমি হব

পিচ্চিবেলায় দুটি প্রশ্ন সম্ভবত আমরা সবচেয়ে বেশি শুনেছি। বাড়িতে কোনো অতিথি এলেই থুতনি ধরে জিজ্ঞেস করত—

  • তোমার নাম কী বাবু?

  • বড় হয়ে তুমি কী হবে?

কী মুশকিল! ‘বাবু চকলেট খাবে? বেড়াতে যাবে?’—এই প্রশ্নগুলো কত্ত সুন্দর! অথচ এসব নয়, যাবতীয় বেরসিক প্রশ্ন করতেই তারা বেশি উৎসাহী। ছোটবেলায় কত কিছুই তো হওয়ার ইচ্ছা থাকে, সেটা কি আর বড়দের কাছে চট করে বলা যায়? স্কুলের সামনে আইসক্রিমওয়ালাকে দেখে কখনো তাঁর মতো হতে ইচ্ছা হয়। কখনো মাথায় ভূত চাপে, আমি হব এক চোখে পট্টি বাঁধা জলদস্যু! কাঁধে আম্মুর লাল ওড়না বেঁধে সুপারম্যান হওয়ার চেষ্টাও হয়তো করেছ কেউ কেউ। একটু যখন বড় হয়েছ, কোচিং স্কুলের ভারী ব্যাগ টানতে টানতে এত দিনে বুঝে ফেলেছ, সুপারম্যান হওয়াটা আদতে সম্ভব নয়।

কিন্তু বিশ্বাস করো, সুপারম্যানের চেয়েও অনেক মজার, রোমাঞ্চকর, সফল কিছু হওয়ার সুযোগ তোমার সামনে আছে। চীনা দার্শনিক কনফুসিয়াস বলেছিলেন, ‘এমন একটা পেশায় যোগ দাও, যা তুমি ভালোবাসো। তাহলে জীবনে একদিনের জন্যও তোমাকে “কাজ” করতে হবে না।’ তাই তো, আনন্দ নিয়ে করলে কাজটাও যে খেলার মতো!

তোমার বন্ধুদের অনেকে ভালো অঙ্ক করতে পারে, কেউ গান গাইতে পারে, কেউবা ভালো ক্রিকেট খেলে...আরও কত কী! তুমি হয়তো কিছুই পারো না। মানলাম, এসবের কিছুই তোমার পছন্দ না। চকলেট খেতে ভালোবাসো তো? তোমাকে এক তরুণীর কথা বলি, তার নাম ক্যাট শ্যানন। ক্যাডবেরি কোম্পানিতে ‘চকলেট টেস্টার’ হিসেবে কাজ করে সে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তার চাকরি হলো বসে বসে চকলেট খাওয়া! এ কাজের জন্য তাঁর বেতন কত জানো? প্রতি ঘণ্টায় প্রায় আট শ নব্বই টাকা! বিশ্বাস করো, একদম গুল মারছি না। চাইলে গুগল সার্চ করে বিস্তারিত জেনে নিতে পারো।

এখন প্রশ্ন হলো, কীভাবে ঠিক করবে তুমি কী হতে চাও? এই প্রক্রিয়াটা একটু জটিলই বটে।

কী করি আমি!

ধরি, ছেলেটার নাম টোপন। টোপনের বাবা আগেই ঘোষণা দিয়ে দিয়েছেন, ছেলে হবে ডাক্তার। মা চান ও সেনাবাহিনীতে যোগ দিক। বিকেলে বাসায় পড়াতে আসে যে বুয়েটের ভাইয়া, সে বলে ‘ইঞ্জিনিয়ারিং না পড়লে জীবন বৃথা।’ ওদিকে পাশের বাসার আন্টি এসে আম্মুকে বোঝান, ‘বলেন কী ভাবি! আজকাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে লোকজন ব্যাংকে চাকরি করছে! বিবিএ না পড়লে স্মার্ট হওয়া যায় নাকি?’ এত হট্টগোলের ভিড়ে টোপন বেচারা পড়েছে বিপদে।

ছবি: কবির হোসেন

এই বিপদে হয়তো তুমিও আছ। অনেকে তোমার ভালো চান বলেই নানান পরামর্শ দেন। খেয়াল করে দেখো, তুমিও হয়তো তোমার চেয়ে ছোট যারা, বিজ্ঞের মতো তাদের পরামর্শ দেওয়ার চেষ্টা করো! অন্যকে জ্ঞান দেওয়ার মজাই আলাদা! পরামর্শ কাজে লাগিয়ে কীভাবে নিজের সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায়, আমিও বরং তোমাকে সে-সংক্রান্ত কিছু ‘জ্ঞান’ দেওয়ার চেষ্টা করি!

  • কী কী করতে তোমার ভালো লাগে, সেসবের একটা তালিকা তৈরি করো। হতে পারে ছবি আঁকা, মাথা খাটানো, ঘুরে বেড়ানো, খেলাধুলা, যন্ত্রপাতি নিয়ে খুটুর খাটুর...কিংবা অন্য কিছু। যেগুলো বেশি ভালো লাগে, সেসব ওপরের দিকে রাখো। সেরা তিনটা বাছাই করো।

  • এবার দেখো, তোমার পছন্দের কাজগুলোকে আরও বিস্তারিতভাবে কীভাবে আলাদা করা যায়। যেমন তুমি হয়তো ছবি আঁকতে ভালোবাসো। তাহলে তোমার সামনে অবারিত দ্বার। তুমি হতে পারো চিত্রশিল্পী, কার্টুনিস্ট, অ্যানিমেটর, গ্রাফিকস ডিজাইনার, স্থপতি...অনেক কিছুই। কিংবা তোমার হয়তো পাখি ভালো লাগে। পাখি নিয়ে কাজ করারও উপায় আছে। হতে পারো পাখিগবেষক। আলোকচিত্রী হয়ে পাখিদের ছবি তুলতে পারো কিংবা পাখি সংরক্ষণে কাজ করে এমন প্রতিষ্ঠানেও তুমি কাজ করতে পারো। পছন্দের বিষয়ে ভবিষ্যতে কী কী সুযোগ আছে, সেসবের একটা তালিকা তৈরি করো। প্রয়োজনে সাহায্য নাও বড়দের কিংবা ইন্টারনেটের।

  • মোটামুটি লম্বা একটা তালিকা বোধ হয় পেয়ে গেছ। এই তালিকা থেকে বেছে নিতে হবে, কোন কাজটা তুমি করতে চাও। সম্ভব হলে এই কাজগুলোর সঙ্গে জড়িত আছে, এমন কারও সঙ্গে কথা বলো। কতটুকু সময় দিতে হয়, ভবিষ্যতের এই কাজের সম্ভাবনা কেমন, সুবিধা-অসুবিধাগুলো কী কী, সে সম্পর্কে খোঁজ নাও। সব বিবেচনার পর আব্বু-আম্মুর সঙ্গে কথা বলে সিদ্ধান্তটা তোমাকেই নিতে হবে।

  • বড় হয়ে তুমি কী হবে?—আত্মীয়স্বজনের এই প্রশ্নে চট করে কোনো উত্তর দিয়ে ফেলো না। আগে নিজের লক্ষ্যটা নিজেই ঠিক করো। নিশ্চিত হয়ে তারপর নাহয় প্রশ্নের একটা উত্তর দেওয়া যাবে। যদি ব্যাপারটা এমন হয়, ছোটবেলায় মা শিখিয়ে দিয়েছেন এই প্রশ্নের উত্তরে বলতে হবে ‘আমি ইঞ্জিনিয়ার হব।’ তুমিও সবাইকে এ কথা বলছ। একটা সময় দেখা গেল পরিচিতজনেরা তোমাকে ‘হবু ইঞ্জিনিয়ার’ ডাকতে শুরু করেছে। সবাই আশা করে বসে আছে তুমি প্রকৌশলীই হবে। প্রত্যাশার চাপে পড়ে প্রকৌশল ব্যাপারটা ভালো না বেসেই যদি তোমাকে প্রকৌশলী হতে হয়, পরে আফসোস হবে।

ছবি: কবির হোসেন

তবে এখনই সব জেনে ফেলতে হবে এমন কোনো কথা নেই। এখনই সব সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলতে হবে এমনও কোনো কথা নেই। কারণ, দেখা যায় অনেকেরই ছোটবেলায় ইচ্ছে থাকে স্থপতি হবে। পরে সমুদ্র নিয়ে নানান কিছু জানা হলে আগ্রহ জন্মায় মেরিন বায়োলজিস্ট হওয়ার। তবে যা করতে ভালোবাসো তাতে ছোটবেলা থেকেই মনোযোগী থাকলে বড় হয়ে দেখবে অসংখ্য কাজের সুযোগ তোমার আশেপাশেই। তাই ছোটবেলায়ই কীভাবে নিজেকে ‘বড়বেলা’র জন্য তৈরি করা যায়, সে জন্য কয়েকটা পেশা সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়ে দেখা যাক চলো।

পাইলট

ভালোমতো কথা শেখার আগেই দেখবে অনেক পিচ্চি বলে বসে, ‘বলো হয়ে আমি পাইলত হব!’ কেন অধিকাংশ ছোটরাই বড় হয়ে পাইলট হতে চায়, সেটা একটা রহস্য!

নভোএয়ারলাইনসের পাইলট ক্যাপ্টেন রেজাউর রহমানও ছোটবেলায় বিমানের ‘ড্রাইভার’ হতে চেয়েছিলেন। তাঁর পাইলট হতে চাওয়ার গল্পটা মজার। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের শেষ সময়ে ভারতীয় বিমানবাহিনীর উড়োজাহাজ যখন বাংলাদেশের আকাশে চক্কর দিচ্ছিল, গাছের মগডালে উঠে অবাক হয়ে এই ‘মহাপতঙ্গ’ দেখছিলেন ১০ বছর বয়সী রেজাউর। তখনই মনে মনে ঠিক করে ফেলেছিলেন, বড় হয়ে পাইলট হবেন। হয়েছেনও তাই!

ছবি: কবির হোসেন

বড় হয়ে পাইলট হতে চাইলে ছোটবেলায়ই কীভাবে নিজেকে প্রস্তুত করা যায়, সে সম্পর্কে কিছু টিপস দিলেন ক্যাপ্টেন রেজাউর। ‘পাইলট হতে হলে পড়াশোনায় খুব ভালো হতে হবে, ব্যাপারটা তা না। সায়েন্স ব্যাকগ্রাউন্ড হলে ভালো, গণিত বিষয়ে ভালো জ্ঞানটাও জরুরি। আর জানতে হবে ইংরেজি। আই কিউ ভালো হতে হবে। উচ্চমাধ্যমিকের পর যেকোনো ফ্লাইং স্কুলে ভর্তি হয়ে গেলেই পাইলট হওয়ার প্রক্রিয়াটা শুরু হয়ে যাবে।’ বলছিলেন তিনি। এ ছাড়া বিমানবাহিনীতে যোগ দিলেও পাইলট হওয়ার স্বপ্ন পূরণ হতে পারে।

মোটামুটি ৫০০ ঘণ্টা আকাশে ওড়ার অভিজ্ঞতা থাকলে পুরোদস্তুর বিমানচালক হওয়ার জন্য আবেদন করা যায়। সে জন্য আগে অবশ্যই লাইসেন্স পেতে হয়। স্বাস্থ্যটাও ফিট রাখতে হয় পাইলটদের। ক্যাপ্টেন রেজাউর আরও বলছিলেন ‘চোখ ভালো থাকতে হবে। ওজন নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। প্রতি বছর আমাদের মেডিকেল টেস্ট হয়। শারীরিকভাবে ফিট না হলে পাইলট হওয়া যায় না।’

পাইলট হওয়ার তিনটি সুবিধা ও তিনটি অসুবিধা

সুবিধা-অসুবিধাগুলা জানা থাকলে তোমার জন্য হয়তো সিদ্ধান্ত নেওয়াটা সহজ হবে। তাই ক্যাপ্টেন রেজাউর রহমানের কাছে আমরা জানতে চেয়েছিলাম পাইলট হওয়ার তিনটি সুবিধা ও তিনটি অসুবিধা।

ছবি: কবির হোসেন

সুবিধা

  • বিনা খরচে পৃথিবীর নানান দেশ ঘোরার সুযোগ হয়।

  • অ্যাডভেঞ্চারাস পেশা। সবাই একটু অন্য চোখে দেখে।

  • বেতনের অঙ্কটা বেশ ভালো।

অসুবিধা

  • বেশির ভাগ সময় পরিবার থেকে দূরে থাকতে হয়। ঈদ, বিয়ে, জন্মদিন...বিভিন্ন ধর্মীয় বা সামাজিক অনুষ্ঠানগুলোতে প্রায়ই অংশ নেওয়া হয় না।

  • রাত জেগে ফ্লাই করতে হয় বলে ঘুমের রুটিনটা বদলে নিতে হয়।

  • কাজটা কিছুটা ঝুঁকিপূর্ণ।

ডাক্তার

‘সফদার ডাক্তার, মাথা ভরা টাক তার’—এই ছড়া পড়তে পড়তে আবার ভেবে বোসো না, ডাক্তার হতে হলে মাথায় টাক থাকা চাই! টাক নয়, যেটা থাকা দরকার তা হলো—ধৈর্য। ডাক্তার তানজিনা হোসেন এমনটাই জানালেন। বলছিলেন, ‘ডাক্তার হতে হলে খুব যে মেধাবী হতে হয়, আমি সেটা মনে করি না। মাঝারি মানের মেধা নিয়েও ডাক্তারি পড়া যায়। খুব মেধাবী হলে বরং অন্য কোনো সৃজনশীল বিষয়ে পড়া উচিত।’

ছবি: কবির হোসেন

বটে! ধৈর্য তো থাকতেই হবে। স্কুলে ক্লাস এইটের সিলেবাস শেষ করতেই দম ফুরিয়ে যায়। ওদিকে চিকিৎসক হতে গেলে যে পরিমাণ পড়তে হয়, সে তো সিলে‘বাস’ নয়, রীতিমতো সিলে‘ট্রেন’! সে ট্রেনের বগিও অসংখ্য। সব সময় নতুন নতুন আবিষ্কার সম্পর্কে ধারণা রাখতে হয়, প্রতিনিয়তই শিখতে হয়। এই সিলেবাসে ‘শেষ’ বলে কিছু নেই। এতসব বিবেচনা করেই বোধ হয় ডাক্তার তানজিনা সাবধান করে দিলেন, ‘ধৈর্য না থাকলে ডাক্তারি না পড়াই ভালো।’

কুসংস্কার বিশ্বাস করলে ডাক্তার হওয়া কঠিন। মানুষের শরীর কাটাকুটি করতে হবে, মৃতদেহ দেখতে হবে...ভয় পেলে চলবে না। একটুখানি হাত কেটে গেলে রক্ত দেখেই যদি তোমার মাথা ঘোরায়, সেটা কিন্তু দুশ্চিন্তার বিষয়। প্রথমত কাজটাকে ভালোবাসতে হবে। আগ্রহ, ধৈর্য আর মনোযোগই বাকিটা উতরে দেবে।

ডাক্তার হওয়ার তিনটি সুবিধা ও তিনটি অসুবিধা

সুবিধা-অসুবিধাগুলো ডা. তানজিনার কাছেই জানা হলো।

সুবিধা

  • সবাই শ্রদ্ধার চোখে দেখে।

  • পরিবারের লোকজন কিংবা আত্মীয়দের জন্য একটা ‘ভরসা’ হয়ে ওঠা যায়।

  • মানুষের বিপদে সাহায্য করতে পারলে একটা মানসিক শান্তিবোধ হয়।

অসুবিধা

  • ধৈর্যটা একটু বেশিই লাগে। অনেক পেশায় কম বয়সেই নাম করা যায়। কিন্তু মোটামুটি একজন ভালো ডাক্তার হতে ৪০-৪৫ বছর বয়স হয়ে যায়। গ্র্যাজুয়েশনের পরই চাকরি জুটে যাবে, তা না। সারা জীবনই পড়ালেখা করতে হয়। প্রতিটা লেভেলেই পরীক্ষা দিয়ে দিয়ে উত্তীর্ণ হতে হয়।

  • অনেক সময় আনন্দ-উৎসব বিসর্জন দিতে হয়। হঠাত্ কোনো জরুরি প্রয়োজনে ব্যক্তিগত কাজ ফেলে হাসপাতালে ছুটতে হয়। এ নিয়ে মনে দুঃখ থাকলে চলবে না, মেনে নিতে হবে।

  • অনেক সময় দেখা যায়, ডাক্তাররা খুব চেষ্টা করেও রোগীকে বাঁচাতে পারেন না। কিন্তু রোগীর আত্মীয়স্বজনেরা সব সময় সেটা মানতে চান না। তাঁরা বুঝতে চান না। খেপে গিয়ে অনেক খারাপ কথাও বলে ফেলেন। তাঁদের মনের অবস্থাটাও একজন চিকিৎসককে বুঝতে হয়।

গোয়েন্দা

তোমার প্রিয় খেলোয়াড় কে? এই প্রশ্নের উত্তর তোমার কাছে আছে। সাকিব আল হাসান, লিওনেল মেসি, উসাইন বোল্ট...কারও না কারও নাম তুমি নিশ্চয়ই বলবে। যদি বলি তোমার প্রিয় গোয়েন্দার নাম কী? কেউ বলবে শার্লক হোমস; কেউ ফেলুদা, মাসুদ রানা কিংবা কিশোর পাশার নামও বলতে পারো। কিন্তু এরা তো সব গল্প-উপন্যাসের চরিত্র। একজন সত্যিকার গোয়েন্দার নাম বলো দেখি।

এমন প্রশ্নে ভড়কে গিয়ে কেউ ভাবতে পারো, গোয়েন্দারা বোধ হয় শুধু বইয়ের পাতায় কিংবা চলচ্চিত্রের পর্দায়ই থাকে। আসলে গোপনে, চুপিসারে কাজ করেন বলেই মানুষগুলোর নাম আমাদের জানা হয় না। তবে এমন একজন সত্যিকার গোয়েন্দার সঙ্গে তোমাদের পরিচয় করিয়ে দিতে পারি, গল্প-উপন্যাসেও যে চরিত্র পাওয়া দুষ্কর। তিনি ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা ও অপরাধ তথ্য বিভাগের (দক্ষিণ) সিনিয়র সহকারী পুলিশ কমিশনার মাহমুদা আফরোজ। হ্যাঁ, তিনি একজন গোয়েন্দা!

ছবি: কবির হোসেন

ছোটবেলায় তিন গোয়েন্দা, মাসুদ রানা পড়তে গিয়ে গোয়েন্দা হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন তিনি। পুলিশ বাহিনী হয়ে গোয়েন্দা বিভাগে যোগ দিয়েছেন। সাহসী ভূমিকার জন্য পেয়েছেন ‘রাষ্ট্রপতি পুলিশ পদক’ও।

মাহমুদা আফরোজ বলছিলেন, ‘বাংলাদেশে প্রাইভেট ডিটেকটিভ হিসেবে কাজ করার সুযোগ সম্ভবত নেই। ডিজিএফআই, ডিবি, সিআইডি, এনএসআই—এসব বিভাগে গোয়েন্দা হিসেবে যোগ দেওয়া যায়।’ বইয়ের পাতায় গোয়েন্দাদের কাজটা যেমন রোমাঞ্চকর মনে হয়, বাস্তবেও কি তাই?—প্রশ্ন শুনে বলেন, ‘রোমাঞ্চ তো আছেই। কখনো ছদ্মবেশ ধারণ করে, পরিচয় গোপন করে অভিযানে যেতে হয়। দেয়াল টপকে, রাস্তাঘাট পেরিয়ে অপরাধীকে ধাওয়া করতে হয়। প্রতিটা খুঁটিনাটি সূক্ষ্মভাবে দেখে আমাদের সূত্র খুঁজে বের করতে হয়।’

গোয়েন্দা যদি হতেই চাও, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বা অপরাধবিজ্ঞান বিষয়ে পড়তে পারো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান ড. মো. জিয়া রহমান জানালেন, ‘আমাদের এখানে ক্রিমিনোলজি বিভাগে অনার্স-মাস্টার্স করার সুযোগ আছে। নতুন বিভাগ, তাই চাহিদাও বেশি। খ কিংবা ঘ ইউনিটে পরীক্ষা দিয়ে রেজাল্ট মোটামুটি ভালো হলে ক্রিমিনোলজি নিয়ে পড়া যাবে। ক্রিমিনোলজির মূলত দুটো দিক আছে। একটা সোশিওলজিক্যাল, আরেকটা সাইকোলজিক্যাল। একজন অপরাধীর মনস্তত্ত্ব, সে কী করছে, কেন করছে—সেটা পড়ানো হয় সাইকোলজিক্যাল সাবজেক্টগুলোতে। আবার এসব অপরাধ সমাজে কীভাবে প্রভাব ফেলে, সে বিদ্যাটা সোশিওলজির মধ্যে পড়ে।’ এত সব কঠিন কঠিন কথা শুনে মনে হতে পারে, গোয়েন্দা গল্পগুলো পড়তে যেমন মজার, গোয়েন্দাগিরির পাঠ্যবইগুলো বোধ হয় তেমনটা নয়। এই মন্তব্যে জিয়া রহমানের অবশ্য তীব্র আপত্তি। ‘না না। বিষয়টা তো অবশ্যই খুব ইন্টারেস্টিং। একজন সিরিয়াল কিলার কেন খুন করে, তার মনস্তত্ত্বটা কী, এমন অদ্ভুত সব বিষয় নিয়ে পড়ানো হয়।’

চাইলে এখন থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খ কিংবা ঘ ইউনিটে ভালো পরীক্ষা দেওয়ার জন্য ভেতরে ভেতরে প্রস্তুতি নিতে পারো। এ ছাড়া টুকে নিতে পারো গোয়েন্দা মাহমুদা আফরোজের দেওয়া পরামর্শ, ‘গোয়েন্দা হতে হলে শারীরিকভাবে ফিট থাকতে হবে। লাগবে সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা আর ধৈর্য। শার্লক হোমসের একটা কথা আমার খুব ভালো লেগেছিল। মস্তিষ্কটা হচ্ছে একটা ঘরের মতো। এখানে প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো রেখে অপ্রয়োজনীয়গুলো ফেলে দিয়ে জায়গা করে নিতে হয়। প্রয়োজনীয়-অপ্রয়োজনীয় ভাবনা মিলে মাথায় জট বেঁধে গেলেই সমস্যা। এই পদ্ধতিটা আমি অনুসরণ করার চেষ্টা করি।’

গোয়েন্দা হওয়ার তিনটি সুবিধা ও তিনটি অসুবিধা

সুবিধা-অসুবিধাগুলো জানালেন মাহমুদা আফরোজ।

সুবিধা

  • একটা রহস্য সমাধান করার পর ভীষণ আনন্দ হয়। একটা কিছু সৃষ্টি করার মতো আনন্দ।

  • নিজের মধ্যে একধরনের দক্ষতা তৈরি হয়। অনেকে যে ব্যাপারটা বুঝতে পারে না বা বুঝতে সময় লাগে, আমি হয়তো সেটা সহজেই বুঝে ফেলি।

  • ভালো কাজ করলে সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। এটাও ভালো লাগে।

অসুবিধা

  • কাজটা ঝুঁকিপূর্ণ

  • বিড়ম্বনা আছে। বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়দের অনেক রকম চাওয়া থাকে। তারা বুঝতে চায় না, আমাদের কিছু সীমাবদ্ধতা আছে।

  • পরিবারে সময় দেওয়া যায় না।

অ্যানিমেটর

‘কয়েক বছর আগেও বাংলাদেশে অ্যানিমেশনের কাজ ছিল না বললেই চলে। বাইরের দেশগুলোতে বিপুল চাহিদা তো আছেই, বাংলাদেশেও বোধ হয় এখন এমন একটা বিজ্ঞাপনচিত্রও পাবেন না, যেখানে অ্যানিমেশনের কাজ নেই।’ বলছিলেন ড্রিমার ডাঙ্কির অ্যানিমেশন ডিরেক্টর তৌফিক আহমেদ আনোয়ার। বুঝতেই পারছ, আসছে সামনের দিনগুলোতে সম্ভবত অ্যানিমেটরদেরই জয়জয়কার থাকবে। হলিউডের ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখো। বাজেটের একটা বড় অংশ জমা থাকে অ্যানিমেশনের জন্য। নতুন নতুন সফটওয়্যার আসছে, প্রযুক্তি তৈরি হচ্ছে।

অ্যানিমেটর হিসেবে ক্যারিয়ার গড়তে চাইলে এই তো সুসময়! তৌফিকের কাছ থেকেই জেনে নাও কিছু পরামর্শ—

  • অ্যানিমেটর হতে চাইলে আঁকাআঁকিটা জানতেই হবে। এখন থেকেই চর্চা চালিয়ে যাও।

  • প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি যদি হাতে না থাকে, একটা সহজ পদ্ধতিতে অ্যানিমেশনের কাজ শুরু করতে পারো। ছোট কাগজে ‘ফ্রেম বাই ফ্রেম’ যে গল্পটা ভাবছ, সেটা এঁকে ফেল। মুঠোফোনে ছবি তুলে যেকোনো ভিডিও এডিটিং সফটওয়্যারের মাধ্যমে ফ্রেমগুলো পাশাপাশি দাঁড় করালেই একটা কিছু পেয়ে যাবে। সেটা খুব ভালো মানের হবে না। তবু শুরু করার জন্য এটা একটা ভালো পদ্ধতি।

  • ইংরেজি পড়ার অভ্যাসটা তৈরি করো। যখন তোমার হাতে অ্যানিমেশন করার মতো প্রয়োজনীয় সফটওয়্যার আসবে, কীভাবে কাজগুলো করতে হয় সেটা জানতে তোমাকে প্রচুর পড়তে হবে। পড়ে পড়েই শিখতে হবে। সম্ভব হলে একটা ওয়াকম কিনে ফেলো। না থাকলেও অসুবিধা নেই। কাজটা শিখতে থাকো, পরে না হয় কিনে নেওয়া যাবে।

  • ইউটিউবে টিউটোরিয়াল দেখে একটু একটু করে ঘরে বসেই শিখতে পারো।

  • গুগল সার্চ করলে অ্যানিমেটরদের কিছু কিছু ব্লগ পাওয়া যায়। সেখানে নিজের কাজগুলো আপলোড করলে বিশ্বের নামী অ্যানিমেটররা সেখানে ফিডব্যাক দেন। তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে, পরামর্শ নিয়ে এগিয়ে যেতে পারো।

প্রকৌশলী

প্রকৌশলীদের কাজকারবারই হলো সমস্যা আর সমাধান নিয়ে। কেমন করে মানুষের জটিল কাজকর্মগুলো যন্ত্রের ‘ঘাড়ে’ চাপিয়ে দেওয়া যায়, সেই ফন্দিগুলো বের করেন তাঁরা। আনন্দের বিষয় হলো বাংলাদেশে সরকারি-বেসরকারি বেশ কিছু প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় আছে। তবে ভালো নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেই যে ভালো প্রকৌশলী হওয়া যায়, ব্যাপারটা মোটেই তা না। আসল কথা হলো যন্ত্রপাতি নিয়ে খুটুর খাটুর করতে কিংবা সমস্যার সমাধান খুঁজতে তুমি ভালোবাসো কি না।

প্রকৌশলী হওয়ার তিনটি সুবিধা ও তিনটি অসুবিধা

সুবিধা

  • প্রযুক্তি বিষয়ে সব সময় আপডেটেড থাকা যায়। বাজারে নতুন কী আসছে বা এল, না চাইলেও সেসব খবর ঠিকই কানে আসে।

  • সব সময় নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ নেওয়ার সুযোগ আছে।

  • যাঁরা মাথা খাটাতে পছন্দ করেন, তাঁদের জন্য এই ক্ষেত্রটা ভালো।

অসুবিধা

  • ইঞ্জিনিয়াররা সাধারণত একটু দলছুট হন। বাসায় ফিরে বা বন্ধুদের আড্ডায়ও দেখা যায় নানান চিন্তা মাথায় ঘুরতে থাকে।

  • আয় ভালো হয় সেটা ঠিক। কিন্তু এই আয় খরচ করার মতো প্রয়োজনীয় অবসর পাওয়া যায় না। শুধু কাজ আর কাজ...

  • অনেক সময় কোনো সমস্যার সমাধান খুঁজে না পেলে খুব বিরক্ত লাগে। মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়।

প্রকৌশলী হওয়ার জন্য কীভাবে প্রস্তুতি নেওয়া যায়? জেনে নাও কিছু পরামর্শ।

  • ধরো, একটা ঝুড়িতে পাঁচটা আপেল আছে। পাঁচজন মানুষের মধ্যে এমনভাবে আপেলগুলো ভাগ করে দাও, যেন সবাইকে দেওয়ার পরও ঝুড়িতে একটা আপেল অবশিষ্ট থাকে। কীভাবে সম্ভব? ছোটবেলা থেকেই এমন মজার প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজো। গণিত অলিম্পিয়াড বা গণিতবিষয়ক যেকোনো প্রতিযোগীতায় নিয়মিত অংশ নাও। প্রকৌশলী হতে হলে গণিতকে ভালোবাসতেই হবে। কান টানলে যেমন মাথা আসে, গণিত ধরে টান দিলে তেমনি প্রকৌশলী হওয়ার রাস্তাটাও সুড়সুড় করে তোমার সামনে চলে আসবে।

  • স্কুলে গণিতের প্রতি বিশেষ জোর দাও। সে জন্য যা করতে হবে—বাসায় যদি গণিত বিষয়ের গাইড বই থাকে, প্রথমেই সবগুলো গাইড বই একসঙ্গে জড়ো করো এবং ময়লার ঝুড়িতে ফেলে দাও! নম্বরের জন্য নয়, শেখার জন্য পড়াটাই কাজে আসবে। যদি বিষয়টা তুমি নাই বোঝো, এ প্লাস পাওয়া না পাওয়ায় সত্যিই কিছু যায় আসে না। বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলে, শিক্ষকের পরামর্শ নিয়ে কিংবা ইন্টারনেটের সাহায্যে নিজে নিজেই পারলে একটা ‘গাইড বই’ লিখে ফেলো!

  • হাতের কাছের যন্ত্রপাতি যেমন ফ্যান, টিভি, কম্পিউটার থেকে শুরু করে হাতঘড়ির কলকবজাগুলো কীভাবে কাজ করে সেটা জানার চেষ্টা করতে পারো। এ ক্ষেত্রে বাসার নষ্ট যন্ত্রপাতিগুলো তোমার ‘গিনিপিগ’ হতে পারে।

  • দেশসেরা বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেই হবে। এই মানসিক চাপ মাথায় নিয়ো না। আনন্দ নিয়ে পড়ো।

  • প্রকৌশল বিষয়ে অনেকগুলো বিভাগ আছে। যেমন তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক কৌশল, কম্পিউটার বিজ্ঞান, কেমিকৌশল, যন্ত্রকৌশল...কোন বিভাগে তোমার আগ্রহ, সেটা খুঁজে বের করো। এ ক্ষেত্রে এসব বিষয়ে পড়ছে, এমন সিনিয়ার ভাইয়া-আপুদের সঙ্গে কথা বলতে পারো।

  • কলেজ থেকেই ‘গ্রুপ স্টাডি’ শুরু করা দরকার। একসঙ্গে পড়ার জন্য এমন একজন সঙ্গী খুঁজে নাও, যার সঙ্গে তোমার বোঝাপড়া ভালো।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক দীপন সাউ যা বললেন, সারমর্ম মোটামুটি এ রকমই। আরও বলছিলেন, ‘ইঞ্জিনিয়ারদের কাজই হচ্ছে সমস্যার সমাধান করা। চাকরির ক্ষেত্রেও তাই। নতুন নতুন সমস্যা আসবে, সেসবের সহজ সমাধান খুঁজতে হবে।’

বিজ্ঞানী

সকালের সূর্য কেন লাল? আকাশ কেন নীল? পাখি কেন উড়তে পারে আর মানুষ কেন পারে না? আজব সব প্রশ্নের উত্তর জানার কৌতূহল যার আছে, তিনিই একজন বিজ্ঞানী হতে পারেন। এই উপায় বাতলে দিলেন বিজ্ঞানী ড. আলী আসগর। হ্যাঁ, তাঁর সম্পাদিত পদার্থবিজ্ঞান বই-ই তোমরা স্কুল-কলেজে পড়ে এসেছ। নিউ সায়েন্টিস্ট ম্যাগাজিনের ‘সেরা ১০০ প্রভাবশালী পদার্থবিদ’-এর তালিকায়ও আছেন বাংলাদেশের এই বিজ্ঞানী। তিনি পরামর্শ দিলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে। এ ছাড়া বিজ্ঞানীদের জীবনী পড়ে দেখতে পারো। ছোটখাটো পরীক্ষা-নিরীক্ষাও করে দেখা যায়। নিজের বাড়ির আঙিনায় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ পরিমাপ করতে পারো। গাছের পাতা কিংবা পোকামাকড় সংগ্রহ করতে পারো। এ ছাড়া পাঠ্যবইয়ের বাইরে বিজ্ঞানবিষয়ক ম্যাগাজিন কিংবা বইগুলো পড়লেও কাজে আসবে।’

ছবি: কবির হোসেন

তোমার গবেষণার বিষয় হতে পারে যেকোনো কিছু। বিজ্ঞানী কিংবা গবেষক হতে হলে তোমাকে ধাপে ধাপে এগোতে হবে। কীভাবে?

  • স্কুল-কলেজে বিজ্ঞান সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোকে বেশি গুরুত্ব দাও। পাটিগণিত, বীজগণিত, জ্যামিতি, ক্যালকুলাস, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, জীববিজ্ঞান...সবগুলো বিষয়ই তোমার কাজে আসবে। সুযোগ পেলেই বিজ্ঞান মেলা বা অলিম্পিয়াডে অংশ নাও।

  • কলেজের শেষের দিকে এসে খুঁজে বের করতে চেষ্টা করো, কোন বিষয়টা তোমার কাছে বেশি মজার মনে হচ্ছে। সেটা নিয়েই পড়ার পরিকল্পনা করতে থাকো।

  • বিশ্ববিদ্যালয়ে পছন্দের বিষয়ে ভর্তি হওয়ার পর খোঁজ নিয়ে দেখো, তোমার বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষক তোমার আগ্রহ আছে এমন কোনো বিষয়ের ওপর গবেষণা করছেন কি না। তাঁর সহকারী হিসেবে কাজ শুরু করতে পারো।

  • বিজ্ঞানীদের নিজস্ব রিসার্চ পেপার বা সায়েন্টিফিক জার্নাল লিখতে হয়। তাই বিজ্ঞান নিয়ে তোমার ভাবনাগুলো যেন গুছিয়ে লিখতে পারো, সেই প্রস্তুতিও রাখা দরকার।

  • নিত্যনতুন আবিষ্কার ও প্রযুক্তির সঙ্গে সব সময়ই ‘আপডেটেড’ থাকতে চেষ্টা করো। বিজ্ঞানবিষয়ক ম্যাগাজিন, জার্নাল কিংবা ইন্টারনেটে প্রকাশিত প্রবন্ধগুলোতে চোখ রাখো।

  • অল্প সময়েই তুমি বিজ্ঞানী বা গবেষক হয়ে যাবে, তা নয়। ধৈর্য ধরো। দীর্ঘদিনের গবেষণা, পরিশ্রম আর জানার চেষ্টাই তোমাকে সফল করবে।

আলোকচিত্রী

‘বড় হয়ে আমি আলোকচিত্রী হতে চাই’ এ কথা বলতে সাহস লাগে বটে! সত্যি বলতে কি, ছবি তোলাটাকে আজকাল অনেকে ‘কাজ’ বলে মনেই করে না! হাতে হাতে মোবাইল-ক্যামেরা, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামের কল্যাণে সবাইই যেন আলোকচিত্রী বনে বসে আছে। যেকোনো মেলা বা উৎসবে ঘুরতে গেলেও দেখবে মোটামুটি ‘একদল’ লোক গলায় ক্যামেরা ঝুলিয়ে হাজির। দেশে হুট করেই আলোকচিত্রীদের এমন ‘বাম্পার ফলন’ এর দুইটা মানে হতে পারে। প্রথমত, কাজটার চাহিদা আছে বলেই অনেকে আলোকচিত্রী হতে চাইছেন। দ্বিতীয়ত, যেহেতু অনেক প্রতিযোগী আছেন, এই কাজে প্রতিষ্ঠা পাওয়াটা সহজ হবে না। ব্যতিক্রম কিছু করতে পারলেই তুমি হবে অন্য রকম, সবার চেয়ে আলাদা।

ছবি: কবির হোসেন

ইউরোপিয়ান প্রেস ফটো এজেন্সির আলোকচিত্রী আবীর আবদুল্লাহ মনে করেন, বাংলাদেশে ফটোগ্রাফির একটা মিশ্র সময় যাচ্ছে। প্রচুর মানুষ ছবি তুলছে ঠিক, কিন্তু নেশা থেকে ছবি তোলার চেয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ছবি আপলোড করতেই যেন লোকজনের আগ্রহ বেশি। ছবি তোলার নতুন নতুন বিষয়, প্রযুক্তি যোগ হচ্ছে। গড়পড়তা আলোকচিত্রী হতে চাইলে কাজটা হয়তো তেমন কঠিন না। কিন্তু বিশ্বমানের একজন আলোকচিত্রী হতে চাইলে আলোকচিত্র বিষয়ে পড়ালেখা করা দরকার। আবীর আবদুল্লাহ বলছিলেন, ‘ওয়েডিং ফটোগ্রাফি করেই অনেকের ভালো আয় হচ্ছে। বন্ধুবান্ধবের মাধ্যমে কিংবা সোশ্যাল নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে তারা কাজও পাচ্ছে। কিন্তু এই ক্ষেত্রটাতে প্রতিযোগিতাও অনেক। ভালো মানের আলোকচিত্রী হতে হলে আনুষঙ্গিক জ্ঞান থাকতে হবে। প্রযুক্তিতে ভালো দখল ছাড়াও সাইকোলজি, অ্যানথ্রোপলজি...এ বিষয়গুলোও জানা দরকার।’

একটু কি কঠিন মনে হচ্ছে? বুঝিয়ে বলছি। অ্যানথ্রোপলজি হলো সমাজের ভিন্ন ধারার একদল লোকের সঙ্গে মিশে গিয়ে তাদের জীবনের ধরনটা বুঝতে চেষ্টা করা। কোনো কোনো আলোকচিত্রী বেদে পরিবারের সঙ্গে মাসের পর মাস থেকে তাদের ছবি তুলেছেন, কেউ ভিক্ষুকদের সঙ্গে রাত-দিন কাটিয়ে ছবি তুলে তাদের জীবনটা ফ্রেমে বন্দী করতে চেয়েছেন। এসব কাজ বোধ হয় এখনই তোমার জন্য কঠিন হয়ে যাবে। সহজ পথ ধরো। তোমার ছবি তোলার যন্ত্রটা যা-ই হোক, ছবি তোলার জন্য আপাতত একটা বিষয় খুঁজে নাও। ধরো তুমি ঠিক করলে, তুমি কাকের ছবি তুলবে। ঘরের বারান্দায়, গাছে কিংবা আশপাশে ঘুরে ঘুরে কাকদের গল্পটা তোমার ফ্র্রেমে আনার চেষ্টা করো। দিনের পর দিন লেগে থাকো। একটা কাক কীভাবে খায়, কীভাবে ওড়ে, দুইটা কাক ঝগড়া করার সময় মুখভঙ্গিটা কেমন হয়, কীভাবে বাচ্চাকে আদর করে...সব ছবি তুলতে থাকো। ধীরে ধীরে তোমার ছবিগুলোতেই একটা গল্প খুঁজে পাবে। এই চেষ্টাই তোমাকে আলোকচিত্রী হিসেবে পরিণত করবে, আগ্রহ জোগাবে।

আলোকচিত্রীদের একটু ভিন্ন চোখে দেখতে হয়। স্রেফ ক্যামেরা তাক করে ক্লিক না করে একটু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করো। সহজ স্বাভাবিক দৃশ্যটাই অন্য চোখে দেখো। আলোকচিত্র বিষয়ে বিভিন্ন বই পড়তে পারো। ইউটিউবের টিউটোরিয়ালগুলোও তোমাকে সাহায্য করবে। এ ছাড়া বড় আলোকচিত্রীদের তোলা ছবি মনোযোগ দিয়ে দেখো। অনেক আলোকচিত্রী দল বেঁধে ফটোওয়াক (একটা নির্দিষ্ট জায়গায় ঘুরে ঘুরে ছবি তোলা)-এ বের হয়। ছবি তোলার ব্যাপারে আগ্রহ আছে, এমন কয়েকজনের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে ফেলো। ধরো একদিন তোমরা ঠিক করলে, পুরান ঢাকায় ঘুরে ঘুরে ছবি তুলবে। ব্যস, বেরিয়ে পড়ো! একজনের কাছে আরেকজনের শেখাটাও হয়ে যাবে। ঢাকায় পাঠশালা ইনস্টিটিউটে ফটোগ্রাফি শেখার সুযোগ আছে। অনেক সময় আশেপাশে ফটোগ্রাফি নিয়ে বিভিন্ন কর্মশালাও হয়। চোখ-কান খোলা রেখে শিখতে থাকো, হয়ে যাবে!

কার্টুনিস্ট

যুক্তরাষ্ট্রের কার্টুনিস্ট ম্যাট গ্রোনিং বলেছিলেন, ‘অধিকাংশ কার্টুনিস্টের জন্ম হয় ক্লাসের পেছনের বেঞ্চে বসে, টিচারের কিম্ভূতকিমাকার ছবি আঁকতে গিয়ে!’ তাঁর কথামতো তুমিও চাইলে শুরু করে দিতে পারো। সে ক্ষেত্রে সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ: টিচারের হাতে ধরা পড়ে কানমলা খেলে সে জন্য কিশোর আলো কিংবা ম্যাট গ্রোনিং কেউই দায়ী থাকবে না!

ডেইলি স্টার পত্রিকার কার্টুনিস্ট সাদাত কোথায় কার্টুন আঁকতেন জানো? অঙ্ক খাতায়! সরল অঙ্কের জটিল প্যাচে পড়ে যেখানে আমাদের চেহারাই কার্টুনের মতো হয়ে যায়, সেখানে অঙ্ক খাতাকেই কি না কার্টুন আঁকার খাতা বানিয়ে ফেলতেন তিনি। সাদাতের সহজ সরল যুক্তি, ‘কার্টুন আঁকার চর্চা করতে গেলে প্রচুর কাগজ নষ্ট হয়। বাংলা-ইংরেজি খাতায় তো জায়গা পাওয়া যেত না, অঙ্ক খাতায় অঙ্কের আশপাশে প্রচুর জায়গা থাকত। সেখানেই কার্টুন আঁকতাম।’ ভেবে দেখো, একটা খটমটে অঙ্কের পাশে সাদাত হয়তো চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে থাকা একটা কার্টুন এঁকে ওপরে লিখে রাখতেন, ‘এই অঙ্কটা এত্ত কঠিন ক্যান!’ তুমিও তাঁর মতো চেষ্টা করে দেখতে পারো।

আরও কিছু পরামর্শ টুকলিফাই করে নাও সাদাত ভাইয়ার কাছ থেকে। বলছিলেন, ‘আশপাশের মজার চরিত্রগুলোকে দেখতে হবে। কারও নাক বোঁচা, কারও চোখে বড় বড় চশমা। দেখে দেখে আঁকার চেষ্টা করতে হবে।’ কার্টুন আঁকিয়ে হতে চাও যারা, তাঁদের জন্য কিছু পরামর্শ পাওয়া গেল বিভিন্ন ওয়েবসাইটে।

  • প্রথম পরামর্শই হলো চর্চা। হোক বা না হোক, চর্চা চালিয়ে যাও।

  • দুই ধরনের কার্টুন তুমি আঁকতে পারো। প্রথমত গল্পনির্ভর, দ্বিতীয়ত বিষয়নির্ভর (থিমেটিক)। তুমি তোমার পছন্দমতো একটা কাল্পনিক চরিত্র তৈরি করে নাও। সে চরিত্র দেখতে কেমন, কীভাবে হাঁটে, কীভাবে তাকায়, নিজের মতো কল্পনা করে এঁকে ফেলো। এবার এই চরিত্রটাকে নিয়ে গল্প ভাবো। আঁকতে থাকো। আরেক ধরনের কার্টুন হলো বিষয়নির্ভর। ফান ম্যাগাজিনগুলোতে যে ধরনের কার্টুন আমরা দেখি। কার্টুনের মাধ্যমে কোনো একটা বিষয় বা সমসাময়িক ঘটনাকে ব্যঙ্গ করা হয়। এ ধরনের আইডিয়াও তুমি ভাবতে থাকো।

  • বন্ধুবান্ধবের ক্যারিকেচার আঁকতে চেষ্টা করো। কার্টুন এঁকে পত্রিকায় পাঠাও। ছাপা হোক বা না হোক, আঁকতেই থাকো, পাঠাতেই থাকো! আশপাশের মানুষকে তোমার আঁকা কার্টুন দেখিয়ে পরামর্শ নাও।

  • কার্টুন আঁকা নিয়ে বিভিন্ন কর্মশালা হয়। সুযোগ পেলেই এসব কর্মশালায় অংশ নাও। কার্টুনবিষয়ক বই পড়ো, ইউটিউবে টিউটোরিয়াল দেখ।

কার্টুনিস্ট হব, সে তো ভালো কথা। কিন্তু পকেটের খোঁজটাও তো নেওয়া দরকার। মানুষের বেতন জিজ্ঞেস করাটা নাকি ভদ্রতার মধ্যে পড়ে না। একটু ইনিয়ে-বিনিয়েই সাদাতের কাছে জানতে চাইলাম, ‘কার্টুন এঁকে উপার্জনটা কেমন হয়?’ বললেন, ‘কার্টুনিস্ট হিসেবে পত্রিকায় কাজ করে আসলে খুব বেশি আয় হয় না। তবে এই কাজের প্রচুর চাহিদা আছে, কারণ ভালো কার্টুনিস্টের সংখ্যা খুব কম। কমিক বই বের করা যায়। ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কার্টুনিস্টদের কাজও অনেক।’ বোঝা গেল, আয়টা মন্দ না!

শিল্পী

শিল্পী হওয়ার পদ্ধতিটা তো একদম সহজ! অন্তত শিল্পী ওয়াকিলুর রহমানের কথা শুনে তাই মনে হলো। আঁকিয়ে যারা হতে চাও, তাদের জন্য তিনটি পরামর্শ দিলেন তিনি—

  • ছবি আঁকো

  • ছবি আঁকো

  • ছবি আঁকো

চাইলে ৪,৫,৬,৭...নম্বর পরামর্শের জায়গায়ও একই কথা লিখে নিতে পারো। শিল্পী হতে চাইলে পদ্ধতি আসলে এই একটাই। যা খুশি, যেভাবে খুশি, যত খুশি, যেখানে খুশি আঁকো। ওয়াকিলুর রহমান বলছিলেন, ‘আমাদের দেশে ছবি আঁকার বিভিন্ন স্কুলিং আছে। এর দুটি দিক। প্রথমত সৃজনশীলতা, দ্বিতীয়ত আঁকার দক্ষতা বাড়ানো।’ রঙের ব্যবহার, ব্যাকরণ এসব তুমি আর্ট টিচারের কাছে শিখতে পারবে। কিন্তু তোমার আঁকার বিষয় কী হবে, সেটা কিন্তু তোমাকেই ভেবে বের করতে হবে। ধরো তোমাকে আর তোমার বন্ধুকে বলা হলো, ‘একটা গরু আঁকো দেখি!’ দুইটা গরুরই চারটা পা, একটা লেজ, দুটা চোখ, দুইটা শিং থাকতে পারে। তবু গরু দুইটা দেখতে কিন্তু একরকম হবে না। এখানেই একজন আঁকিয়ের বিশেষত্ব। একটু অন্য রকমভাবে ভাবো, দেখো, আঁকো। মজা করে তুমি নাহয় গরুর পিঠে দুটো পাখা জুড়ে দিয়ে একটা ‘পঙ্খিরাজ গরু’ এঁকে ফেললে! বন্ধুরা যদি হিহি করে হেসে ফেলে বলে, ‘যাহ্, গরুর কি পাখা থাকে!’ তাতে কী আসে যায়? তুমি বলবে, ‘আমার ইচ্ছা হয়েছে, এঁকেছি।’ সেই ঘটনাটা জানো তো, লেওনার্দো দা ভিঞ্চি হেলিকপ্টার আবিষ্কারের চার শ বছর আগেই হেলিকপ্টারের ছবি এঁকেছিলেন!

বড় হয়ে আঁকাআঁকিকে তুমি পুরোদস্তুর পেশা হিসেবেও নিতে পারো। শিল্পীদের অনেক ক্ষেত্রে কাজ করার সুযোগ আছে। ভাস্কর্য বানাতে পারো, ডিজাইনার হতে পারো...আরও নানান রকম কাজের সুযোগ তৈরি হচ্ছে। বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলা বিভাগ রয়েছে। চারুকলায় পড়তে চাইলে এখন থেকেই প্রস্তুতি নাও। কীভাবে প্রস্তুতি নেবে? পরামর্শ সেই একই। ছবি আঁকো, ছবি আঁকো, ছবি আঁকো...

পরিচালক

সিনেমার জগৎ বিশাল বড়। ভুল বললাম।

সিনেমার জগৎ বিশাআআআআল বড়! প্রতিদিন নতুন নতুন গল্প তৈরি হচ্ছে, প্রতি মুহূর্তে নতুন নতুন ভাবনা মানুষ চলচ্চিত্রে তুলে ধরছে। মহাকাশ থেকে শুরু করে অতল সাগর, কাল্পনিক দুনিয়া, অদ্ভুত-আজব ভাবনা কিংবা একেবারেই সাদামাটা কাহিনি—কী নেই? বিশাল আয়োজন নিয়ে যেমন সিনেমা তৈরি হয়, তেমনি দারুণ একটা চলচ্চিত্র হতে পারে একদম ছোট্ট পরিসরেও। এই প্রসঙ্গে ব্যারিড (২০১০) নামে হলিউডের একটা সিনেমার কথা বলতে পারি। একটা কফিনের ভেতর একটা মাত্র চরিত্রকে নিয়ে ৯৫ মিনিটের আস্ত একটা ছবি! সেই ছবি দেখতে বসলে তুমি দম ফেলার সময় পাবে না, এতই টান টান উত্তেজনা!

টাকা, জনবল, প্রযুক্তির দিক থেকে যতই সীমাবদ্ধতা থাকুক, যদি ভাবনার কথা বলো, স্কাই ইজ ইয়োর লিমিট! অতএব, ভাবতে শুরু করো।

পরিচালক মোস্তফা সরয়ার ফারুকী মনে করেন, সিনেমার কারিগর হতে চাইলে প্রচুর ছবি দেখতে হবে। কিন্তু কারও দ্বারা প্রভাবিত হওয়া চলবে না। নিজের সহজাত প্রবৃত্তি থেকে, নিজের মতো করেই গল্পটা বলতে হবে, দেখতে হবে, দেখাতে হবে! তিনি উদাহরণ দিলেন এভাবে, ‘একই ঘটনা দেখে এসে একেকজন একেকভাবে বর্ণনা করবে। একটা ক্রিকেট ম্যাচ দেখে এসে কেউ হয়তো বলবে সাকিব আল হাসানের গ্যালারির দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ার গল্প। কারও কাছে আবার মাশরাফি আর তাসকিনের বুক মেলানোটা বেশি আকর্ষণীয়। একই খেলার বর্ণনা একেকজনেরটা একেক রকম। কে কীভাবে গল্পটা বলতে চায়, সেটাই বড়।’ পিঁপড়াবিদ্যা ছবির পরিচালক নিজের জীবন থেকে শেখা একটা বিদ্যাও বললেন তোমাদের জন্য। ‘আমার বাবার রাতের বেলা খুব কাশি হতো। জোরে জোরে নিশ্বাস নিতেন। একসময় তাঁর কাশি থেমে গেলেও মনে হতো আমি সেই শব্দ ঠিকই শুনতে পাচ্ছি। আমি ঘুমাতে পারতাম না। মনে হতো তাঁর কষ্টটা আমারও হচ্ছে। এই যে অন্যের জীবনের বেদনাটুকু নিজের করে ভাবা, এক জীবনে অনেকগুলো জীবনের অনুভূতিটা অনুভব করা—এটা একজন পরিচালকের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। যেখানে বাবার কাশি থেমে গেল, সেখানেই হয়তো জাগতিক মানুষের কাছে ঘটনা শেষ। কিন্তু একজন গল্পকার কিংবা পরিচালকের কাছে সেখানেই ঘটনার শুরু। যখন একটা থেমে যাওয়া ঘটনার পরের ঘটনাগুলোও দৃশ্যের পর দৃশ্য তোমার চোখে ভাসতে থাকবে, বুঝবে তুমি একজন পরিচালক হতে পারো।’

শুনতে কি পাও চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করে দেশে, দেশের বাইরে অনেকগুলো পুরস্কার জিতেছেন পরিচালক কামার আহমাদ সাইমন। তোমাদের জন্য তাঁর পরামর্শ কী? বললেন, ‘গলা সাধার আগে, কান সাধা...হাত মকশোর আগে মগজ মকশো, এই হলো দুই মূল মন্ত্র। গান গাওয়ার আগে যেমন শোনার চর্চা করতে হয়, গানের কান তৈরি করতে হয়...ছবির জন্য তেমনি লাগে দেখার চোখ। দেশ-বিদেশের হরেক ছবি দেখতে হয়, ভালো লাগলে একই ছবি বারবার দেখতে হয়...তাতে নির্মাতার অধরা কৌশল সহজে ধরা দেয়। আর মগজকে যথাসম্ভব লোড করা গুগল থেকে...শুধু ক্যামেরা, লেন্স আর এডিটিং নিয়ে থাকলে হবে না। সিনেমার ইতিহাস থেকে শুরু করে নবীনতম ভাবনা বা চ্যালেঞ্জ পর্যন্ত নিজেকে আপডেটে রাখতে হবে। এরপর যদি নিশ্চিত হই, আমি নির্মাতাই হতে চাই, তাহলে পড়াশোনা করতে যেতে হবে বিশ্বের নানান দেশে ছড়িয়ে থাকা ফিল্ম ইনস্টিটিউটে।’

পরিচালক হতে চাইলে আর কী কী করা যেতে পারে, একটু ভেবে দেখা যাক—

  • প্রচুর ছবি দেখো। দেশি-বিদেশি নানা ধরনের চলচ্চিত্র দেখতে থাকো। আর পড়ো বই। চলচ্চিত্র নিয়ে চমত্কার কিছু বই আছে। তোমার প্রিয় লেখকদের দু-একটা বইও পাবে। হুমায়ূন আহমেদ যেমন ছবি বানানোর গল্প নামে বই লিখেছেন। সত্যজিতের লেখা সিনেমার কথা তোমার দারুণ কাজে আসবে। বিশেষ করে চিত্রনাট্য কীভাবে লিখতে হয়, উদাহরণসহ বলা আছে এই বইতে। পড়তে পারো তারেক মাসুদের লেখা চলচ্চিত্রযাত্রা। মোদ্দা কথা হাতের কাছে সিনেমা নিয়ে যা পাও, তাই পড়ো।

  • হাতের কাছে যা আছে, তাই নিয়ে কাজ শুরু করো। মোবাইলের ক্যামেরা দিয়েই শুরু হতে পারে। গল্পের চরিত্র হতে পারে তোমার ভাই, বোন, বন্ধু কিংবা তোমার পোষা বিড়াল। সে ব্যবস্থাও হচ্ছে না? চিন্তা নেই। তোমার হাতের দুটো আঙুল নিয়েও গল্প হতে পারে। ধরো বুড়ো আঙুল কনিষ্ঠা আঙুলকে বলছে, ‘হু হো হা হা, তুই তো ব্যাটা পাটকাঠি, আমার স্বাস্থ্য দ্যাখ! আমাকে ছাড়া কিছু শক্ত করে ধরাই যায় না।’ জবাবে কনিষ্ঠা আঙুল বলল, ‘অ্যাহ! আমাকে ছাড়া লোকজন কান চুলকাবে কীভাবে শুনি?’

  • চলচ্চিত্র নিয়ে আগ্রহ আছে, এমন বন্ধুরা মিলে একটা দল করে ফেলো। নিজেদের মধ্যে ছবি আদান-প্রদান করো। দল বেঁধে ছবি নিয়ে কথা বলো, ছবি তৈরি করো। ছোট-বড় নির্মাতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারো ফেসবুকেও।

  • তোমার শক্তির জায়গাটা কোথায়, সেটা খুঁজে বের করো। একজন পরিচালকের ভালো ক্যামেরা সেন্স, এডিটিং, গল্প, অভিনয় সবটাই জানতে হয়। যেখানে তোমার দুর্বলতা আছে, সেটা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করো। ইন্টারনেটের টিউটোরিয়ালগুলো তোমাকে সাহায্য করবে।

যা ইচ্ছে তাই

কত বিচিত্র, অদ্ভুত, আজব, রোমাঞ্চকর, হাস্যকর, মজাদার সব কাজ যে সারা বিশ্বে প্রচলিত আছে, জানলে অবাক হয়ে যাবে। প্রতিদিন তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন কাজের ক্ষেত্র। তাই ‘বড় হয়ে কী হবে?’ প্রশ্ন শুনতে শুনতে ঘাবড়ে যাওয়ার কিছু নেই। তোমার যা হতে ভালো লাগে, তুমি তা-ই করো।

বাইরের দেশে গামোলজিস্ট অর্থাৎ চুইংগামবিশেষজ্ঞ হিসেবেও কাজ করার সুযোগ আছে। একধরনের বিশেষ ডুবুরি আছেন, তাঁদের কাজ হলো পানিতে পড়ে যাওয়া গলফ বল খুঁজে বের করা। বাংলাদেশেও আছে আজব সব চাকরি-ব্যবসা। একটা কোম্পানি আছে যারা অফিস-বাসার তেলাপোকা নিধনের কাজ করে! একটা নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকার বিনিময়ে তারা বড় বড় ফ্যাক্টরির সমস্ত তেলাপোকা হাপিস করে দেন! ভেবে দেখো, এর চেয়েও বিচিত্র অথচ লাভজনক কোনো ব্যবসার আইডিয়া হয়তো তোমার মাথায় আসতে পারে। খুব বেশি দূরে নয়, ফেসবুকের কথাই ভাবো। কী এক নীল দুনিয়া পৃথিবীর অসংখ্য মানুষকে যুক্ত করে রেখেছে। সামান্য একটা আইডিয়া মার্ক জাকারবার্গকে পাইয়ে দিয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে কম বয়সী ধনী মানুষের খেতাব। অথচ লোকটার কখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরোনো হয়নি। গ্র্যাজুয়েটের টুপি পরার সৌভাগ্য হয়নি বিল গেটসেরও। অন্য রকমভাবে ভাবার চেষ্টা নিয়েই তাঁরা অন্য স্তরে পৌঁছে গেছেন।

খেলোয়াড় হও, পর্বতারোহী হও, রাজনীতিবিদ হয়ে দেশ বদলে দাও, শিক্ষক হয়ে ছাত্রছাত্রীদের মন জয় করে নাও, যোগ দিতে পারো সেনাবাহিনীতে। অভিনয়শিল্পী, সংগীতশিল্পী, লেখক, সাংবাদিক, উদ্যোক্তা এমন অনেক কিছু হওয়ার সুযোগ আছে তোমার সামনে। বাংলাদেশের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র হচ্ছে কৃষি। কৃষি বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে তুমি হয়তো সারা দুনিয়াকে তাক লাগিয়ে দিতে পারো।

যে বিষয়ে পড়ালেখা করছ, তা-ই করতে হবে সেটাও না। কার্টুনিস্ট আহসান হাবীব পড়ালেখা করেছিলেন ভূগোল বিষয়ে। ক্রিকেটার মুশফিকুর রহিমের বিষয় ছিল ইতিহাস। মিস্টার বিন খ্যাত রোয়ান অ্যাটকিনসন ছিলেন প্রকৌশলী। অতএব, বিশ্বকে ‘দেখিয়ে দেওয়ার’ সুযোগ খুব শিগগিরই ফুরিয়ে যাবে তা নয়। তুমি কী করতে ভালোবাসো, কোন কাজটা সবচেয়ে ভালো পারো, এখন শুধু এইটুকুন আবিষ্কারের অপেক্ষা...।

মডেল: স্বাগত, তৌহিদ, স্নেহা, রাইয়ান, সুসমী, রিপা, নুপুর, আলভী, নিশি ও সাকলাইন | অলংকরণ: তুলি, আসিফুর রহমান ও ষুভ