ভারতীয় বাদ্যযন্ত্র

ওস্তাদ আলাউদ্দীন খাঁ কোন বাদ্যযন্ত্রটি বাজাতেন, জানো? সরোদ। আরও অনেক বাদ্যযন্ত্রই তিনি বাজাতে পারতেন, কিন্তু লোকে তাঁকে চিনত সরোদের জন্যই। তাঁরই শিষ্য পণ্ডিত রবিশঙ্কর বাজাতেন সেতার। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ারে যে ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ হয়েছিল, তাতে সেতার বাজিয়েছিলেন রবিশঙ্কর, তাঁরই সঙ্গে সরোদ বাজিয়েছিলেন আকবর আলী খাঁ এবং তবলায় ছিলেন আল্লারাখা।

ভারতীয় উপমহাদেশে যে বাদ্যযন্ত্রগুলো ছিল বা আছে, তা নিয়েই একটু কথা হয়ে যাক। বাদ্যযন্ত্র হচ্ছে সেই যন্ত্র, যা সংগীতের উপযোগী শব্দ সৃষ্টি করে। এগুলো ব্যবহার করা হয় কণ্ঠসংগীত ও যন্ত্রসংগীতে। সেই বহু আগে সিন্ধু সভ্যতার সময় বেণু, বীণা ও মৃদঙ্গ ছিল এখানে। বৈদিক যুগে ছিল দুন্দুভি, ভূমি-দুন্দুভি, বেণু, বীণা প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার।

বাদ্যযন্ত্রকে ভাগ করা হয় ‘তত’, ‘শুষির’, ‘ঘন’ ও ‘আনদ্ধ’—এই চার শ্রেণিতে। তারযুক্ত যা, তা ততযন্ত্র। ফুঁ দিয়ে বাজানো হয় যেগুলো, সেগুলো শুষির, ধাতুনির্মিত যন্ত্র ঘন এবং চামড়ার আচ্ছাদন দিয়ে তৈরি যন্ত্রের নাম আনদ্ধ।

মজাটা হচ্ছে তত ও শুষিরযন্ত্র বাজানো যায় গানের সঙ্গে, আবার তা এমনি যন্ত্র হিসেবেও। যেমন: সেতার, সরোদ, বাঁশি। আলাউদ্দীন খাঁর সরোদ বা রবিশঙ্করের সেতার যে শুনেছে, সে-ই বুঝেছে কী অসাধারণ এই যন্ত্রগুলোর ভাষা! কিন্তু যাকে আমরা ঘন ও আনদ্ধ যন্ত্র বললাম, তা কেবল গান বা অন্য যন্ত্রের সঙ্গেই বাজানো যায়। যেমন তানপুরা, মৃদঙ্গ।

হিন্দু সম্প্রদায়ের পূজা-পার্বণে ঢোল-কাঁসর-শঙ্খধ্বনি থাকবেই। মুসলমান সম্প্রদায়ের বিয়ের অনুষ্ঠানে সানাই বাজানো হয়, আর হিন্দু বিয়েতে বাজানো হয় সানাই, শঙ্খ, ঢোল, কাঁসর ইত্যাদি। কাড়া-নাকাড়া, শিঙ্গা, দামামা, বিউগল প্রভৃতি যুদ্ধের বাদ্যযন্ত্র।

খ্রিষ্টীয় পঞ্চম শতকে বিখ্যাত চৈনিক পর্যটক ফা-হিউয়েন প্রাচীন বাদ্যযন্ত্র দেখে এ দেশকে সংগীত ও নৃত্যের দেশ বলেছিলেন। খ্রিষ্টীয় অষ্টম শতকে নির্মিত পাহাড়পুর-ময়নামতীর প্রস্তরফলক ও পোড়ামাটির চিত্রে নৃত্য ও বাদ্যরত মানুষের মূর্তি পাওয়া গেছে। এতে কাঁসর, করতাল, ঢাক, বীণা, মৃদঙ্গ, বাঁশি, মৃদ্ভাণ্ড প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্রের দেখা মেলে।

আনুমানিক ত্রয়োদশ শতকে রচিত ধর্মপূজার গ্রন্থ শূন্যপুরাণে ঢাক, ঢোল, কাড়া, মৃদঙ্গ, মন্দিরা, ডম্বরু, দুন্দুভি, শঙ্খ, শিঙ্গা, ঘণ্টা, জয়ঢাক, দামামা ইত্যাদির উল্লেখ আছে। মধ্যযুগে যেসব বাদ্যযন্ত্রের উল্লেখ আছে, তার মধ্যে স্বরমণ্ডল, রুদ্রবীণা, দোতারা, সানাই, শিঙ্গা; করতাল, মন্দিরা, ঘণ্টা, ঝাঁঝর, কাঁসর; আনদ্ধ দুন্দুভি, মৃদঙ্গ, জয়ঢাক, ডম্বরু, পাখোয়াজ, ভেরি, ঢাক, ঢোল, মর্দল ইদ্যাদি। মঙ্গলকাব্যের যুগ শেষে বীণা, সারিন্দা, তানপুরা, এসরাজ, সরোদ, একতারা, সেতার, সুরমণ্ডল, সুরবাহার, বাঁশি, করতাল, তবলা-বাঁয়া, ঢোলক, শ্রীখোল প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্রের উদ্ভব ঘটে।

মধ্যযুগে ভারতীয় সংগীতকলায় মুসলমানদের অবদান অনেক। সুফি সাধকদের সাধন-ভজনে বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার ছিল। সানাই ও নহবত-জাতীয় যন্ত্র মুসলমানদেরই আবিষ্কার।

এরপর ইংরেজ এল। পাশ্চাত্য সংগীত ও বাদ্যযন্ত্রের ব্যাপক প্রভাব পড়ল। হারমোনিয়াম, বেহালা, গিটার, ফ্লুট, বিউগল ইত্যাদি পাশ্চাত্যের বাদ্যযন্ত্র।

এসব বাদ্যযন্ত্রের বেশির ভাগই এখনো টিকে আছে। সুরের মূর্ছনায় বিবশ করে তুলছে সংগীতপ্রিয় মানুষের মন।