ভাসা জাদুঘর: পৃথিবীর বৃহত্তম ধাঁধা!

ভাসা জাদুঘর
ভাসা জাদুঘর

       সতেরো শতকের কথা। পোল্যান্ড-লিথুয়ানিয়া আর সুইডেনের মধ্যে তখন বিরাজ করছে তীব্র রেষারেষি। সুইডেনের তৎকালীন রাজা, উত্তরের সিংহ হিসেবে পরিচিত গুস্তাভাস দ্বিতীয় অ্যাডোলফ চিন্তা করে দেখলেন বাল্টিক সাগরে নিজেদের একটা শক্তিশালী নৌ অবস্থান তৈরি না করলে তো আর হচ্ছে না। ইতিমধ্যেই কিছু যুদ্ধে পোলিশদের হাতে পড়ে হারাতে হয়েছে কয়েকটি যুদ্ধজাহাজ। যেমন ভাবনা তেমন কাজ। আদেশ দিলেন, তৈরি করতে হবে দুর্ধর্ষ আর অপ্রতিরোধ্য এক যুদ্ধজাহাজ!

       আদেশ দেওয়া হয়েছিল ১৬২৫ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারিতে, আর ১৬২৭ খ্রিষ্টাব্দেই তৈরি হয়ে যায় ৬৯ মিটার দীর্ঘ, ৫০ মিটার উচ্চতার আর ১২০০ টন ভরের এক দুর্দান্ত যুদ্ধজাহাজ। বসানো হয় ৬৪টি কামান আর শয়ে শয়ে ভাস্কর্য, যেন অবয়বেই পিলে চমকে যায় শত্রুদের। দৈত্যাকার এ জাহাজের নাম দেয়া হলো ‘ভাসা’ (Vasa)! নির্মাণগত দিক দিয়ে ছোটখাটো কিছু সতর্কতা অবশ্য দেওয়া হয়েছিল, তবে অ্যাডমিরাল উপেক্ষা করেন সেসব। হাল ধরতে হবে বাল্টিকের, সময় কম, জাহাজের ছোটখাটো ব্যাপার নিয়ে ভাবলে চলে?

        ১৬২৮ খ্রিষ্টাব্দে ১০ আগস্ট। স্টকহোম শহরের হাজারো অধিবাসী আর বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা ভিড় করেন ইতিহাসের সাক্ষী হতে। ‘ভাসা’র প্রথম যাত্রা দেখবেন তাঁরা। ইতিহাসের সাক্ষী তাঁরা হয়েছিলেন বটে, প্রথম যাত্রায় শিপইয়ার্ড থেকে মাত্র ১৩০০ মিটার দূরেই যে ভরাডুবি ঘটে আশা-ভরসার প্রতীক এই যুদ্ধজাহাজের! আর গত বছরের ১১ আগস্ট, জাহাজডুবির ঠিক ৩৯১ বছর পর আমার সৌভাগ্য হয়েছিল এই জাহাজ দেখতে যাওয়ার।

        নিশ্চয়ই ভ্রু কুঁচকে ভাবছ, যে জাহাজ ডুবেই গেছে, সে জাহাজ আবার দেখতে গেলাম কী করে? বলছি। আজকের সত্যিকারের এই গল্পটা কোনো জাহাজডুবির নয়, বরং বিজ্ঞান আর প্রকৌশলের বদৌলতে মানুষ কী করতে পারে, তার গল্প। তবে সে গল্প হার মানায় রূপকথাকেও।

        গত বছর আগস্ট মাসে এক সম্মেলনে যোগ দিতে পৌঁছাই সুইডেনের স্টকহোম শহরে। সম্মেলনের আগেভাগেই পৌঁছেছিলাম আশপাশের জায়গা, বিশেষ করে জাদুঘরগুলো ধীরেসুস্থে দেখব বলে। আর সব দ্রুত দেখা যায়, কিন্তু জাদুঘর? কস্মিনকালেও নয়। তা দেখতে হয় ধীরে ধীরে, অনুভব করে। আর জাদুঘর না দেখলে নতুন দেশ ‘চোখে দেখা’ হয় বটে, কিন্তু ‘মনের দেখা’টা হয় না। জাদুঘর দেখার তালিকার শুরুতেই ছিল ‘ভাসা’ জাদুঘর। আমার ইচ্ছার কথা জেনে নিয়ে প্রথমেই এই জাদুঘরে নিয়ে গেল এক আপু।

ধাঁধার সমাধান করে আবার নির্মাণ করা ভাসা যুদ্ধজাহাজ
ধাঁধার সমাধান করে আবার নির্মাণ করা ভাসা যুদ্ধজাহাজ

        জাদুঘরে ঢুকেই চোখে পড়ল প্রকাণ্ড এই জাহাজ, মোট তিনতলা জুড়ে যার অবস্থান। দেখলে বিশ্বাসই হয় না, এই জাহাজ কোনো দিন পানির নিচে ছিল। যেন কোনো অজানা যুগের ইতিহাসকে লালন করে জাহাজের ভাস্কর্যগুলো আজও মুখ খিঁচিয়ে রয়েছে অদৃশ্য শত্রুর প্রতি। চোখ মুদলে যেন শোনা যায় যুদ্ধের দামামা, আর কামানের বজ্রকণ্ঠ। জাদুঘরজুড়ে পর্যটকদের ভিড়, বিভিন্ন ভাষায় গাইডরা বুঝিয়ে দিচ্ছেন ইতিহাস। সবার মুখেই চমৎকৃত হওয়ার আভা। এখানকার অডিটোরিয়ামে খানিক পরে পরে বিভিন্ন ভাষার ভিডিওতে দেখানো হয় উদ্ধারের চমৎকার কীর্তিকথা। জাহাজ উদ্ধারের কাহিনি এখান থেকেই জেনে নিলাম। সে এক রোমাঞ্চকর কাহিনি।

        জাহাজডুবির পর কেটে গিয়েছিল ৩০০ বছরের বেশি সময়। আন্দেস ফ্রাঁজিয়া নামের এক জ্বালানি প্রকৌশলী বেকহলমেন দ্বীপের সামনে পানির নিচে কাজ করতে গিয়ে খুঁজে পেলেন ওক কাঠের একটি খণ্ড। আরেকবার অনুসন্ধানে আবার খুঁজে পেলেন একই জিনিস। পানির নিচের ওই এলাকায় তবে খুব বড় কিছু আছে, কিন্তু সেটা কী? এটাই সেই বিখ্যাত ‘ভাসা’ নয়তো?

        নেভি অভিযান শুরু করল। দ্রুতই আবিষ্কৃত হলো যুদ্ধজাহাজের ভগ্নাবশেষ। কিন্তু এত বছর ধরে পানির নিচে ছিল, শীতল পরিবেশ—এসবই কাঠ পচানো কীটদের পক্ষে অনুকূল; তবে এখন পচে-গলে কিছু কি বাকি আছে জাহাজের? নিয়তিই বটে! জানা গেল, সুয়েজ আবর্জনা নাকি ঘিরে ছিল তাকে, আর তাই এখনো অবশিষ্ট আছে একসময়ের প্রতাপশালী এই জাহাজ। সুইডিশ রেডিওগুলোতে ঢালাওভাবে প্রচারিত হলো এ সংবাদ। এ যে অবিশ্বাস্য কাণ্ড!

        আলোচনা চলতে লাগল, কী করে উদ্ধার করা যায় এই যুদ্ধজাহাজ। অবশেষে অনেক তর্ক-বিতর্কের পর শুরু হলো উদ্ধার অভিযান। ৩৩১ বছরের নিদ্রা ভেঙে নড়ল যুদ্ধজাহাজ ‘ভাসা’। ১৮টি ধাপ পার করে ক্যাসেলহলমেন দ্বীপের কাছে ১৭ মিটার গভীরতায় ভেসে উঠল সে। এরও দুই বছর পরে, ১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দের ২৪ এপ্রিল পানির ওপর মুখ তুলল এই যুদ্ধজাহাজ, পৃথিবীজোড়া মিডিয়ায় শীর্ষস্থান দখল করল মানবসভ্যতার অভূতপূর্ব এ ঘটনা। এর পরের বছর সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হলো ভগ্ন এই জাহাজ, সে বছর ৪ লাখ ৩৯ হাজার ৩০০ জন টিকিট কেটে দেখতে আসেন এই জাহাজ।

        কিন্তু বিজ্ঞানী আর প্রকৌশলীরা থেমে থাকলেন না। তাঁরা চান জাহাজকে আদি অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে। শুনতে হাস্যকর মনে হচ্ছে, না? হওয়াটাই স্বাভাবিক। সাড়ে ৩০০ বছর পরে উদ্ধার করা ভাঙা জাহাজ ফিরে আসবে আদি অবস্থায়? তা হয় নাকি?

জাহাজের চিত্রকর্মের সঙ্গে লেখক
জাহাজের চিত্রকর্মের সঙ্গে লেখক

        বিজ্ঞান চ্যালেঞ্জ নিতে ভালোবাসে। নতুবা অগ্রগতি তো থেমে যেত সেই কবেই! শুরু হলো এক বিশাল কর্মযজ্ঞ। আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের নিয়ে দল গঠিত হলো, যেখানে প্রত্নতাত্ত্বিক, প্রকৌশলী, রসায়নবিদ থেকে শুরু করে সবাই ছিলেন। এর মধ্যে স্থাপত্যবিষয়ক এক চ্যালেঞ্জের মাধ্যমে নর্ডিক দেশগুলো থেকে আসা ৩৮৪টি প্রস্তাব থেকে নির্বাচিত হয় মূল জাদুঘরের নকশা। ১৯৯০ সালে শেষ হয় জাদুঘর নির্মাণের কাজ। কিন্তু জাহাজের কাজ সম্পন্ন হতে আরও অনেক দেরি।

        এত দিন ধরে কাঠ ছিল পানির নিচে, ওপরে ওঠালে তো শুকিয়ে তাতে ফাটল ধরবে। তাই পানি সরিয়ে প্রবেশ করানো হলো পলিইথিলিন গ্লাইকল নামের রাসায়নিক পদার্থ। এরপর আর্দ্রতা বুঝে ধীরে ধীরে ১০ বছর ধরে শুকানো হলো এই কাঠ। একবার দেখা গেল পর্যটকদের চাপে আর তীব্র বৃষ্টির কারণে আর্দ্রতার হেরফের ঘটায় কাঠে ক্ষয় শুরু হচ্ছে। তড়িঘড়ি করে আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রকল্পের মাধ্যমে তারও সমাধান করা হলো। বিজ্ঞানের ইতিহাসে নিঃসন্দেহে চমৎকার এক কর্ম ‘ভাসা’র পুনরুদ্ধার, এই প্রকল্পের মাধ্যমে এমন অনেক কিছু জানা গেছে যা বিজ্ঞানকে করেছে সমৃদ্ধ। রাসায়নিক দ্রব্যাদির কিছু গুণাগুণের স্বরূপ এর আগে বিজ্ঞান জানত না। হাতে-কলমে জাহাজের পুনর্নির্মাণ অভিযান পরিচালনার সময় তা জানা যায়।

        জাহাজ থেকে প্রায় ১০০০ ভগ্ন ভাস্কর্য এবং ৫০০০ বিভিন্ন বিচ্ছিন্ন দ্রব্যাদি পাওয়া গেছিল। এ এক অদ্ভুতুড়ে দৈত্যাকার ধাঁধা! সাড়ে ৩০০ বছর ধরে পানিতে থাকা এসব ভাঙা টুকরা মিলিয়ে নিয়ে গড়ে তোলা হচ্ছে মূল জাহাজ।

জাহাজে প্রাপ্ত কামানের মডেল (ওপরে), ভাস্কর্য (নিচে বামে), জাহাজের মডেল (নিচে মাঝে) এবং উদ্ধার অভিযানে অংশ নিয়েছিল যে বেশে (ডানে)
জাহাজে প্রাপ্ত কামানের মডেল (ওপরে), ভাস্কর্য (নিচে বামে), জাহাজের মডেল (নিচে মাঝে) এবং উদ্ধার অভিযানে অংশ নিয়েছিল যে বেশে (ডানে)

        বিজ্ঞান পারে। এখানেও সে হারেনি। উচ্চাভিলাষী এ প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে মূল জাহাজকে তার ৯৮ শতাংশ পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয়। অর্থাৎ বর্তমানে আমি যে অবস্থায় জাহাজটা দেখলাম, আজ থেকে ৩৯১ বছর আগে এই রূপেই সমুদ্রে ভেসেছিল এ যুদ্ধজাহাজ! প্রতি তলায় হাজারো সৈনিক প্রস্তুত ছিল শত্রু জাহাজকে ডুবিয়ে দেওয়ার জন্য। কামানগুলো প্রস্তুত ছিল, যেকোনো সময় গর্জে উঠবে বলে! ভাবলে রীতিমতো শিহরণ জাগে।

        জাদুঘরের প্রান্তে প্রান্তে আগলে রাখা হয়েছে সে সময়ের প্রত্নতাত্ত্বিক বিভিন্ন চিহ্ন। কঙ্কাল, জাহাজের মডেল, অস্ত্রশস্ত্র প্রভৃতি যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে ওই সময়ে যাঁরা জাহাজে ছিলেন এবং জাহাজের সঙ্গেই শহীদ হয়েছেন, তাঁদের বর্ণনা। সে বর্ণনা দেখলে চমৎকৃত হতে বাধ্য; অধিবাসীরা ওই দিন কী খেয়েছিলেন, কী পরেছিলেন, এমনকি কার কোন রোগ ছিল, তাও বিশ্লেষণ করে বলে দেওয়া হয়েছে। খোদ ওই ব্যক্তিই জানতেন না যে তাঁর এ রোগ ছিল! আর জানবেনই বা কী করে, ওই সময় এসব রোগের বিবরণী আবিষ্কার হলে তবে তো! এ ছাড়াও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে উদ্ধার অভিযানের বিভিন্ন কাণ্ডকারখানা। এর ওপর উপন্যাস লিখলে তা বুঝি পৃথিবীর দীর্ঘতম উপন্যাস হবে!

        পৃথিবীর জনপ্রিয়তম ভ্রমণবিষয়ক ওয়েবসাইট ট্রিপঅ্যাডভাইজর অনুযায়ী পৃথিবীর সেরা জাদুঘরের মধ্যে ‘ভাসা’র অবস্থান নবম, বিশ্বজুড়ে লাখো পর্যটক প্রতিবছর ছুটে আসেন এই জাদুঘর দেখতে, যা স্ক্যান্ডিনেভিয়া অঞ্চলের মধ্যে সর্বোচ্চ। ২০১৭ সালেই ১৫ লাখ পর্যটক আসেন এই জাদুঘরে। এ যে নিছক এক যুদ্ধজাহাজ নয়, নিছক কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন বা নিছক এক উদ্ধার অভিযানের গল্প নয়, বরং মানুষের সক্ষমতার জয়গান লিপিবদ্ধ রয়েছে এর প্রতিটি বিন্দুতে।

ছবি : লেখক