মহাকাশে মহাঝামেলা!

পৃথিবীর কক্ষপথে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন
পৃথিবীর কক্ষপথে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন

গ্রিক উপকথার ইকারাসের গল্প কি তোমাদের মনে আছে? আচ্ছা, মনে না থাকলে অসুবিধা নেই। আমি বলছি, শোনো। ইকারাসের বাবা ছিলেন ডিডেলাস। তিনি একাধারে স্থপতি, ভাস্কর ও বিজ্ঞানী। একবার রাজা ক্রুদ্ধ হয়ে তাঁকে একটি দ্বীপে নির্বাসনে পাঠালেন। সঙ্গে তাঁর কিশোর ছেলে ইকারাসকেও। ডিডেলাস বিজ্ঞানী মানুষ। তাই পালানোর একটি বুদ্ধি বের করে ফেলেন। পাখির পালক আর মৌচাকের মোম দিয়ে নিজেদের জন্য দুজোড়া পাখা বানালেন। তারপর একদিন সুযোগ বুঝে উড়াল দিলেন। উড়াল দেওয়ার আগে ইকারাসকে পই পই করে বলে দিয়েছিলেন, সূর্যের কাছাকাছি না যেতে। বালক ইকারাস। আকাশে উড়তে পারার আনন্দে সাবধানবাণী ভুলে গিয়ে সূর্যের কাছাকাছি চলে গেল। সূর্যের তাপে পাখার মোম গেল গলে। তারপরে মহাসমুদ্রে সলিলসমাধি।  

পৃথিবী থেকে একটু ওপরেই যদি এই অবস্থা হয়, তাহলে হাজার মাইল দূরের মহাকাশে অবস্থা কেমন হবে? তা ছাড়া সেখানে মহাকর্ষ বল নেই। তাই সেখানে দাঁড়িয়ে কিংবা বসে থাকাও যায় না। ওজনহীন হয়ে শূন্যে ভেসে থাকতে হবে। ঘুমাতে গেলেও ভেসে ভেসে ঘুমাতে হবে। প্লেটে খাবার খাওয়া যাবে না। খাবারও ভেসে থাকবে। ভাসমান অবস্থাতেই সেটা টুপ করে মুখে পুরে নিতে হবে। কেমন আজব, তাই না! মহাকাশের এসব আজব ব্যাপার জেনে নিই আজ।

সকালবেলার পাখি

মহাকাশে কিন্তু সকাল-বিকেলের কোনো ব্যাপার নেই। সেখানে ২৪ ঘণ্টায় অনেকবার সূর্য ওঠে, অস্ত যায়। তাই নভোচারীরা পৃথিবীর মতোই ২৪ ঘণ্টার নিয়ম বেঁধে নিয়েছেন। সে নিয়মেই প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে ওঠেন। উঠে দাঁত ব্রাশ করেন। ব্রাশ করার ব্যাপারটি বেশ মজার। দাঁত ব্রাশ করলে তো মুখে ফেনা হয়। সেই ফেনা কোথাও ফেলারও জো নেই। পানিও ব্যবহার করা যায় না। কারণ, সেটা ভেসে ভেসে সারা ঘরে ছড়িয়ে পড়বে। তাই নভোচারীরা ব্রাশ পানি দিয়ে একটু ভিজিয়ে নেন। তারপর ব্রিসলের ওপর টুথপেস্ট নিয়ে ব্রাশ করতে থাকেন। ব্রাশ করা শেষ হলে পুরোটা টুপ করে গিলে ফেলেন।

মহাকর্ষ বল না থাকায় খাবার এভাবেই ভাসমান থাকে
মহাকর্ষ বল না থাকায় খাবার এভাবেই ভাসমান থাকে

খাওয়াদাওয়া

আগে নভোচারীরা সব ধরনের খাবার খেতে পারতেন না। এখন অবশ্য এ ব্যাপারটা অনেক সহজ হয়েছে। যেমন স্যান্ডউইচের কথাই ধরো। পৃথিবীতে পাউরুটির মধ্যে ফিলিং দেওয়া হয়। কিন্তু মহাকাশে পাউরুটি খাওয়ার উপায় নেই। কারণ, পাউরুটি খেতে গেলে কিছু অংশ গুঁড়া হয়ে নিচে পড়ে যাবে। তারপর সারা মহাকাশযানের মধ্যে ভেসে বেড়াবে। ফলে কাজে ব্যাঘাত ঘটবে। সে জন্য নভোচারীরা বাসায় বানানো রুটির মতো একধরনের রুটি দিয়ে স্যান্ডউইচ বানান। বায়ুশূন্য প্যাকে রাখা রুটিগুলো বের করে পিনাট বাটার আর মধু দিয়ে ভাঁজ করে খেয়ে নেন। খাওয়ার পর হাত ধোওয়ার সমস্যা থেকেই যায়। পানি ব্যবহার করা যায় না, তাই ওয়েট টিস্যু দিয়ে হাত মুছতে হয়।

গোসল

গোসলের কথা মনে হলেই আমাদের চোখে ভাসে—ওপর থেকে পানি পড়ছে। তার নিচে দাঁড়িয়ে গোসল করছি। পৃথিবীতে ব্যাপারটা যত সোজা, মহাকাশে ততটাই কঠিন। মাধ্যাকর্ষণ-বলয়ের বাইরে বলে পানি নিচে নামতে পারে না। তাই নভোচারীরা প্রথমে টিউব থেকে পানি নিয়ে শরীরে মাখেন। তারপর মাখেন সাবান। সাবানের বিশেষত্ব হলো, এতে ফেনা ওঠে না। এরপর তোয়ালে দিয়ে মুছে নেন। আর শ্যাম্পু? একইভাবে। প্রথমে পানি দিয়ে চুল ভিজিয়ে তাতে শ্যাম্পু দিতে হয়। তারপর চুলগুলো কিছুক্ষণ কচলে নিতে হয়। ব্যস, হয়ে গেল শ্যাম্পু করা। এরপর তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছে ফেললেই হলো।

টয়লেট

খাওয়াদাওয়া করলে টয়লেটে তো যেতেই হবে। টয়লেট বলতে এক বর্গমিটারের একটি জায়গা। বিশেষ কায়দায় সেখানে বসতে হয়। কমোডে বসে কোথাও যাতে ভেসে না যান, সে জন্য নিজেকে বেল্টের সঙ্গে আটকে রাখেন। টয়লেটে মানববর্জ্য সংগ্রহের জন্য রয়েছে শোষণব্যবস্থা। বর্জ্য নির্গত হলেই শুষে নিয়ে এক অ্যালুমিনিয়াম পাত্রে জমা হয়। পাত্র পূর্ণ হলে মহাকাশে ছুড়ে ফেলে দেয়। আর প্রস্রাব? নভোচারী ক্রিস হ্যাডফিল্ড জানিয়েছেন, সেটা সোজা পানির রিসাইকেল মেশিনে চলে যায়!

স্লিপিং ব্যাগে ঘুমপর্ব
স্লিপিং ব্যাগে ঘুমপর্ব

ভেসে ভেসে ঘুম

ঘুমানোর সময় আমাদের কত বায়না। নরম তোশক, বালিশ লাগবে। অনেকের তো কোলবালিশ না হলে চলে না! কিন্তু মহাকাশে ঘুমানোর কোনো বিছানাপত্তরই নেই। আছে স্লিপিং ব্যাগ। ঘুমের সময় নভোচারীরা স্লিপিং ব্যাগে ঢুকে পড়েন। ব্যাগগুলো যাতে ভেসে না যায়, সে জন্য সেগুলো নভোযানের সঙ্গে আটকানো থাকে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, মহাকাশে নাক ডাকার কোনো ঝামেলা নেই। মাধ্যাকর্ষণ না থাকায় কেউ নাক ডাকতে পারেন না!

পোশাক-আশাক

আমরা নভোচারীদের কমলা পোশাকে দেখতে অভ্যস্ত। বিশেষ এ পোশাক তাঁরা অবশ্য কাজে যাওয়ার সময়েই পরেন। এটি পরতে কত সময় লাগে, জানো? পাক্কা চার ঘণ্টা! আবার পোশাক পরার নির্দেশিকা বইটিও ১০০ পৃষ্ঠার। অন্য সময়ে নভোচারীরা সাধারণ পোশাক পরেন। তবে একটা পোশাক টানা ১০ দিন পরে থাকতে হয়। ওঁদের জামাকাপড়ের অভাব? মোটেও না। আসলে পোশাক পাল্টানোতেই যত ঝামেলা। আর শীত লাগলে একবার যদি কেউ মোজা পরেছেন, তো সেটি পাক্কা এক মাস পরে থাকতে হয়।

রান্নাবান্না

মহাকাশ স্টেশনে আসলে রান্নাবান্নার দরকার পড়ে না। সব খাবারই খাওয়ার উপযোগী অবস্থায় থাকে। শুধু গরম করে কিংবা পানি মিশিয়ে নিলেই হয়। তবে রান্নার ব্যবস্থাও আছে। একবার সান্ড্রা ম্যাগনাস নামে নভোচারীর রান্নার শখ জাগল। তিনি সহকর্মী নভোচারীদের জন্য রাঁধবেন। কিন্তু রাঁধতে গিয়ে টের পেলেন, এটা আসলে কয়েক ঘণ্টার কর্ম। পেঁয়াজ, রসুন কাটতেই লেগে গেল ঘণ্টা খানেক! এরপর থেকে তিনি খুব একটা রাঁধতেন না। 

শরীর ফিট রাখতে চলছে ব্যায়ামপর্ব
শরীর ফিট রাখতে চলছে ব্যায়ামপর্ব

ব্যায়ামও আছে

তোমার কাছে মনে হতে পারে, শূন্যে ভেসে বেড়ানো খুব মজার। তবে এর অসুবিধাও আছে কিছু। সেখানে খুব একটা শারীরিক পরিশ্রম করতে হয় না। তাই শরীরের ক্যালসিয়াম কমে যায়, হাড় ক্ষয় হয়। শরীরকে ফিট রাখতে নভোচারীরা রুটিন করে ব্যায়াম করেন। ব্যায়াম করার জন্য মহাকাশ স্টেশনে ট্রেডমিল, বাইক ও এআরইডি রয়েছে।

কী মজা না! মাছের মতো সাঁতার কাটা যায়
কী মজা না! মাছের মতো সাঁতার কাটা যায়

বিনোদন

ভাবছ, নভোচারীরা গেছেন গবেষণার কাজে, সেখানে বিনোদনের সুযোগ কই! তোমার ভাবনা ভুল। আসলে মহাকাশ স্টেশন যেন নিজেই এক বিনোদন কেন্দ্র! কারণ, সেখানে মাছের মতো বাতাসে সাঁতার কাটা যায়। কফি শূন্যে ঢেলে স্ট্র দিয়ে খাওয়া যায়। স্কুলে বিস্কুট দৌড়ের মতো শূন্যে লাফিয়ে খাবারদাবার মুখে পুরে নেওয়া যায়। দিনে অনেকবার সূর্যোদয়-সূর্যাস্ত দেখা যায়। তা ছাড়া নভোযানে অবসর কাটানোর জন্য সিনেমা দেখা, কম্পিউটার গেমস খেলা, পৃথিবীর আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ তো রয়েছেই। আবার ক্রিসমাসের মতো বিশেষ দিনগুলোও তাঁরা নানা আয়োজনে পালন করেন। এখন তো ইন্টারনেটেও আছে। তাঁরা মহাকাশের ছবি তুলে হরহামেশাই ফেসবুকে পোস্ট করেন।

মহাকাশে নভোচারীদের মতো আজব ব্যাপারগুলো একদিন তুমিও উপভোগ করতে পারবে। যদি তুমি বড় হয়ে নভোচারী হও। এজন্য শুধু লেগে থাকতে হবে। এছাড়া বাণিজ্যিকভাবে স্পেস ট্যুরিজমের তোড়জোড়ও শুরু হয়ে গেছে। স্পেস আইল্যান্ড গ্রুপ নামের একটি কোম্পানি ২০২০ সালের মধ্যে ২০ হাজার পর্যটককে মহাকাশ ঘুরিয়ে আনার পরিকল্পনা করছে। তাই এখন শুধু অপেক্ষার পালা।

নাসা ডট কম অবলম্বনে