ভাইরাস : মানুষের অদৃশ্যমান শত্রু

উনিশ শতকে ফ্রান্সের জাতীয় আয়ের একটা বড় উৎস ছিল ওয়াইন (Wine)। ইউরোপজুড়ে ফ্রেঞ্চ ওয়াইনের চাহিদা ছিল প্রচুর। উনিশ শতকের মাঝামাঝি, ফ্রেঞ্চ ওয়াইনের মান খারাপের দিকে যেতে লাগল। ইংরেজরা, ফ্রেঞ্চ ওয়াইন নিয়ে অভিযোগ করতে লাগল। ফ্রান্সের জাতীয় আয়ে একটা হুমকি দেখা দিল। ফ্রান্সের রাজা নেপোলিয়ান দ্য থার্ড এই সমস্যা সমাধানের নির্দেশ দিলেন। জাতীয় সম্মানের প্রশ্ন হয়ে দেখা দেওয়া এই সমস্যার সমাধানের দায়িত্ব বর্তাল এক তরুণ রসায়নবিদের ওপর। ২৬ বছর বয়সী সেই রসায়নবিদের নাম লুই পাস্তুর। 

ওয়াইন কেন স্বাদে ও গন্ধে পরিবর্তিত হয়ে যায়, সেটা নিয়ে পাস্তুর দিন-রাত ভাবতে লাগলেন। বহু তত্ত্ব ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে লাগলেন পাস্তুর। তিনি ভাবলেন, বাহ্যিক কোনো কিছু হয়তো ওয়াইন নষ্ট করে দিচ্ছে। কিন্তু কী সেটা? ব্রিলিয়ান্ট পাস্তুর অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে, ভালো এবং খারাপ মানের ওয়াইন পরীক্ষা করলেন। দেখলেন, খারাপ মানের ওয়াইনে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অণুজীব (Microbes) বসবাস করছে। তিনি ভাবলেন, এই মাইক্রোবগুলোকে যদি ধ্বংস করা যায়, তাহলে ওয়াইনের গন্ধ ও স্বাদ নষ্ট হবে না। তাঁর নিরন্তর পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলে সমাধান বের হলো। একটা নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় (৫৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস) যদি ওয়াইনকে গরম করা হয়, তাহলে সেই মাইক্রোবগুলো ধ্বংস হয়ে যায় এবং ওয়াইনের স্বাদ ও গন্ধ অক্ষুণ্ন থাকে। পাস্তুরের এই পদ্ধতির মাধ্যমে দুধ ও অন্যান্য তরল বস্তুকে নষ্টের হাত থেকে বাঁচানো গেল। এই পদ্ধতির নাম হয়ে গেল পাস্তুরাইজেশন (Pasteurization) বা পাস্তুরিত। প্রায় দেড় শ বছর ধরে, সারা দুনিয়ায় এই পাস্তুরাইজেশন ব্যবহৃত হয়। পাস্তুরের এই আবিষ্কার বিজ্ঞানের একটা নতুন শাখার জন্ম দিয়েছিল—সেটার নাম মাইক্রোবায়োলজি, বাংলায় যাকে বলে অণুজীববিজ্ঞান! পাস্তুর সম্মানিত হলেন। জাতীয় বীরে পরিণত হলেন।

সভ্যতার শুরু থেকেই মানুষ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হতো। কিন্তু রোগের কারণ বা উৎস মানুষের জানা ছিল না। রোগের কারণ হিসেবে প্রাচীনকাল থেকেই অনেক তত্ত্ব প্রচলিত ছিল, তার মধ্যে মায়াজমা থিওরি (Miasma Theory) খুব জনপ্রিয় ছিল। মানুষ বিশ্বাস করত, খারাপ বা দূষিত বাতাসের কারণেই রোগের সৃষ্টি হয় এবং ছড়িয়ে পড়ে। ব্যাকটেরিয়া কিংবা ভাইরাস যে রোগের সৃষ্টি করতে পারে, সেই ধারণা তখনো বদ্ধমূল হয়নি। পাস্তুর যখন খারাপ মানের ওয়াইনে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অণুজীব দেখতে পেলেন, তখন তার মনে এক অসাধারণ প্রশ্নের উদ্ভব হয়েছিল। পাস্তুর ভাবলেন, এই অণুজীবগুলো যদি ওয়াইন নষ্ট করতে পারে, তাহলে প্রাণীদেহেরও কি ক্ষতি করতে পারে? পাস্তুর শুধু ভেবেই ক্ষান্ত হলেন না। পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে সেটা প্রমাণের জন্য উঠেপড়ে লাগলেন। ঠিক সে সময় জার্মানির একজন তরুণ বিজ্ঞানী রবার্ট কখ এই বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করতে লাগলেন। তাঁদের কাজের মাধ্যমে প্রমাণিত হলো, অদৃশ্যমান এই অণুজীবগুলোই মানুষের রোগের কারণ। পাস্তুর এবং রবার্ট ককের কাজের মাধ্যমে মায়জমা থিওরির ভিত দুর্বল হয়ে গেল। মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠল, জার্ম থিওরি বা জীবাণুতত্ত্ব! মানুষ জানল, জীবাণু ধ্বংস করতে পারলে, জীবাণুকে সংক্রমিত হতে না দিলে রোগপ্রতিরোধ করা সম্ভব। জীবাণুরা কী করে ছড়ায়, সে বিষয়েও মানুষের জ্ঞান বাড়তে লাগল। রোগ সৃষ্টিকারী বিভিন্ন জীবাণুকে (ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া ইত্যাদি) বিজ্ঞানের ভাষায় প্যাথোজেনও (Pathogen) বলা হয়ে থাকে।

লুই পাস্তুর ও রবার্ট কক যখন তাঁদের কাজের মাধ্যমে বিজ্ঞানে নতুন ধারণা ও শাখার প্রতিষ্ঠা করলেন, তখন রাশিয়ার এক ২৮ বছরের তরুণ দিমিত্রি ইভানভস্কি ১৮৯২ সালে প্রকাশিত তাঁর এক বৈজ্ঞানিক আর্টিকেলে ভাইরাসের অস্তিত্বের কথা উল্লেখ করেন। তার ছয় বছর পর একজন ডাচ বিজ্ঞানী প্রথম একটি ভাইরাস আবিষ্কার করেন, যেটি টোবাকো মোজাইক ভাইরাস (TMV) নামে পরিচিত। কিন্তু সে সময়ও বিজ্ঞানীরা জানতেন না যে ভাইরাস মানুষের ক্ষতি করতে পারে। কিংবা বহু প্রকারে ভাইরাসের অস্তিত্ব সম্ভব। কারণ ভাইরাসের গঠন সম্পর্কে তখনো বিজ্ঞানীদের পুরোপুরি ধারণা ছিল না। জীববিজ্ঞানের ধারাবাহিক উৎকর্ষের সঙ্গে সঙ্গে আমরা বুঝতে পারলাম, বহু ধরনের ভাইরাসের অস্তিত্ব সম্ভব। ভাইরাস, উদ্ভিদ ও প্রাণী দুইয়ের জন্যই ক্ষতিকর হতে পারে।

ভাইরাস আকারে এতই ক্ষুদ্র এবং গঠনে এতই সরল (অন্যান্য জীববস্তুর তুলনায়) যে ভাইরাসকে প্রাণী বা উদ্ভিদ বলতে রাজি নন দুনিয়ার বহু বিজ্ঞানী। ভাইরাস ব্যাকটেরিয়া থেকেও ক্ষুদ্র। ফলে ভাইরাসকে বহু বিজ্ঞানী অণুজীব (Microbe) হিসেবেও মেনে নিতে চান না। প্রাণীদেহের কোষগুলো বিভাজিত হয়ে নতুন কোষ তৈরি হয়। কিন্তু কোষ বিভাজনের বিষয়টা ভাইরাস একা করতে পারে না। একটা ভাইরাস থেকে আরেকটা ভাইরাস তৈরির জন্য একটা আশ্রিত কোষ (Host Cell) লাগে। ভাইরাস যখন মানবদেহের কোষে ঢুকে পড়ে, তখন কোষের ভেতর যে ক্রিয়া কৌশল (Mechanism) আছে, সেটাকে ব্যবহার করে।

মানবদেহ অসংখ্য কোষ দিয়ে গঠিত। সেসব কোষই হলো মানবদেহের ক্ষুদ্রতম ইউনিট। এই কোষের ভেতর নিউক্লিয়াস নামে একটা অংশ আছে। মানুষের কোষের নিউক্লিয়াসের ভেতর থাকে ২৩ জোড়া ক্রোমোজম। সহজ ধারণার জন্য বলে রাখি, এই ক্রোমোজমগুলো মূলত ডিএনএ (DNA) নামের বস্তুর কুণ্ডলিত রূপ। জিন (Gene) নামে যে শব্দটির কথা আমরা প্রায়ই শুনে থাকি, সেটা হলো ডিএনএরই নির্দিষ্ট অংশ। কোষ বিভাজিত হয়ে অন্য একটা নতুন কোষ তৈরির আগে, এক সেট ডিএনএ থেকে হুবহু আরেক সেট ডিএনএ তৈরি হয়। বিজ্ঞানে এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় রেপ্লিকেশন বা প্রতিলিপি করণ প্রক্রিয়া। ডিএনএ থেকে ট্রান্সক্রিপশনের মাধ্যমে তৈরি হয় আরএনএ (RNA)। ডিএনএ এবং আরএনএর গঠনে কিছু সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য আছে। তাদের কাজও আলাদা। আরএনএ খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ করে, সেটা হলো প্রোটিন তৈরির নির্দেশনা দেয়। এক একটা আরএনএ, একেক ধরনের প্রোটিন বা পলিপেপটাইড তৈরির কোড বহন করে। আরএনএ কাজটা করে রাইবোজোমের সাহায্যে। তাই রাইবোজোমকে অনেক সময় বলা হয় প্রোটিন তৈরির মেশিন। কোষের ভেতর রাইবোজোম নামের বস্তুটি থাকে নিউক্লিয়াসের বাইরে। তাই আরএনএ নিউক্লিয়াসের ভেতর তৈরি হলেও নিউক্লিয়াস থেকে বেরিয়ে এসে রাইবোজোমের সংস্পর্শে আসে। কিন্তু ডিএনএ কখনো নিউক্লিয়াস থেকে বেরিয়ে পড়ে না। মোদ্দা কথা, কোষের নিউক্লিয়াসে থাকে ডিএনএ, ডিএনএ থেকে ট্রান্সক্রিপশনের মাধ্যমে তৈরি হয় আরএনএ, আর আরএনএ থেকে নিউক্লিয়াসের বাইরে রাইবোজোমের সাহায্যে ট্রান্সলেশনের মাধ্যমে তৈরি হয় বহু ধরনের প্রোটিন। সেসব প্রোটিন জীবদেহের বহু গুরুত্বপূর্ণ কাজে ভূমিকা রাখে।

ভাইরাসের দেহে শুধু ডিএনএ কিংবা আরএনএ থাকে। সেই ডিএনএ কিংবা আরএনএগুলো রেপ্লিকেইট করতে পারে না। ভাইরাসের দেহে রাইবোজোম নেই। তাই প্রোটিন তৈরির কাজও হয় না। একটা ভাইরাস থেকে অন্য একটা ভাইরাস তৈরি হতে গেলে আশ্রিত কোষের যে মেকানিজম, সেটার সাহায্য নিতে হয়। ভাইরাসের ছবিতে আমরা কতগুলো স্পাইক দেখি। এগুলো হলো প্রোটিন দিয়ে তৈরি। এই স্পাইকগুলো অনেকটা চাবির মতো কাজ করে। ভাইরাস চাইলেই আমাদের সব কোষের ভেতর প্রবেশ করতে পারে না। কারণ কোষের বাইরে রিসেপ্টর থাকে। রিসেপ্টরের সঙ্গে যদি ভাইরাসের এই প্রোটিন স্পাইকগুলো ঠিকমতো বাইন্ড করতে পারে, তাহলেই কোষের ভেতর অনুপ্রবেশ করতে পারে। বিষয়টা অনেকটা চাবি ও তালার মতো। এখানে প্রোটিন স্পাইকগুলো চাবির সঙ্গে তুল‍না করা যেতে পারে আর কোষের রিসেপ্টরকে তুলনা করা যেতে পারে তালার সঙ্গে। একই চাবি দিয়ে যেমন সব তালা খোলা যায় না, তেমনি একই ভাইরাস দেহের সব ধরনের কোষে আক্রমণ করতে পারে না। কারণ ভিন্ন ভিন্ন কোষের রিসেপ্টরগুলো ভিন্ন হয়। কোষের ভেতর ভাইরাস ঢুকে গেলে ভাইরাসের ডিএনএ বা আরএনএ পুনঃ পুনঃ তৈরি হতে থাকে। কারণ আমাদের কোষের ভেতর ডিএনএ রেপ্লিকেশনের যে মেকানিজম আছে, সেখানে ভাইরাসের ডিএনএ বা আরএনএ সম্পৃক্ত হয়ে পড়ে। তা ছাড়া ভাইরাসের আরএনএ আমাদের কোষের রাইবোজোমের সঙ্গে মিলে ভাইরাসের দেহের প্রয়োজনীয় প্রোটিন তৈরি করতে থাকে। শুরুটা এভাবেই হয়। একটা ভাইরাস থেকে এক শটি, হাজারটি, লক্ষ কিংবা কোটি ভাইরাস এভাবেই ক্রমান্বয়ে তৈরি হয় ও অসংখ্য কোষে প্রবেশ করে। আমাদের কোষের স্বাভাবিক ক্রিয়াকে ব্যাহত করে। আমরা অসুস্থ হয়ে পড়ি।

ভাইরাস থেকে বাঁচার জন্য ভ্যাকসিন হলো খুবই কার্যকর প্রতিষেধক। ভাইরাস সম্পর্কে জানার বহু আগেই, ভ্যাকসিন আবিষ্কৃত হয়েছে। আর সেই আবিষ্কারও এসেছে এক মহামারির কালেই। ভাইরাসজনিত গুটিবসন্ত (Small pox) নামের রোগটি ছিল এক মহামারি, যা বছর বছর সারা দুনিয়ায় আঘাত হানত। শুধু কুড়ি শতকেই, গুটিবসন্ত কেড়ে নিয়েছে প্রায় ৩০ কোটি প্রাণ। আঠারো শতকের ইউরোপে গুটিবসন্তের হানায় মানুষের জীবনযাত্রা দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল। সে সময় গরুরও বসন্ত রোগ হতো, যেটা কাউ পক্স (Cow pox) নামে পরিচিত ছিল। কাউ পক্স মানুষেরও হতো, তবে গুটিবসন্তের মতো ভয়াবহ ছিল না। কাউ পক্স হলে মানুষ মারা যেত না।

সে সময়ের ব্রিটিশ চিকিৎসাবিজ্ঞানী এডওয়ার্ড জেনার লক্ষ করলেন, গোয়ালাদের (গরু থেকে যারা দুধ সংগ্রহ করে) মধ্যে গুটিবসন্তের প্রভাবটা কম। তাঁর এই পর্যবেক্ষণের আগে আরও কয়েকজন চিকিৎসকও অনুরূপ পর্যবেক্ষণের কথা প্রকাশ করেছেন। কিন্তু জেনার এ বিষয়টিকে পরীক্ষিতভাবে প্রমাণ করার জন্য সিদ্ধান্ত নেন। দুই শ বছর আগে বিজ্ঞান এতটা অগ্রসর ছিল না। উন্নত ল্যাবরেটরি ছিল না। প্রাণীদের ওপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানোর ধারণা ছিল না। জেনার যদি তাঁর পর্যবেক্ষণ পরীক্ষার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত করতে চান, তাহলে সেটা সরাসরি মানুষের ওপর প্রয়োগ করেই করতে হবে।

এডওয়ার্ড জেনার
এডওয়ার্ড জেনার

জেনার পরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণ করেন যে কাউকে যদি আগে থেকেই কাউ পক্সের ভাইরাস দিয়ে আক্রান্ত করে ফেলা যায়, পরবর্তী সময়ে সেই শরীরে ইচ্ছাকৃতভাবেও যদি গুটিবসন্ত দ্বারা আক্রান্ত করা হয়, তাহলে গুটিবসন্ত সেই আক্রান্ত ব্যক্তিকে কাবু করতে পারে না। কারণ, কাউ পক্স দ্বারা আক্রান্ত হলে শরীর সেটাকে প্রতিরোধের জন্য যে অ্যান্টিবডি তৈরি করে, সেই অ্যান্টিবডি গুটিবসন্তের ভাইরাস প্রতিরোধে কাজ করে। এখানে কাউ পক্সের ভাইরাস মূলত একটা দুর্বল ভাইরাস হিসেবে কাজ করে। আর আমাদের শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা (Immune System) একটা দুর্বল ভাইরাসকে প্রতিরোধের জন্য যে অ্যান্টিবডি তৈরি করে, সেটা একটা সবল ক্ষতিকর ভাইরাসকে প্রতিরোধের জন্য আগে থেকে প্রস্তুত থাকে। ১৭৯৬ সালে জেনার প্রায় ২৪ জনের ওপর চালানো এমন পরীক্ষার ফলাফল বৈজ্ঞানিক জার্নালে প্রকাশ করেন। যে ২৪ জনের ওপর পরীক্ষা চালানো হয়েছিল, তাদের মধ্যে তাঁর নিজের শিশুসন্তানও ছিল! জেনারের পরীক্ষা ও সফলতার কথা সারা ইউরোপে হইচই ফেলে দেয়। রাতারাতি এক মহানায়কে পরিণত হন তিনি।

ভ্যাকসিন শব্দটা জেনারই দিয়েছিলেন। লাতিন শব্দ ভেক্কা (Vacca) বা গরু থেকেই ভ্যাকসিন শব্দটির উৎপত্তি। জেনার শুধু গুটিবসন্তের ভ্যাকসিনই আবিষ্কার করেননি, তিনি একটা মূলনীতি বা প্রিন্সিপাল প্রতিষ্ঠা করে দিয়ে গেছেন। আমাদের শরীরকে কী করে আগে থেকেই আশু একটা রোগের জন্য প্রস্তুত করে রাখা যায়, সেটাই হলো ভ্যাকসিনের মূলনীতি। জেনার সম্ভবত মানব ইতিহাসের একজন অন্যতম বিজ্ঞানী, যাঁর আবিষ্কার পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি মানুষের জীবনকে রক্ষা করেছে। এবং তাঁর প্রতিষ্ঠিত মূলনীতির ওপর ভিত্তি করে দুই শ বছর ধরে বিজ্ঞানীরা তৈরি করছেন নতুন নতুন রোগের ভ্যাকসিন।

সম্প্রতি চীন ও অন্যান্য দেশে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ায় সারা পৃথিবীতে হইচই লেগে গেছে। কিন্তু ভাইরাসের এই মহামারি পৃথিবীতে নতুন নয়। করোনাভাইরাসের যেহেতু কোনো ভ্যাকসিন বা অ্যান্টিভাইরাল ড্রাগ আবিষ্কৃত হয়নি, তাই সচেতনতা ও সতর্কতার মাধ্যমেই এই ভাইরাসের হাত থেকে নিজেদের বাঁচানোর চেষ্টা করতে হবে। ভাইরাস যেন সংক্রমিত হতে না পারে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে বারবার। চোখে, মুখে কিংবা নাকে হাত দেওয়ার আগে ভাবুন, হাতটা পরিষ্কার কি না। পরিষ্কার না থাকলে হাত দেবেন না। হাঁচি, কাশি দেওয়ার সময় হাতের কনুইর অংশ দিয়ে মুখ ঢাকুন। হাতের তালুকে জীবাণুমুক্ত রাখুন। নাকের শ্লেষ্মা যত্রতত্র ফেলবেন না। থুতু যত্রতত্র ফেলবেন না। ফোন, কম্পিউটার ইত্যাদি জীবাণুমুক্ত রাখুন। ফোনের স্ক্রিনে অসংখ্য জীবাণু থাকে! জনসমাগম এড়িয়ে চলুন। অসুস্থ বোধ করলে বিলম্ব না করে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। নিজেকে যথাসম্ভব আইসোলেশনে রাখুন।

 করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন আবিষ্কৃত হবে। নয়তো অ্যান্টিভাইরাল ড্রাগ আবিষ্কৃত হবে। হয়তো তিন মাস, নয়তো ছয় মাস কিংবা বছর। কিন্তু হবেই। মানুষের প্রচেষ্টাতেই পৃথিবী থেকে বহু মহামারি দূর হয়েছে। স্প্যানিশ ফ্লু, এশিয়ান ফ্লু, সার্স ভাইরাস, ইবোলা, মার্স, ম্যালেরিয়া, এইডস, ডায়াবেটিস, যক্ষ্মা, চিকেন পক্স—এমন সব রোগের ওষুধ বিজ্ঞানীদের প্রচেষ্টাতেই আবিষ্কৃত হয়েছে। বিজ্ঞান মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে সমাধান নিয়ে। দুনিয়ার একদল মেধাবী সব সময় সমাধানের নেশায় দিন-রাত যাপন করছেন। তাঁরা হলেন নিভৃতের যোদ্ধা, অন্তরালের যোদ্ধা। কিশোর-তরুণদের তাই বিজ্ঞানী হওয়ার, গবেষক হওয়ার চেষ্টা করে যেতে হবে। একজন গবেষক শুধু তাঁর নিজের, সমাজের জন্য ভূমিকা রাখেন না, বিশ্বমানবতার জন্য ভূমিকা রাখেন। পাস্তুর, রবার্ট কক, এডওয়ার্ড জেনার—এমন মহানায়কদের মতো হওয়ার স্বপ্ন নিয়েই বনিয়াদ গড়তে হবে। তাহলে এই অদৃশ্যমান শত্রুর হাত থেকে মানবজাতিকে উদ্ধারের মহান কাজে অংশ নেওয়া যাবে। 

লেখক : গবেষক