ভূতগাছ

ভূতের গল্প লিখতে গেলে লেখকেরা সাধারণত ভূতের থাকার জন্য যে আস্তানা তৈরি করেন, তার অধিকাংশই বনজঙ্গল, ঝোপঝাড়, কিংবা উঁচু কোনো গাছ। নাম ধরে বলতে হলে মাঠপারের বিশাল বটগাছ, বাড়ির পেছনের বাঁশঝাড়, পুকুরপাড়ের শেওড়াগাছ, পথের ধারের তালগাছ, বাগানের তেঁতুলগাছ—ইত্যাদি গাছের কথা বলতে হয়। এসব গাছেই ভূত থাকে বলে অনেকে বিশ্বাস করেন। তবে এসব কুসংস্কার ছাড়া আর কিছুই নয়। আবার বাড়ির আশপাশের কোনো উঁচু বা ঝোপালো গাছেও ভূতের আখড়া থাকে বলে ধারণা অনেকের। তবে ভূতের মতো এমন ভয়ংকর চরিত্রের ঘরবাড়ি কেন নিরীহ গাছপালার ওপর বর্তাল, সেটা বলা মুশকিল! এ অপবাদের কারণে আশপাশের অনেক গাছপালাই নির্বিচারে কাটা পড়েছে। কিন্তু এসব গাছ তো একেবারেই নির্দোষ। যেসব গাছে ভূত থাকে বলে ভূত-বিশ্বাসীদের ধারণা, সেসব গাছ সম্পর্কে একটু জানা যাক।

বটগাছ

বটগাছ সারা দেশেই দেখা যায়। মাটির সমান্তরালে বাড়তে থাকা ডালপালার ঝুরিগুলো একসময় মাটিতে গেঁথে নিজেরাই একেকটা কাণ্ডে পরিণত হয়। এভাবে একেকটি বটগাছ দীর্ঘ জীবনে বিশাল এক মহিরুহে পরিণত হয়। বটগাছকে ঘিরে যেমন আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্যের নানামুখী কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয় আবার ভূতের ঘরবাড়ি হিসেবেও বটগাছের নাম চলে আসে। তবে বটগাছের কপালে ভূতের অপবাদ জুটলেও সাধারণত এ গাছ কাটতে দেখা যায় না।

তাল

তাল দেশের সর্বত্র জন্মে। ফরিদপুর ও বরেন্দ্র অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। পথের ধারে, খালের পাড়ে, নির্জন পোড়াবাড়ি ও মাঠপারে একাকী দাঁড়িয়ে থাকা তালগাছগুলোতেই নাকি ভূতের বাসা। আমরাও অবশ্য এসব গল্প শুনতে শুনতে বড় হয়েছি। বাজার থেকে আসা-যাওয়ার পথে অনেক দিন ভালোভাবে লক্ষ করেও দেখেছি তালগাছে কোনো ভূতপ্রেত দেখা যায় কি না। বৃথা চেষ্টা। পাতার কিনারায় শুধু বাবুই পাখির কতগুলো শূন্য বাসা দুলতে দেখেছি।

তাল একক কাণ্ডবিশিষ্ট বহুবর্ষজীবী উদ্ভিদ। প্রায় ৩০ মিটার পর্যন্ত উঁচু হতে পারে। পাতা দেখতে পাখার মতো। পুরুষ ফুল ও স্ত্রী ফুল পৃথক গাছে জন্মে। ফল বড়, রসাল ও কালচে বর্ণের। পুরুষ গাছের রস পান করা যায়। পাকা তালের আঠালো শাঁস থেকে পিঠা হয়। মঞ্জরির ছাই জন্ডিসে উপকারী।

শেওড়া

শেওড়াগাছের ওপরই ভূতের অপবাদটা সবচেয়ে বেশি। শেওড়াগাছ মানেই ভূতপ্রেতের বিভীষিকা। গ্রামে রাতের অন্ধকারে তো নয়ই, দিনের বেলায়ও কেউ খুব একটা এ গাছের ছায়া মাড়াতে চায় না। আমাদের দেশে ভূতের যেসব গল্প লেখা হয়েছে, তার অধিকাংশই শেওড়াগাছকে ঘিরে। পুকুরপাড়ে সাধারণত কিছুটা আড়াল করার জন্য এ গাছ লাগানো হয়। পুরু ও ঘনবদ্ধ পাতার বিন্যাসে এ গাছ সব সময়ই ছায়াময় এবং ঝোপালো ধরনের। এ গাছ দেশের সর্বত্রই জন্মে। ছোট চিরসবুজ বৃক্ষ, ১৪ মিটার পর্যন্ত উঁচু হতে পারে। শাখা-প্রশাখাগুলো ঝুলে থাকতে দেখা যায়।

বাঁশ

বাঁশঝাড় নেই গ্রামে এমন বাড়ি মনে হয় খুঁজে পাওয়া যাবে না। এসব ঝাড় আবার বাড়ির পেছনে বা পুকুরপাড়ের নির্জন স্থানেই দেখা যায়। আর তাতেই যত বিপত্তি। বাড়ির সব অশরীরী আত্মা যেন সেখানেই ভর করে। বাঁশঝাড়ের অবয়বও খানিকটা ভয় ধরানো। অসংখ্য বাঁশ, ঘন কঞ্চি আর পাতার ঠাসবুননে একেবারেই নিশ্ছিদ্র।

তেঁতুল

তেঁতুলগাছের ক্ষেত্রে শুধু ভূতের অপবাদই নয়, আরেকটি অপবাদও রয়েছে। গ্রামে একটি প্রবাদ প্রচলিত আছে, যেসব ছেলেমেয়ে তেঁতুলগাছের তলায় ঘোরাঘুরি করে, তাদের নাকি ভালো পড়াশোনা হয় না। এই দুটি অপবাদ কাঁধে নিয়ে তেঁতুলগাছ ভয়ংকর ধরনের খলনায়কে পরিণত হয়েছে! এসব কারণে সারা দেশে ব্যাপক হারে তেঁতুলগাছ কাটা পড়েছে। গ্রাম বা শহরে তেঁতুলগাছকে এখনো অশুভ মনে করা হয়। কিন্তু এসব নিছকই মানুষের কল্পনা। তেঁতুল মূলত দীর্ঘস্থায়ী, দৃঢ় ও নিবিড় ছায়াময় চিরসবুজ গাছ। পাতাও বেশ নান্দনিক। ফল মুখরোচক, মাংসল ও বাঁকানো ধরনের। কাঁচা অবস্থায় টক, পাকলে টক-মিষ্টি স্বাদের। নুন-মরিচ মাখিয়ে খেতে মজা।