ভারত মহাসাগরে স্নর্কেলিং

তখন বিকেল পাঁচটা। আকাশে ঝলমলে রোদ। আর পাঁচ মিনিটের মধ্যে আমরা মালদ্বীপে নামছি বলে ঘোষণা দিলেন বিমানের পাইলট। বিমানের জানালা দিয়ে নিচে তাকিয়ে দেখি গাঢ় নীল সমুদ্র। প্লেন যখন নামছে মনে হচ্ছে সমুদ্রেই অবতরণ করছে। মালদ্বীপের মালি বিমানবন্দরে নেমে দেখি রানওয়ের পাশেই নীল সমুদ্র। ভাবতে লাগলাম, এই গভীর পানিতে কি নামা সম্ভব?

বাবা-মা, ফুপা-ফুপু আর আমি—আমাদের পাঁচজনের দল উঠলাম একটা ছোট্ট হোটেলে। রাত কেটে গেল কিছু না দেখেই। পরদিন সকাল নয়টা। ঘুম থেকে উঠে দেখি বাবা-মা রুমে নেই। নাশতার জন্য নিচে নেমে দেখি ফুপা-ফুপুরা বাবাকে বলছেন, তোমাকে এখনই বের হতে হবে। তা না হলে আজ আর বুকিং দেওয়া যাবে না। আমার মনে পড়ল, গত রাতে ঠিক করা হয়েছে আজ আমরা স্নর্কেলিং করতে বের হব। বাবা বের হলেন। আমরাও কিছুক্ষণ পর বাইরে বের হলাম।

সেদিন ছিল রোববার। মালদ্বীপে সাপ্তাহিক ছুটি। তাই রাস্তা পুরোটাই খালি। শুধু কয়েকজন বিদেশি রাস্তায় হেঁটে যাচ্ছে। আশপাশের সব শব্দ ছাপিয়ে কানে এল উত্তাল নীল সাগরের গর্জন। যেন আমাদের কাছে ডাকছে। বাবা ‘হলি ডে ওয়াটার স্পোর্টস’ নামে একটা অফিসে ঢুকলেন। কথা বললেন সেখানকার লোকজনের সঙ্গে। বের হয়ে এসে বললেন, আমাদের হাতে সময় আছে। ট্রলারঘাটে পৌঁছাতে হবে বেলা তিনটার মধ্যে।

আমরা বেলা দুইটা পঁয়তাল্লিশ বাজতেই ঘাটে এসে অপেক্ষা করতে লাগলাম ট্রলারের জন্য। ঠিক পাঁচ মিনিট পর এসে গেল আমাদের ট্রলার। আমাদের সঙ্গে দুজন জাপানিও যোগ দিলেন। প্রায় ১০ মিনিট পর ট্রলার ছাড়ল। আমাদের সঙ্গে ছিলেন চারজন প্রশিক্ষক। এর মধ্যে একজন আবার বাংলাদেশের নীলফামারী জেলার। মালদ্বীপে আমরা যেখানেই গিয়েছি, সেখানেই কিন্তু দেখা পেয়েছি কোনো না কোনো বাংলাদেশির। বাবা দেখি সেই বাংলাদেশির সঙ্গে বাংলাতেই গল্প শুরু করে দিলেন। আমাদের মূল গাইড হলেন একজন শ্রীলঙ্কান ভদ্রলোক। নাম অজয়। যাওয়ার পথেই তিনি স্নর্কেলিংয়ের জন্য প্রয়োজনীয় সব গিয়ার বের করা শুরু করলেন। একে একে স্নর্কেলিং মাস্ক, লাইফ জ্যাকেট, ফিন আর বয়া বের করে আনলেন তিনি। প্রায় ৪৫ মিনিট সাগরের গভীরে যাওয়ার পর একটা পোলের কাছে এসে থেমে গেল আমাদের ট্রলার। প্রশিক্ষকেরা সবাইকে আশ্বস্ত করে বললেন, কারও ডোবার কোনো ভয় নেই। কারণ প্রত্যেকে লাইফ জ্যাকেট জড়িয়ে সমুদ্রে নামবে। শুধু খেয়াল রাখতে হবে যেন ফানেল মুখের মধ্যে থাকে। নইলে কিন্তু লবণ-পানি খেতে হবে।

প্রথমে বাবা সাহস করে এগিয়ে গেলেন। ট্রলার থেকে সমুদ্রে নামার সময় আমাদের সেই দেশি ভাই বললেন, লাফ দেন। বাবা শুনে দিলেন এক লাফ। তাতে এক মিনিটের মধ্যে নোনাপানিতে হাবুডুবু খেয়ে নাজেহাল হয়ে উঠে আসতে হলো তাঁকে। তারপর নামলেন ফুপা। আসলে পানিতে নেমে বয়া ধরে ভেসে থাকা হলো নিয়ম। লাইফ জ্যাকেট থাকায় ডোবার কোনো সুযোগই নেই। বয়ার বাইরে না ধরে তিনি উঠে বসলেন তার ওপর। ফুপার আবার ফ্রোজেন শোল্ডারের সমস্যা। তিনি তো আর উল্টাতে পারছেন না। ফলে সমুদ্রের তলদেশের রঙিন দৃশ্য না দেখে তিনি দেখতে থাকলেন নীলাকাশ। এবার আমার পালা। দুই গুরুজনের ব্যর্থতা আমাকে একটু ভয় পাইয়ে দিল। নামার আগে মনে হলো, আমি কি সত্যি এখন ভারত মহাসাগরে নামব? যতই লাইফ জ্যাকেট থাক, আমি তো সাঁতার জানি না। ডুবে গেলে? তবুও সাহস করে নামলাম। নামার সঙ্গে সঙ্গে ঠান্ডা পানির স্পর্শ পেলাম। এ রকম অনুভূতি জীবনে আর হয়নি। নিচে চেয়ে দেখি হাজার রকমের মাছ। কোনোটা লাল, কোনোটা নীল, আবার কোনোটা রংধনুর রঙের। চারদিকে নানা ধরনের কোরাল। নীল ঠান্ডা লবণাক্ত পানি। মাস্কের কাচে এনহ্যান্সার থাকায় সব স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে। এ এক আলাদা জগৎ। মনে হলো, যেন আমি ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেলের ক্যামেরায় সমুদ্রের তলদেশের এক নতুন জগৎ দেখছি। কত কিছু যে দেখলাম সেখানে! পানি ঠান্ডা থাকায় গনগনে সূর্যের তাপ গায়ে লাগছিল না। আমার সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে কিছুক্ষণ পরে আমার বাবা-মা, ফুপা-ফুপু এবং জাপানি বন্ধু দুজনও পানিতে নেমে পড়লেন। প্রায় ৩০ মিনিট পর আমরা ট্রলারে ফিরলাম। এসবের ফাঁকে বোনাস হিসেবে আমি কিন্তু বেশ খানিকটা নোনাপানিও গিলে ফেলেছিলাম।

ফেরার পথে আমরা গেলাম ডলফিন দেখতে। প্রায় ২০ মিনিট চলার পর ট্রলারের ইঞ্জিন বন্ধ করে দেওয়া হলো। বলা হলো এলাকাটা ডলফিনের বিচরণক্ষেত্র। কপাল ভালো হলে ওদের দেখা মিলবে। আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি, যদি ওদের দেখা মেলে। হঠাৎ একটা শব্দ শোনা গেল। তাকিয়ে দেখি একঝাঁক ডলফিন আমাদের নৌকার দিকে ধেয়ে আসছে। বাবার হাতে ছিল ক্যামেরা। তোলা হয়ে গেল সেই অসাধারণ দৃশ্যের ছবি। কাছ থেকে দেখা ডলফিনগুলোর ছবি ধরা পড়ল বাবার ক্যামেরায়। আমাদের ভাগ্যটা ভালোই ছিল মনে হয়।

অবশেষে ফেরার পালা। ততক্ষণে টকটকে লাল সূর্য নীল সমুদ্রের ঠান্ডা পানিতে ডুবতে শুরু করেছে। কী যে সুন্দর সেই দৃশ্য। আমার মনে হলো এ জীবনে এর চেয়ে সুন্দর দৃশ্য আমি আর দেখিনি। সেই অসম্ভব ভালো লাগার অনুভূতি নিয়ে আমরা ফিরতে থাকলাম মালির বন্দরের দিকে।

(কিশোর আলোর সেপ্টেম্বর ২০১৬ সংখ্যায় প্রকাশিত)