ভূতের গল্প আকর্ষণীয় কেন?

‘...অমাবস্যার রাত। ঘুটঘুটে অন্ধকার। ভূতের গলির সেই বাড়িটা। দরজা-জানালা ভাঙা। রিয়াজ বলল, ওই দেখ, ওরা আসছে...। এমন সময় একটা দমকা হাওয়া। গমগমে গলায় কে যেন বলে উঠল, তোঁরা কেঁ রেঁ? আঁসছি দাঁড়াঁ...অঁনেক দিন মাঁনুষের রঁক্ত-মাঁংস খাঁইনি...। আগুনের গোলার মতো চার জোড়া চোখ জ্বলজ্বল করছে...। আমি তো ফিট হয়ে পড়ে গেছি...।’

এই গল্পটা বলছিলেন আমাদেরই একজন সিনিয়র সহপাঠী। প্রতি সপ্তাহে গভীর রাতে আমরা কয়েকজন ঘরের বাতি নিভিয়ে একটা গা-ছমছম ভাবের পরিবেশ তৈরি করে ভূতের গল্প শুনি। মনে বিদ্যুতের শিহরণ খেলে যায়। চরম আতঙ্কে ঘণ্টাখানেক থাকতে কেন যে ভালো লাগে জানি না। কিসের আকর্ষণে যেন ছুটে যাই সেই ভূতের গল্পের আসরে।

ছোটবেলায় মায়ের কাছে ঠাকুরমার ঝুলির ভূতের গল্প কত শুনেছি। এখন তো জানি, শুধু আমরাই না, বিলাত-আমেরিকায়ও ছোটবেলায় ‘হাঁও মাঁও খাঁও’ ধরনের ভূতের গল্প শোনার চল আছে।

কিন্তু কেন? আমরা তো জানি ভূত বলে কিছু নেই। তাও কল্পনা করলে যে গায়ে কাঁটা দেয়, সেটাই আসল মজা।

বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এই আকর্ষণের পেছনে একটি যুক্তিসংগত কারণ আছে। নিছক খেলার ছলে ভূতের গল্প শোনা নয়। আদিম যুগে গহিন বনে শিকারের সন্ধানে ঘুরে বেড়ানোর সময় হঠাৎ হয়তো বাঘ-সিংহ বা হায়েনার মুখে পড়তে হতো। বাঁচার তাগিদেই তখন আতঙ্কে সারা শরীর শিহরিত হয়ে উঠত। চোখ-কান সদাসতর্ক। কারণ, এর ফলে স্নায়ুর মাধ্যমে খবর পৌঁছে যায় মস্তিষ্কে। সেখান থেকে তখন বিশেষ সংকেতে কিছু হরমোন বের হয়। এই হরমোন যেকোনো বিপদ মোকাবিলায় শরীরকে প্রস্তুত রাখে। আত্মরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় বাড়তি শক্তির জোগান আসে। এই ভয়-আতঙ্ক-শিহরণ সেই আদিম যুগে বেঁচে থাকার অন্যতম শর্ত ছিল। যাদের শরীর এ ধরনের আতঙ্কের সংকেতে সাড়া দিতে পারত না, তাদের পক্ষে বেঁচে থাকা কঠিন ছিল। ফলে পরবর্তী বংশধরে লাখ লাখ বছর ধরে এই ধারাটি সঞ্চারিত হয়ে আসছে। আতঙ্কে শিহরিত হওয়ার গুণসম্পন্ন জিন আজও আমরা বহন করছি।

আধুনিক জীবনের ঘাত-প্রতিঘাতে বেঁচে থাকার জন্যও এটা দরকার। কারণ, এই আতঙ্ক তো আসলে শরীরে একধরনের হরমোন বের হতে সাহায্য করে। আপদ-বিপদ, দৈনন্দিন জীবনের ঝড়-ঝাপ্টা সহ্য করে এগিয়ে যেতে হলে এই হরমোন দরকার।

আমাদের ছোটবেলা থেকে মা-বাবারা সে জন্যই ভূতের গল্প শোনান। যদিও জানেন ভূত বলে কিছু নেই। কিন্তু জীবনের কঠিন পরীক্ষায় বেঁচে থাকার জন্য এ ধরনের আতঙ্কের পরিস্থিতিতে প্রয়োজনীয় সাড়া দিতে শরীরকে প্রস্তুত রাখতে হয়।

ভূতের গল্পগুলো শোনার আসরগুলো আমাদের আরও স্মার্ট হওয়ার, যেকোনো পরিস্থিতিতে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে নিজেদের সদা প্রস্তুত রাখার ড্রেস রিহার্সেল। সে জন্যই ভূতের গল্প আমাদের আকর্ষণ করে।

তাই সবাই এসো, ভূতের গল্পের আসরে যোগ দিই। কিন্তু মনে রাখবে, ভূত বলে কিছু নেই।