ভয়টা ভাঙিয়ে দিল মাইসুন

যুক্তরাষ্ট্রের ৯ বছর বয়সী ইউটিউবার রায়ান কাজী এখন দারুণ জনপ্রিয়। কী কারণে রায়ানের এই জনপ্রিয়তা? কী আছে তার ইউটিউব ভিডিওতে? রায়ানের ইউটিউব চ্যানেল রায়ানস ওয়ার্ল্ডে একটু ঘুরে এসে ধারণা পেলাম, শিশুদের যেসব বিষয় নিয়ে কৌতূহল থাকে, খেলনা থেকে শুরু করে বিজ্ঞানের মজার বিষয়—এমন সব বিষয়ে ভিডিও আছে তার। এককথায় রায়ান একজন খুদে ইনফ্লুয়েন্সার। কেবল রায়ান কাজী নয়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে আর করোনাকালীন ছুটির সুবাদে বিশ্বের নানা দেশেই এখন শিশু প্রতিভার দেখা মিলছে। আমাদের চট্টগ্রামের ১১ বছরের উম্মে মাইসুনও তাদের একজন। সেই মাইসুনকে নিয়েই এ লেখা।

ইনফ্লুয়েন্সার মাইসুন

ছোট্ট মাইসুনের চোখেমুখে বুদ্ধির ঝিলিক। ইংরেজিতে নিজেকে পরিচিত করানো বা রেস্তোরাঁয় খাবারের অর্ডার কীভাবে করতে হয় কিংবা টমেটো কি আদৌ ফল নাকি সবজি—এসব বিচিত্র কনটেন্ট নিয়ে তার চমৎকার সব ভিডিও অনেকেই ইতিমধ্যে দেখেছ। ফেসবুকে বা ইউটিউবে অ্যালগরিদম মেনে হাজির হওয়া রাজ্যের ভিডিওর ভিড়ে মাইসুনের কণ্ঠস্বর, প্রাণবন্ত উপস্থাপনা সহজেই নজর কাড়ে। টেন মিনিট স্কুলের সৌজন্যে মাইসুন এখন কেবল ইউটিউবার নয়, বরং ইংরেজির সবচেয়ে খুদে শিক্ষক হিসেবেও সবার কাছে পরিচিত। ‘ছোটদের স্পোকেন ইংলিশ’ নামে এ বছর মাইসুনের একটা বইও প্রকাশিত হয়েছে আদর্শ প্রকাশনী থেকে।

চট্টগ্রামের বাংলা মাধ্যমের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ মহিলা সমিতি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের (বাওয়া) চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী মাইসুনের ইউটিউব চ্যানেলের নাম মাইসুনস ওয়ার্ল্ড। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে ৯ বছর বয়সে ডিজিটাল মাধ্যমে যাত্রা শুরু তার। এখন ফেসবুকে তার ফলোয়ারের সংখ্য ৫ লাখ ৬৪ হাজার আর ইউটিউবে ১ লাখ ১৪ হাজার। টেন মিনিট স্কুলের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের সবচেয়ে কনিষ্ঠ অনলাইন শিক্ষকের খেতাবও পেয়েছে সে।

বাবা আশরাফ উল্লাহ ভিডিও নির্মাণ আর সম্পাদনার কাজটুকু করে দিলেও ভিডিওর কনটেন্ট নিয়ে ভাবনাটা মাইসুনেরই। তার বাবার কাছ থেকে জানা গেল, গত বছর জুনের মাঝামাঝি টেন মিনিট স্কুলের ফেসবুক প্ল্যাটফর্মে ‘কীভাবে ইংরেজিতে নিজেকে পরিচয় করাতে হয়’ শিরোনামের একটি ভিডিওর মাধ্যমে ব্যাপক পরিচিতি পায় মাইসুন। সেই ভিডিও এখন পর্যন্ত ৬৫ লাখবার দেখা হয়েছে।

যোগাযোগের বৈশ্বিক ভাষা ইংরেজির প্রতি এ দেশের শিশুদের মনে একটা ভীতি ছোটবেলা থেকেই জেঁকে বসে। ভাষার এই বাধা অনেকের জীবনেই স্থায়ী হয়। মাইসুন শিশুদের মন থেকে এই ভীতি একেবারেই দূর করে দিয়েছে। মাইসুনের কথা শুনলে, ভিডিও দেখলে ও বই পড়লে মনে হবে, ইংরেজি আসলেই ডালভাত।

ইংরেজি শেখার শুরু যেভাবে

মাইসুনের ইংরেজি শেখার শুরুর কথা জানা যাবে তার সদ্য প্রকাশিত বই ছোটদের স্পোকেন ইংলিশ–এর ভূমিকায়। সেখানে মাইসুন লিখেছে, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ইংরেজি শেখার দরকার হয়ে পড়ল। কারণ, তার সমবয়সী দুই খালাতো বোন লাইবা ও জুয়ারিয়া থাকে যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টারে। প্রতিবছরই দেশে আসে তারা। তাদের সঙ্গে খেলাধুলা ও ভাববিনিময়ে ভাষাটা বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছিল। বোনদের সঙ্গে সহজে মেলামেশার ইচ্ছা থেকেই মাইসুন ইংরেজি শেখার উদ্যোগ নেয়। শুরুতে কার্টুন, পরে কমিকস আর গল্পের বই ছিল তার শেখার উপকরণ। ‘বেন অ্যান্ড হোলি’ আর ‘পেপাপিগ’ কার্টুন তো আছেই, তার পাশাপাশি মাইসুন পড়েছে ‘হ্যারি পটার’, ‘জেরিনিমো স্টিলটন’, ‘প্রিন্সেস ডায়েরিস’, ‘থিয়া স্টিলটন’ সিরিজের বই। বিষয়টি বিস্ময়করই বটে। আমরা শৈশবে ইংরেজি শিখেছি গ্রামার ধরে ধরে। ভার্ব প্লাস জিরান্ড দিয়ে বাক্য রচনার কথা অনেকেরই নিশ্চয় মনে আছে। তবে মাইসুনের শিখনপদ্ধতি একেবারেই আলাদা। ভাষা শেখার এই পদ্ধতি যেন অনেকটাই টোটাল ইমারশন মেথড। অর্থাৎ আপনি ডুবলে গা ভিজবেই।

মাইসুনের মা উম্মে সালমা চৌধুরীর কথায়ও এই গা ভিজিয়ে শেখার বিষয়টা যেন আরও খোলাসা হলো। তিনি বললেন, মাইসুনের জন্য ইংরেজি শেখার কোনো বই কেনা হয়নি। কোনো টিউটরও ছিলেন না। গ্রামার বইয়ের সাহায্য ছাড়াই সে ইংরেজি বলা শিখেছে গল্পের বই পড়ে আর কার্টুন দেখে।

আসলে আমরা বড়রা যা শিখতে পারি, ছোটরা তার চেয়েও সহজে সেসব শিখে যায়। শিখন প্রক্রিয়ার মধ্যে দেখা, অভিজ্ঞতা সঞ্চয়, মনে রাখা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের যে ধাপগুলো আছে, শিশুরা অনায়াসে সেসব অতিক্রম করতে পারে। মাইসুনের ক্ষেত্রেও তা হয়েছে।

লেখক মাইসুন

মাইসুনের লেখা ছোটদের স্পোকেন ইংলিশ প্রকাশিত হয়েছে এ বছরের ১ আগস্ট। বই প্রকাশের আগে প্রকাশনা থেকে মাইসুনের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে চুক্তিও করা হয়েছিল। ১৭টি পরিচ্ছদের এই বইয়ে ইংরেজিতে নিজেকে পরিচয় করানো, ভাববিনিময়, সঠিক উচ্চারণ—এসব নিয়ে আলোচনা রয়েছে। তবে ‘গুগল অ্যাসিস্ট্যান্টের সঙ্গে গল্প’ শিরোনামে মজার লেখাও আছে বইটিতে।

কেবল এই বই নয়, এর মধ্যে ইংরেজিতে একটি উপন্যাসও লিখেছে মাইসুন। সেটিও এখন প্রকাশের অপেক্ষায়।

গত দুই বছরে ৮৪টি ভিডিও আপলোড হয়েছে মাইসুনের ইউটিউব চ্যানেলে। তবে ভিডিও তৈরির চেয়েও মাইসুন পড়তে, বেড়াতে আর ছবি আঁকতে ভালোবাসে। ইংরেজি সিরিজের পাশাপাশি মুহম্মদ জাফর ইকবালের বই ও কিশোর আলো পড়ে সে নিয়মিত। মাইসুনের ইচ্ছা কম্পিউটারবিজ্ঞানী হওয়া। তবে যে পেশাই বেছে নিক, বই পড়া আর লেখালেখি চালিয়ে যাবে বলে জানাল সে।

শিশুদের সম্পর্কে আইরিশ শিল্পী স্টাশিয়া টাউশারের একটা বিখ্যাত উক্তি এমন—একটি শিশু ভবিষ্যতে কী হবে, তা নিয়ে আমরা এমন ভাবিত থাকি যে সে এখনই যে বিশেষ একজন, সেটা খেয়াল করি না। কেবল টাউশার কেন, রবীন্দ্রনাথও বিশ্বাস করতেন, শিশুদের ক্ষমতা অসীম। ডাকঘর নাটকের অমল বন্দী থেকেও নিজের মধ্যে কল্পনা ও স্বাধীনতার জগৎ তৈরি করেছিল। ‘তোতাকাহিনী’র মতো পেটে পুঁথি গুঁজে দিয়ে শিশুটিকে আমরা খুন করি। তা না করলে হয়তো প্রত্যেকের মধ্যেই অসীম সম্ভাবনার ঝলক দেখা যেত। এ কথা যে বাড়িয়ে বলা নয়, মাইসুনের মতো অনেক শিশু তার প্রমাণ রেখে চলেছে।