মজার মজার বইয়ের ঝাঁপি

দৈত্যদানো কিংবা ডাইনির কথা শুনলে দু-একজন বীরপুরুষ বাদে বোধ করি সবারই আতঙ্কে হিম বয়ে যায় শিরদাঁড়া বেয়ে। শজারুর মতো কাঁটা দিয়ে ওঠে গায়ের লোম। বাস্তবে এখনো কেউ এদের না দেখলেও রূপকথার বইয়ে বিস্তর শোনা গেছে দৈত্যদানো আর ডাইনির কথা। তাতে ভয় না পেয়ে উপায় আছে! তবে ভয়ংকর, একরোখা দৈত্যদের ভিড়ে হুমায়ূন আহমেদ শুনিয়েছিলেন অন্য চরিত্রের এক দৈত্যের কথা...

...অনেক আগে এক দেশে ছিল জেলে। তারই এমনই মন্দভাগ্য যে সে যেদিন মাছ ধরতে দক্ষিণে যেত, সেদিন মাছ পাওয়া যেত উত্তরে। আর যেদিন উত্তরে যেত, সেদিন মাছেরা সাঁতরাত দক্ষিণে। তাই তার জালে কোনো মাছই উঠত না। বউ আর ছোট্ট এক মেয়েকে নিয়ে দুঃখে দিন কাটছিল তার। হঠাৎ একদিন তার জালে উঠে এল এক পিতলের কলসি। কলসির মুখ শক্তভাবে বন্ধ। ভেতরে টাকাপয়সা থাকতে পারে ভেবে জেলে খুলে ফেলল সেটি। কিন্তু ওমা, কোথায় টাকাপয়সা! তার বদলে কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘন কালো ধোঁয়া বেরোতে লাগল কলসি থেকে। সেখান থেকে বের হলো ভীষণ-দর্শন এক দৈত্য। এই বুঝি এবার ঘাড় মটকে দেয়! জেলে আর তার মেয়ে তো ভয়ে দে-দৌড়। কিন্তু ঘাড় মটকানোর বদলে দৈত্যটি জেলে আর জেলের মেয়ের সঙ্গে ভাব করতে শুরু করে দিল। আসলে সে ছিল ভীষণ বোকা আর দুঃখী এক দৈত্য। দৈত্য সমাজের কলঙ্ক যাকে বলে। এর পর থেকে জেলের পরিবারের সদস্যের মতোই ওই গ্রামে থাকতে শুরু করল বিশালদেহী সেই দৈত্য। এরপর একের পর এক মজার মজার সব ঘটনার জন্ম দিতে লাগল বোকা দৈত্য...

‘বোকা দৈত্য’ নামের এ গল্পের মজার সেই ঘটনাগুলো বলে তোমাদের পড়ার মজা নষ্ট করতে চাই না। রূপকথার অতিপরিচিত উপাদান ব্যবহার করে কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ তাঁর মেয়ের জন্য লিখেছিলেন এ রকম মজার মজার কিছু রূপকথা। সেই গল্পগুলোই একসঙ্গে প্রকাশিত হয়েছে তোমাদের জন্য রূপকথা বইয়ে। বইটিতে আছে ‘কানী ডাইনি’, ‘রাণী কলাবতী’, ‘হলুদ পরী’, ‘বনের রাজা’, ‘আলাউদ্দিনের চেরাগ’, ‘মিতুর অসুখ’ নামে মোট সাতটি গল্প। গল্পগুলো পড়তে গিয়ে হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে যাবে সেটি কোনো ওয়ারেন্টি (গ্যারান্টির যুগ শেষ) ছাড়াই বলা যায়। লেখকের মজার আরও কিছু বইয়ের মধ্যে রয়েছে বোতল ভূত, মজার ভূত, ভূত ভূতং ভূতৌ, রাক্ষস খোক্ষস ও ভোক্ষস। নাম শুনেই বুঝতে পারছ প্রতিটির পাতায় পাতায় ভূতের রাজত্ব। তবে ভয়ের চেয়ে অনেকগুণ বেশি আনন্দ দেবে এসব ভূত। এ লেখকের আরেক মজার ভুতুড়ে উপন্যাস একি কান্ড! আর এক পরিবারের মজার সব গল্প নিয়ে লেখা উপন্যাস বহুব্রীহিও রাখতে পারো পাঠ্যতালিকায়।

মজার সব ভূতের তালিকায় আরও রাখতে পারো ইমদাদুল হক মিলনের ভূতের নাম রমাকান্ত কামার আর ভূতগাছ। সবার প্রিয় লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবালের কোন বইটি মজার, সেটি তোমরাই সবচেয়ে ভালো জানো। তার পরও দু-একটির কথা উল্লেখ করা যাক। হাত কাটা রবিন, দস্যি ক’জন, দুষ্টু ছেলের দল, কাবিল কোহকাফী, শান্তা পরিবার, বিজ্ঞানী সফদার আলীর মহা মহা আবিষ্কার, সায়রা সায়েন্টিস্ট, টুকি ও ঝায়ের (প্রায়) দুঃসাহসিক অভিযান, টুকুনজিল বইগুলো মজার বইয়ের পাঠ্যতালিকায় রাখতে পারো।

তালিকায় আরও রাখতে পারো মোহাম্মদ নাসির আলীর লেবুমামার সপ্তকাণ্ড, রাহাত খানের দিলুর গল্প, খান মোহাম্মদ ফারাবীর মামার বিয়ের বরযাত্রী। এ বইগুলোর কথা এর আগেও কিআর পাতায় ছাপা হয়েছিল। তাই নতুন কিছু লিখলাম না। মোহাম্মদ নাসির আলীর সৃষ্ট লেবুমামা, রাহাত খানের সৃষ্ট কামাল ভাই আর মোহাম্মদ ফারাবীর সৃষ্ট শাহজাহান ভাইয়ের মতোই আরেক চাপাবাজ চরিত্র সৃষ্টি করেছিলেন এহসান চৌধুরী। তিনি কাঠিমামা। কাঠির মতো পাতলা বলেই এমন অদ্ভুত নাম। শরীরে না কুলালেও চাপাবাজিতে তিনি হাতি-ঘোড়া মারতে সিদ্ধহস্ত। ছোট ছোট একদল ভাগনেদের তিনি আজব অ্যাডভেঞ্চারের গল্প শুনিয়ে আসর মাত করেন। যারা হাসি আর অ্যাডভেঞ্চার একসঙ্গে পেতে চাও, কাঠিমামা সিরিজের বইগুলো তাদের নিঃসন্দেহে ভালো লাগবে।

কাঠিমামার চেয়ে এককাঠি সরেস চাপাবাজ ছিলেন প্রেমেন্দ্র মিত্রের সৃষ্ট ঘনাদা। ১৯৪৫ সালে ৬ আগস্ট হিরোশিমায় অ্যাটম বোমা ফেলার পর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মোড় ঘুরে যায়। এর আট দিন পর, জাপান আত্মসমর্পণ করে। শেষ হয় এ মহাযুদ্ধ। ঠিক পরদিন আত্মপ্রকাশ করেন ঘনাদা। তার পর থেকেই কলকাতার ৭২ নম্বর বনমালী নস্কর লেনের এক মেসবাড়িতে চার বাসিন্দার কাছে আজগুবি সব গল্পে আসর মাতাতে শুরু করেন তিনি। বাস্তবে তালপাতার সেপাই হলেও গল্পে তিনি রাজা-উজির মারতে ওস্তাদ। তার আজগুবি অ্যাডভেঞ্চার কাহিনি বিশ্বাস করতে কষ্ট হলেও মজা আছে হানড্রেড পার্সেন্ট। এ যুগে ঘনাদার বইগুলো আলাদা করে পাওয়া মুশকিল। তার চেয়ে সংগ্রহ করে নিতে পারো ঘনাদা সমগ্র।

ঘনাদার আত্মপ্রকাশের এক যুগ পরে জনসমুখে আসেন পটলডাঙার ভজহরি মুখার্জি ওরফে টেনিদা। ক্লাসের আদু ভাইয়ের মতোই টেনিদাও লেখাপড়ায় ছিলেন যাচ্ছেতাই। সাতবার পরীক্ষা দেওয়ার পর তিনি পাস করেছিলেন উচ্চমাধ্যমিক। পড়ালেখায় লবডঙ্কা হলেও তার হূদয় ছিল বটে একখান! ছিলেন আড্ডাবাজ, চাপাবাজ। খাদক হিসেবেও তার যথেষ্ট সুনাম। এসব দিয়ে তিনি জয় করেছেন ঢাকাই বাঙাল হাবুল সেন, ক্যাবলা আর প্যালারাম বাড়ুজ্জেসহ হাজারো কিশোরের মন। এ চার মূর্তির গোয়েন্দাগিরি, অ্যাডভেঞ্চার, দুষ্টুমি, দস্যিপনা এখনো হাস্যরসের উত্স। টেনিদার কাহিনিগুলো এক মলাটে পাবে টেনিদা সমগ্র কিংবা নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের সমগ্র কিশোর সাহিত্য বইয়ে।

বাংলা ভাষার ছোটদের জন্য ক্লাসিক সৃষ্টি করেছিলেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী আর তস্যপুত্র সুকুমার রায়। সেই কবেকার লেখা হলেও এখনো সেগুলো যে কারও ভালো লাগবে। এর মধ্যে উপেন্দ্রকিশোরের গুপী গাইন বাঘা বাইন আর টুনটুনির বই পড়ে দেখতে পারো। আর সুকুমার রায়ের আবোল তাবোল, পাগলা দাশু পড়লেই খেয়ালখুশির এই রাজার সম্পর্কে তোমার ধারণা হবে। এসব ছড়া আর গল্প ভালো লাগলে সুকুমার সমগ্র সংগ্রহ করতে পারো। তাহলে এক মলাটে পেয়ে যাবে সুকুমারের সবকিছু।

বাংলা হাসির গল্পের সম্রাট শিবরাম চক্রবর্তীর কথা না বললে এ তালিকা অসম্পূর্ণই থেকে যাবে। তিনি সব মিলিয়ে ১২০টি ভিন্ন স্বাদের গল্প লিখেছিলেন। সব গল্পের কমন মসলা হাস্যরস। গল্পগুলো পড়ে রামগরুড়ের ছানারাও ফিক করে হেসে ফেলতে বাধ্য। মজায় ভরপুর সেই গল্পগুলো আলাদা করে না পেলে শিবরাম রচনা সমগ্র অখণ্ড সংস্করণ সংগ্রহ করতে পারো। আর ধীরে ধীরে পড়া শুরু করতে পারো সৈয়দ মুজতবা আলী রচনা সমগ্র।

বিদেশি লেখকদের মধ্যে ডানপিটে টম সয়্যার আর হাকলবেরি ফিনকে নিয়ে লেখা মার্কিন লেখক মার্ক টোয়েনের দুঃসাহসী টম সয়্যার, গোয়েন্দা টম সয়্যার, নভোচারী টম সয়্যার মজার বইয়ের তালিকার একেবারে প্রথম দিকে রাখা যায়। এ ছাড়া তাঁর লেখা দ্য প্রিন্স অ্যান্ড দ্য পপার বইটিও সবার ভালো লাগবে। স্যার আর্থার কোনান ডয়েলকে বেশির ভাগ মানুষ শালর্ক হোমসের স্রষ্টা হিসেবেই জানে। কিন্তু তাঁর সৃষ্ট প্রফেসর চ্যালেঞ্জার নামে আরেকটি জনপ্রিয় চরিত্রও আছে। এ চরিত্র নিয়ে মজার দুটি বই দ্য লস্ট ওয়ার্ল্ড, পয়জন বেল্ট। এ ছাড়া পড়তে পারো জুল ভার্নের আশি দিনে বিশ্বভ্রমণ, সারভেন্তাসের ডন কুইক্সোট, জেরোম কে. জোরোমের ত্রিরত্নের নৌবিহার এবং এরিখ কাস্টনারের লোটি ও লিসা। এ তালিকার সব বই-ই বাংলায় অনুবাদ হয়েছে সেবা প্রকাশনী থেকে।

রুশ দেশের বিখ্যাত কিছু বাংলা অনূদিত বইয়ের মধ্যে আছে আর্কাদি গাইদারের চুক আর গেক, ভসেভলোদ নেস্তাইকোর দুই ইয়ারের যত কাণ্ড, আলেকজান্দার রাস্কিনের বাবা যখন ছোট, নিকোলাই নসভোর আনাড়ির কাণ্ডকারখানা সিরিজ, আনাতোলি আলেক্সিনের ভয়ঙ্কর রোমহর্ষক ঘটনা। শেষটি পাবে প্রথমায়। বাকিগুলো একটু খুঁজলেই পাওয়া যাবে। আবার ই-বুক আকারে পাবে ইন্টারনেটেও।

যারা বাংলার পাশাপাশি ইংরেজি বই পড়তে চাও, তারা বেছে নিতে পারো রোয়াল্ড ডালের চার্লি অ্যান্ড দ্য চকোলেট ফ্যাক্টরি, জর্জস মার্ভেলাস মেডিসিন, দ্য জিরাফ অ্যান্ড পেলি অ্যান্ড মি। ক্রিস্টোফার হিলির দ্য হিরোস গাইড টু সেভিং ইয়োর কিংডম, লিনে রে পার্কিন্সের নাটস টু ইউ, গ্রেস লিনের লিং অ্যান্ড টিং: নট একজাক্টলি দ্য সেইম, ফ্লোরেন্স অ্যাটওয়াটার ও রিচার্ড অ্যাটওয়াটারের মিস্টার পপারস পেঙ্গুইন্স, মেরিয়ন জেনসেনের অলমোস্ট সুপার, টনিয়া হার্লির ঘোস্টগার্ল, ক্রিস গ্যার্বেনস্টেইন ও জেমস প্যাটারসনের আই ফানি: এ মিডল স্কুল স্টোরি, কার্ল হায়াসেনের চম্প এবং স্ক্যাট, স্টিফেন প্যাস্টিসের টিমি ফেইলিয়ার: মিসটেকস অয়ার মেড, শ্যারন ক্রিচের ওয়াক টু মুনস, ই এল কনিগসবার্গের দ্য ভিউ ফ্রম স্যাটারডে, লেমনি স্নিকেটের আনফরচুনেট ইভেন্টস সিরিজ এবং সিউ টাউনসেন্ডের দ্য সিক্রেট ডায়েরি অব আদ্রিয়ান মোল।

জায়গার অভাবে এ বইগুলোর কাহিনি আপাতত লিখছি না। তা ছাড়া সব কাহিনি লিখতে গেলে সাতকাণ্ড রামায়ণ হয়ে যেতে পারে। তবে ওয়ারেন্টি রইল কোনো কাতুকুতু ছাড়াই প্রাণখোলা হাসি আর ভালো লাগার। ভালো লাগলে বন্ধুদের জানাতে ভুলো না।